সোমবার, ২২ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
ইতিহাস

হালাকু খানের হত্যাযজ্ঞ

হালাকু খানের হত্যাযজ্ঞ

মোঙ্গল শাসক হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ ইতিহাসের একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। এ হামলায় বাগদাদের ১৬ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। পারস্যের গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের ক্ষমতা বিলোপ করার পর ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে হালাকু খান বাগদাদ অবরোধ করেন। এ সময় বাগদাদের খলিফা ছিলেন আল-মুস্তাসিম বিল্লাহ। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমনের ব্যাপারে হালাকু খান খলিফার সহায়তা চান। অপরিণামদর্শী খলিফা হালাকু খানকে সাহায্য প্রদানে কোনো আগ্রহ দেখাননি। এতে হালাকু খান খলিফার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে বাগদাদ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমনের পর হালাকু খান বাগদাদের দিকে অগ্রসর হন। অভিযানের শুরুতেই তিনি বাগদাদের বহিঃপ্রাচীর ধ্বংস করে খলিফাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। খলিফা এতে সায় না দিলে বাগদাদ নগরী অবরুদ্ধ হয়। মোঙ্গল বাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে প্রবল বেগে আক্রমণ চালায়। মোঙ্গল বাহিনীর চীনা, তাতার ও মধ্য এশিয়ান সেনারা একের পর এক অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করে খলিফা আল-মুস্তাসিম বিল্লাহর মনে ভয় ঢোকাতে সমর্থ হয়। বাগদাদের পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। খলিফার ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী হালাকু খানের বিশাল বাহিনীর হাত থেকে বাগদাদ রক্ষায় ব্যর্থ হলে খলিফা পরিবার-পরিজন, অনুচরবর্গসহ জীবন রক্ষার জন্য প্রাণভিক্ষা চান এবং আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন। মোঙ্গলরা খলিফার আবেদনে সাড়া দেয় এবং নগরবাসীকে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। খলিফাসহ নগরবাসী আত্মসমর্পণ করলে হালাকু খান বাগদাদ নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খলিফা ও খলিফার আত্মীয়-পরিজনসহ নগরীর অসংখ্য নর-নারীকে হত্যা করেন। বাগদাদের অগণিত নারী-পুরুষের করুণ আর্তনাদ উপেক্ষা করে মোঙ্গল বাহিনী বীভৎস হত্যালীলা চালায়। জীবননাশের মধ্য দিয়েই মোঙ্গল বাহিনীর তান্ডব শেষ হয়নি, তাদের হাতে যুগ যুগ লালিত মুসলিম সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতিরও বিলুপ্ত ঘটে। বাগদাদ পরিণত হয় বিধ্বস্ত নগরীতে। তাদের আক্রমণের প্রচন্ডতায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম নিদর্শন বাগদাদ নগরী এক মহাশ্মশানে পরিণত হয়। এভাবে ‘আরব্য রজনীর স্বপ্নপুরী’ বাগদাদ তার সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে প্রতিপক্ষের জিঘাংসার পরিতৃপ্তি ঘটায়।

ইবনে খলদুনের মতে, মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে ১ লাখ ৬০ হাজার লোক প্রাণ হারায়, মতান্তরে ২০ লাখ অধিবাসীর ১৬ লাখ লোকই মারা যায়। এ আক্রমণের ফলে বাগদাদ মোঙ্গলদের অধিকারভুক্ত হয় এবং মুসলিম বিশ্ব কিছুকালের জন্য খলিফাশূন্য হয়ে পড়ে। এ আক্রমণের ধ্বংসলীলায় অসংখ্য নর-নারী আত্মাহুতি দেয়। বাগদাদ ধ্বংসের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ব্রাউন বলেন, ‘সম্ভবত কখনো এত বড় ও সমৃদ্ধিশালী একটি সভ্যতা এত দ্রুত অগ্নিশিখায় বিধ্বস্ত ও রক্তধারায় নিশ্চিহ্ন হয়নি।’ মোঙ্গলদের নিষ্ঠুর আক্রমণে অসংখ্য মসজিদ, প্রাসাদ, অট্টালিকা ধ্বংস হয়। জনগোষ্ঠীর মধ্যে কেবল কিছু শিল্পী, চিত্রকর ভয়াবহ তান্ডবের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ পি সাইকস বলেন, ‘যে ভয়ংকর ধ্বংসলীলা মুসলিম রাজ্যগুলোর এবং পরোক্ষভাবে সমগ্র দুনিয়ার অগ্রগতি রুদ্ধ করে দিয়েছিল, তার প্রকৃতি অনুধাবন করা কষ্টকর এবং অতিরঞ্জিত করা অসম্ভব।’ ইতিহাসবিদ আমির আলীর মতে, ‘বাগদাদ আক্রমণে যে ধ্বংসলীলা অনুষ্ঠিত হয় তা থেকে অন্যান্য শহরে কী ঘটেছিল তার আভাস পাওয়া যায়। তিন দিন ধরে শহরের পথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল এবং তাইগ্রিস নদীর পানি মাইলের পর মাইল রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। আক্রমণের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনুল আমির বলেন, ‘পৃথিবীর এবং বিশেষত মুসলমানদের ওপর যেসব বিরাট বিপর্যয় ও ভয়াবহ ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়েছিল তার মধ্যে তাতার জাতির আক্রমণ অন্যতম।’ হালাকু খান যখন বাগদাদ আক্রমণ করেন তখন এ নগরী ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ।

বাগদাদ আক্রমণের ফলে বহু স্মৃতিসৌধ, প্রাসাদ ও মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বহু কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী নিহত হন। মুসলিম বিশ্বের স্বপ্নরাজ্য বাগদাদে জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির যে দীপশিখা প্রজ্বালিত হয়েছিল তা মোঙ্গল ধ্বংসযজ্ঞে স্তব্ধ হয়ে যায়।            

          ♦  আবদুর রশিদ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর