রবিবার, ২১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাঝেমধ্যে ভাবী, কেন এসব করি?

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

মাঝেমধ্যে ভাবী, কেন এসব করি?

যখনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রসঙ্গ ওঠে, তখনি প্রচলিত কয়েকটা বই আর মার্কিন দূতাবাসের কিছু নথির রেফারেন্স চলে আসে। খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এসব বই এবং নথিতে মূলত কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক অপরাধীকে হাইলাইট করা হয়েছে, সঙ্গে আগে-পরের কিছু সভার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যার ষড়যন্ত্রের শেকড় এসব ছাড়িয়েও আরও অনেক গভীরে। আমরা ষড়যন্ত্রের কতটা গভীরে গিয়েছি? বা যেতে চাই? বা আদৌ এসব নিয়ে মাথা ঘামাই কি না? এমন একটি পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পেছনে কারা ছিল? বঙ্গবন্ধুর মতো এমন একজন রাষ্ট্রনায়ককে এভাবে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অর্থের জোগান এসেছিল কোথায় থেকে এবং কীভাবে? কারা দিয়েছিল সেই অর্থ? এসব প্রশ্নের উত্তর আজও জানা যায়নি। এমনকি প্রশ্নগুলো যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে করাও হয়নি। ‘ইতিহাস’ শব্দটি কেবল অভিধানের পাতায় লুকিয়ে থাকা কয়েকটি বর্নমালার সমন্বয় নয়। ‘ইতিহাস’ শব্দটির নিজস্ব একটি সত্ত্বা আছে। সে একদিন অবশ্যই নিজেকে উন্মোচন করে দেবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, গণহত্যা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা- এই বিষয়গুলোকে নিয়ে ইতিহাস তার জবানবন্দি নিয়ে নতুন করে হাজির হতে যাচ্ছে।  

আমার দীর্ঘ পেশাগত জীবনের পঁচিশটি বছর আমি জনস্বাস্থ্যবিষয়ক নানা রকমের গবেষণায় জড়িত ছিলাম। স্বভাবতই আমার গবেষক সত্ত্বা অনেক বিষয়েই আগ্রহী হয়, ঘটনার গভীরে যেতে ভালোবাসে। রাজনীতি আমার প্রিয় বিষয়। আমার জীবন-যৌবনের অনেকখানিই কেটেছে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত থেকে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার বিচারের দাবিতে ইউরোপ, আফ্রিকা, কানাডায় সভা করেছি। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এসেছে জলজ্যান্ত সাপ।

আমাদের এসব পাগলামির সঙ্গে এক যুগল তরুণ-তরুণী জড়িত। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো তারাও নিজেদের কাজ ও উপার্জনের ক্ষতি করে এসব উন্মাদনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। বিদেশে থেকেও এসব কাজের সঙ্গে অনেক ঝুঁকি জড়িত। যেমন গোপন কিছু নথি উদ্ধার করতে গিয়ে একবার আমাদের গ্রুপের দুজনকে পুলিশ কয়েক ঘণ্টার জন্য হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতার করেছিল। তবু ওরা থেমে থাকেনি। কদিন আগে কোনো এক শহরে কাজ করতে গিয়ে এই দলের সেই তরুণ ছেলেটি একটানা সাত দিন গাড়ির পেছনে ঘুমিয়েছে। হোটেল ভাড়ার হিসাব মেলাতে পারছিল না সে। কথা ছিল, ওই শহরে গেলে আমি পরিচিত কাউকে বলে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু নূপুরজানের আকস্মিক দুর্ঘটনার কারণে আমি ব্যস্ত থাকায় সে আর আমাকে কিছু জানায়নি। গতকাল খবর পেলাম, প্রচ- ঠান্ডায় ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অসুস্থতা সত্ত্বেও তার কাজ থেমে নেই।

টেলিফোনে কথা বলার একপর্যায়ে সেই তরুণ কান্নাভেজা কণ্ঠে জানালো এমন বর্বরচিত গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা সংক্রান্ত বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত এ নিয়ে এখনো বিতর্ক হয়, ত্রিশ লাখকে তিন লাখ বলতে চায় পাকিস্তানপ্রেমী একদল নব্য রাজাকার। অথচ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের বেশি। এবার আরেকটি গল্প বলি, মন দিয়ে শুনুন। একাত্তরে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় দুটি স্কুলে শিক্ষকেরা একটা অদ্ভুত নিয়ম করেছিল। স্কুলের যে কোনো অনুষ্ঠানে তারা সব ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল ড্রেস পরে আসতে মানা করেছিল। এবং এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে প্রতিবার দশ সেন্ট করে জরিমানা করা হতো। মাস শেষে জরিমানা থেকে সংগৃহীত সব অর্থ স্কুল কর্তৃপক্ষ ভারতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা রাস্তায় নেমে মানুষের কাছে হাত পেতে অর্থ সংগ্রহ করত। তাদের মুখে মুখে স্লোগান ছিল, ‘ওয়ান-টু-থ্রি, হেলপ এরিফিউজি।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পৃথিবীব্যাপী এরকম কত শত মর্মস্পর্শী ঘটনা যে ঘটেছিল, আমরা তার কতটুকুইবা জানি বা জানতে চেয়েছি? এসব কাজ করতে গিয়ে প্রতি পদে পদে অর্থের প্রয়োজন হয়। তরুণ-তরুণীদের উপার্জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কখনো বা আদালতেরও স্মরণাপন্ন হতে হয়। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রশাসনিক আদালতে মুক্তিযুদ্ধ ঘটিত বিষয়ে আমরা সতেরোটি মামলা লড়ছি। একই ধরনের হওয়ায় আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সতেরোটি মামলার জন্য আলাদা আলাদা ফি না দিয়ে বিচারক মহোদয় একটি মামলার ফি দিলেই চলবে, এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এসব কাজ করতে গিয়ে আজকাল মাঝেমধ্যেই মনে হয়, নিজের মেধা, সময়, শ্রম, অর্থ ব্যয় করে কেন এই কাজগুলো করি? অনেক সময় প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না বলে অনেক কাজই করতে পারি না কিংবা দেরি হয়ে যায়। অথচ দেশে কত মানুষের কত টাকা। কত হাইব্রিডের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। কত শত চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠান হয়, কোটি কোটি টাকার কেবল বাজিই পোড়ে। আর বিদেশের মাটিতে বসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সন্ধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে আমরা অর্থের অভাবে ভোগি। সামান্য এক-দুই লাখ ডলার খরচ করলেই অসামান্য অনেক ঐতিহাসিক দলিল জোগাড় করা যেত। যে ছেলেমেয়েগুলো বিনা পারিশ্রমিকে ঝুঁকি নিয়ে রাতদিন কাজগুলো করছে, ওদের শরীর ভেঙে পড়ছে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ভাববার সময় কই? আমরাও থেমে থাকি না। যেখানে দৌড়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলি। দ্য শো মাস্ট গো অন। ইতিহাসের সন্ধানে শুরু করেছি যে যাত্রা, কোনো সীমাবদ্ধতার কাছেই সে হার মানবে না। চিয়ার্স!

                লেখক : অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কবি চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

সর্বশেষ খবর