রবিবার, ২১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য!

হোসেন আবদুল মান্নান

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য!

অবসরের তিন বছরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না সরকারি কর্মচারীরা। এমন একটা আদেশ জারি করেছিলেন আলোচিত ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুশীলবরা। ২০০৮ সালের ১৯ আগস্ট নির্বাচন কমিশন জারিকৃত আরপিও অনুচ্ছেদ ১২ (১) (এফ) নীতিমালায় পরিবর্তন এনে তা সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, ২০০৭-২০০৮ সালের  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ছাড়াও আরপিওতে ব্যাপক সংস্কার আনা হয়।  যা পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ কর্তৃক যথারীতি আইনে রূপান্তরিত করা হয়। জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ পাঁচ বছর করতে চেয়েছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, চাকরিতে থাকাকালীন সরকারি কর্মচারীরা নিজের পদকে ব্যবহার করে বা পদবির জোরে নিজ নিজ এলাকায় উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হন এবং দলীয় সরকারের অধীনে থেকে রাজনৈতিক কর্মীদের মতো আচরণ করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। যা পরবর্তীতে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীর পক্ষে ভোটাররা প্রভাবিত হতে পারেন। যদিও সরকারি কর্মচারীদের এ সুযোগ খুবই সীমিত। কারণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জাতীয় পর্যায়ের অনুমোদন হয় একনেক সভায়, যার সভাপতি স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তথাপি এমন একটা অপব্যাখ্যার কারণে সরকারি কর্মচারীরা অবসরের পরে তিন বছর বাধ্যতামূলকভাবে অপেক্ষা করে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। বলা যায়, এমন বিধান দ্বারা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জীবন থেকে সবচেয়ে মূল্যবান তিনটি বছর ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।

২) কেন তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে? বা এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কি না? বা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না? পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন আইন না থাকলেও বাংলাদেশে কেন আছে? এসব প্রশ্ন স্বাভাবিক নিয়মে দেশের নাগরিকের মনে আসতেই পারে এবং এর পেছনের কারণ জানা সব নাগরিকের কর্তব্য বলে মনে করি।

৩) বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ 

একই সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার কথা বিবৃত হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক এবং বয়স পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে যে কেউ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তবে অযোগ্য হবেন যদি- ক) কোনো উপযুক্ত আদালত তাঁহাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন।

খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন।

গ) তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন।

ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।

৪) ভাবনার বিষয় হলো, বাংলাদেশের রাজনীতির দুঃসহ ক্রান্তিকালে যখন বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদরাও নিরাপদ ছিলেন না; সে সময় একটা প্রলম্বিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেন এমন একটি অরাজতান্ত্রিক বিধান করল? তা হয়তো কোনো একদিন প্রকাশিত হবে। তবে আমাদের দেশের মানুষের সাধারণ প্রবণতা সব সময় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সরকারি কর্মচারীদের বিপক্ষে বিধায় বিগত দেড় দশকেও এমন একটি গর্হিত তথা অসম্মানজনক আইন নিয়ে দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, রাজনৈতিক দল এমনকি সচেতন সরকারি চাকরিজীবীরাও মুখ খুললেন না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে এটা অবশ্যই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। অথচ আমার জানা মতে, দুনিয়ার কোথাও কোনো সরকার ব্যবস্থায় এমন নজির নেই।

সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদের বরাতে জেনেছি, একজন অবসরপ্রাপ্ত মেধাবী সামরিক কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় তাঁর চাকরি পরিত্যাগ করেছেন এবং তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ইচ্ছে পোষণ করেছেন। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় তাঁর মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণœ করা হয়েছে বিধায় মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দারস্থ হয়েছেন। আরও জানা যায়, বিগত ২০১২ খ্রি. ভারতের নির্বাচন কমিশনও এমন একটা প্রস্তাব নিয়ে সে দেশের হাই কোর্টে উপস্থাপন করেছিলেন। তারাও অবসরের পরে সরকারি কর্মচারীদের নির্বাচন তথা রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য একটা cooling off period -এর দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪-এর সরাসরি পরিপন্থী বা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় বিষয়টি উচ্চ আদালত থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০১৩ সালে সে দেশের মহামান্য আদালত এ বিষয়ে একটা মতামতও প্রদান করেছিলেন।

৫) ধারণা করা হয়, বাংলাদেশের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হয়তো বিশেষ কোনো এজেন্ডা ছিল। প্রথমত, তখন তারা যথাসময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ারই পক্ষে ছিলেন না। বরং অসংখ্য নেতা-কর্মী ও কর্মচারীকে দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন। সরকারের ভিতরে শুদ্ধাচার ও সুশাসন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। একপর্যায়ে রাজনৈতিক বিলাসিতার দিকেও পা রাখতে প্রয়াস নিয়েছিলেন। তৎকালীন প্রেক্ষাপট বলে, অনেকটা নিরুপায় হয়েই তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এটা এখন পরিষ্কার যে, তারা সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের একটা মেধাবী অংশকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করেছিলেন মূলত তাদের ক্ষমতাকে নির্বিঘ্ন ও দীর্ঘস্থায়ী করার মানসে। এই উদ্ভট আইনে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন এমনকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও কোনোরূপ বারণ বা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেননি। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথে এমন শর্তারোপ করা হয়েছে। অথচ উল্লিখিত পদে নির্বাচিতদের কেউ কেউ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর সমমর্যাদায় অভিষিক্ত হচ্ছেন এবং জাতীয় পতাকাসমেত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতেও প্রতীয়মান হয়, বিশেষ উদ্দেশ্যেই এমন একটা নজিরবিহীন আইনি বাধ্যবাধকতার বেড়াজালে এদেশের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের আটকে রাখা হয়েছে।

৬) এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘ প্রতিবাদহীন থাকার রহস্যময় কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, সুদীর্ঘ তিন দশক বা তদূর্ধ্ব সময়ের চাকরি জীবনে কর্মচারীদের সামান্য কিছু অংশ (অবশ্যই সবাই নন) জানা-অজানা নানাবিধ অনৈতিক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। কারও কারও বেহিসেবী অর্থবিত্তও হয়ে যায়। ফলে অবসরের পরে তাদের আর সেই দৃঢ়তা বা নৈতিক মনোবল থাকে না। বরং আমৃত্যু সরকারের ছায়ায় বা প্রাইভেট কোনো কাজে নিভৃতে নিজেকে জড়িত করে অনেকটা ছদ্মাবরণে নিরিবিলি সময় নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। নির্বাচন তা-ও আবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বাসনা করাকে তারা বড় ধরনের ঝুঁকি বলেই মনে করেন। কারণ বর্তমানে এর জন্য প্রয়োজন হয় লক্ষ কোটি টাকা এবং দলীয় রাজনৈতিক সমর্থন বা আশীর্বাদ। যা একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর জন্য খুব সহজ কাজ নয়। তাছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে পরোক্ষভাবে তিনিই যেন জানান দেবেন, নির্বাচন করার মতন আর্থিক সংগতি তার রয়েছে।  কাজেই রাজনৈতিক পটভূমিসহ প্রবল আগ্রহ বা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা এসব নির্বাচনকে সচরাচর এড়িয়ে চলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

৭) তিন বছরের এমন নিষেধাজ্ঞায় লাভ কার? সরকারের? রাজনৈতিক দলের? নাকি জনগণের? এমন প্রশ্ন অনেকের কাছ থেকে শোনা যায়। এতে সরকারি কর্মচারী বা রাজকর্মচারীকে বোঝানো হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সচরাচর কারা প্রার্থী হয়ে থাকেন? অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, সরকারের অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছাড়া অন্যদের এতে আগ্রহী হতে দেখা যায় না। এবং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা-ই বাস্তবতা।

তবে অনেকেই মনে করেন, নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি তথা গ্রামবাংলায় বেড়ে ওঠা দু-চারজন জনপ্রিয় মেধাবী ও সরকারি কর্মে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মচারী নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের প্রত্যাশার কাছাকাছি এসে সেবা প্রদানের সুযোগ পেলে ক্ষতি কী? বরঞ্চ এটা যে কোনো সরকারের জন্য আশীর্বাদ হওয়ারই কথা। এখানে রাজনীতিবিদগণের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকতার কোনো অবকাশ নেই। কেউ কারও প্রতিপক্ষ নয়, দিনের শেষে সবাই একই মাটির সন্তান, একই তরণীর যাত্রী। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং পছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়াই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অন্যদিকে, একটি সচেতন মহলের দাবি হলো, প্রায় কালো আইনের মতো যে আইনটি বর্তমান নির্বাচিত সরকার করেনি তারা এর দায় নিচ্ছে কেন? নির্বাচনে অংশগ্রহণের অবাধ স্বাধীনতা সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অধীন।  এতে মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। তাছাড়া, সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় এ আইন কখনো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না।

                 লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর