রবিবার, ৪ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বন্ধ হোক তামাক চাষ

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

বন্ধ হোক তামাক চাষ

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার হেক্টর কৃষি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। যা দেশের খাদ্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে এবং এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে খাদ্য সংকট তৈরি করতে পারে। তামাক চাষ মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে যেটা সর্বজন স্বীকৃত। এমনকি কৃষকও সেটা জানে। তামাক চাষের কারণে খাদ্যশস্য চাষের জমি কমে যাচ্ছে। দেখা যায়, দেশের যেসব জেলায় তামাক চাষ হয় সেখানে পুষ্টিকর খাদ্য সংকট রয়েছে। পরিবেশ, প্রাণিকুলেও তামাক চাষের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তামাক পোড়ানোর ফলে বাংলাদেশে ৩০% বন উজাড় হচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতের কারণে বনভূমি উজাড় হচ্ছে। শুধু তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে প্রতি বছর ২৯ লাখ ৩২ হাজার গাছ পোড়ানো হয়। ১ একর জমিতে যে পরিমাণ তামাক উৎপন্ন হয় এটি শুকানোর জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫ টন কাঠ। উপরন্তু তামাক চাষে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক জীববৈচিত্র্য, প্রাণীচক্রের ক্ষতিসাধন করেছে। তামাক চাষপ্রবণ এলাকায় মানুষের মধ্যে বিশেষত, গর্ভবতীদের নানাবিধ স্বাস্থ্যগত সমস্যা, প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম দেয়। ওই সমস্ত এলাকায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী বেশি হয়ে থাকে। কারণ তামাক চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নারী, শিশুরা জড়িত থাকে। বৈশ্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তামাক চাষ সারা পৃথিবীর ২-৪ শতাংশ বন উজাড়ের জন্য দায়ী। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিন-আপ বাংলাদেশসহ ৯২টি দেশের সাগর থেকে যে বর্জ্য সংগ্রহ করে, তার মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে সিগারেট ফিল্টার। তামাক চাষের পরিমাণ জমি তৈরিতে প্রচুর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ১৯৭০ সাল থেকে তামাকের কারণে বিশ্বব্যাপী (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে) আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন হেক্টর বন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

যা ২০% বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির প্রধান কারণ! এত ভয়াবহতার পরও তামাক চাষ লাভজনক এবং তামাককে অর্থকরী ফসল হিসেবে জাহির করার প্রবণতা সব সময় লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আদতে তামাক চাষ তামাক কোম্পানির জন্য লাভজনক, কৃষকের জন্য নয়। যদি কৃষকের জন্য তামাক চাষ লাভজনকই হতো তাহলে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল, কুষ্টিয়া, বান্দরবানসহ তামাক চাষপ্রবণ এলাকাগুলোতে দরিদ্র মানুষ থাকত না। এ জেলাগুলো অনুন্নত থাকত না। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের লোভনীয় ফাঁদে ফেলে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। কারণ ‘তামাক’ তাদের ব্যবসার প্রধান কাঁচামাল। যে কোনো উপায়ে ব্যবসার কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত করতে চাইবে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো। আমার, আপনার কিংবা রাষ্ট্রের কী ক্ষতি সেটা তাদের মাথাব্যথার কারণ নয়।

তামাকের ক্ষতি আমাদের মাথাব্যথা। তাই কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত এবং বিকল্প ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তামাক চাষ হতে ফিরিয়ে আনতে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে আপিল বিভাগ থেকে নির্দেশনা রয়েছে, সেটা অনুসরণ জরুরি। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-১২ তে তামাক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে, বিশেষত তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে একটি নীতি প্রণয়নের নির্দেশনা রয়েছে। যতদূর জানা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে।

সময়ের প্রয়োজনে নীতিটি চূড়ান্ত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে তামাক চাষ নির্মূল অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ আমাদের খাদ্য সংকট প্রতিরোধ এবং তামাকের করাল গ্রাস থেকে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তামাকমুক্ত করতে হবে দেশ। যে কথাটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন। তিনি ২০১৬ সালে ‘সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিট’ এ ঘোষণায় বলেন, ‘আমরা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে চাই।’ তার এ ঘোষণা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দফতর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা দেখি, প্রধানমন্ত্রী কোনো ঘোষণা, অঙ্গীকার, প্রত্যয় ব্যক্ত করলে সেটার বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সহযোগী দফতর, বিভাগ সবাই ত্বরিত পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তামাক ও মাদকের মতো জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে একপ্রকার অনীহা কিংবা দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায়। যা অনাকাক্সিক্ষত।

তামাক নিয়ন্ত্রণ শুধু এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়, এক্ষেত্রে সবাইকে নিজ নিজ অধিক্ষেত্র থেকে কাজ করতে হবে। দেশে তামাক চাষ বন্ধের পাশাপাশি তামাক ব্যবহারও নিষিদ্ধ করতে হবে।

লেখক : (একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর