বুধবার, ৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফেসবুকে ভানুমতীর খেল

আফরোজা পারভীন

ফেসবুকে ভানুমতীর খেল

ধন্যবাদ ফেসবুক! আপনার কল্যাণে নানারকম খেলা দেখছি আমরা। এ এক অসামান্য বিনোদন! বড়সড় রঙ্গ-তামাশা! আপনি জন্মগ্রহণ না করলে, মার্ক জাকারবার্গ আপনার জন্ম না দিলে কীভাবে ঘরে বসে পেতাম এমন মনোহর বিনোদন! কেউ লাইভে সনদ পুড়িয়ে চাকরি পাচ্ছেন, কেউ লাইভে হাত কাটছেন, কেউ নিজের মাথায় গুলি করছেন, কেউ পুরস্কার চাচ্ছেন, কেউ ক্যামেরা নিয়ে দান খয়রাত করছেন, কেউ বন্ধুর বউ নিয়ে পালাচ্ছেন। প্রেম-ভালোবাসার কথা বলছেন দেদার। প্রকাশ্য- অপ্রকাশ্য কত উপায় আছে। ইনবক্স নামক বাক্সে অশ্লীল অশোভনতা চলছে। জনসেবার নামে বাণিজ্য চলছে। নানারকম সুস্বাদু খাবারের পসরা দেখছি দিনের পর দিন। কতজন কত বড় রাঁধুনি, কত বড় বিউটিশিয়ান সবই জানতে পারছি ফেসবুকের দৌলতে। দেশের অনেক মানুষ এসব খাবার খাওয়া তো দূরের কথা, চোখেও দেখে না তা- তাদের মনে থাকে না। এদের অনেকে আবার গলা ফাটিয়ে সমতা, ন্যায্যতা, প্রগতি এসব কথা বলে!

গোটা বিশ্ব পাচ্ছি চোখের সামনে। ঘটনার শেষ নেই। রোমান্স, থ্রিল, হরর, অ্যাকশন কী নেই এখানে। বাণিজ্য আছে, বিপণন আছে, ঘটকালি আছে। আছে গান, নাচ, বাজনা, অঙ্গভঙ্গি, প্যারোডি হাজারো জিনিস।

যে মেয়েটি সনদ পুড়িয়ে চাকরি পেয়েছেন ফেসবুকের কাছে তিনি নিশ্চয়ই চির কৃতজ্ঞ। সরকারি চাকরির বয়স বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করছিলেন ভালো কথা। দেশে আসলেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী ভালো রেজাল্ট, ভালো পড়াশোনা করেও বছরের পর বছর ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পাচ্ছেন না-এটা সত্য। তাদের দীর্ঘশ্বাস আছে, কান্না আছে, পরিবারের তাদের কাছে চাওয়া আছে, অবহেলা আছে সবই সত্য। আশপাশের বহু দেশে সরকারি চাকরির বয়স ৩৫ এবং তদূর্ধ্ব এটাও সত্য। সবই মানছি। কিন্তু এভাবে কেন?

নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো যেতে পারে। যোগ্য হয়েও যারা চাকরি পান না, কেন পান না তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে, স্বচ্ছতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একজন লাইভে এসে সনদ পুড়িয়ে চাকরি পেয়ে গেল এটা কেমন কথা! সনদ পোড়ানো তো একটা মারাত্মক অপরাধ, তাও আবার লাইভে এসে! এবার যদি ওর দেখাদেখি বেকার ছেলেমেয়েরা সনদ পোড়াতে থাকে তখন কী হবে! দেশে তো আবেগি ছেলেমেয়ের অভাব নেই। সরকার কয়জনের চাকরি দেবে! আর সনদ পোড়ানোর পরও যখন তারা চাকরি পাবে না তখন তারা যে কোনো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে। তাদের হতাশা চতুর্গুণ হয়ে যেতে পারে! আমি কোনো নারীর চাকরি পাওয়ার বিপক্ষে নই। সারা জীবন নারীদের জন্য কাজ করেছি, করছি। তার মানে এই নয় যে, আমি পুরুষের জন্য কাজ করি না। পুরুষের প্রতি অন্যায়-অবিচার দেখলেও আমি কলম ধরি। নারীরা পিছিয়ে আছে, তাদের ওপর অন্যায়-অবিচার বেশি হয় বলেই তাদের জন্য লিখি, কাজ করি। শুনেছি এই মেয়েটি সংগ্রামী। কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লড়াই করে এ পর্যন্ত এসেছে। নিজে পড়েছে, পরিবারকে সাহায্য করেছে, এখন বয়স বাড়ানো আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তার বক্তব্য আমি শুনেছি। যৌক্তিক এবং গোছানো। তার সংগ্রামী চরিত্রের সঙ্গে এই সনদ পোড়ানোর বিষয়টা একদম যায় না। তিনি যদি সংগ্রামে জিতে দাবি আদায় করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় চাকরি পেতেন তাহলে তাকে সাধুবাদ জানাতে পারতাম।

আমাদের একজন বিশিষ্ট কবি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। তার কবিতা এতটাই ভালো যে, স্ট্যাটাস না দিলেও তিনি পুরস্কার পেতেন। হয়তো এ বছর না পেয়ে পরের বছর পেতেন। তাতে কিন্তু তার বড়ত্ব এতটুকু কমত না। যেমন এই পুরস্কার তাকে এতটুকু বড় করেনি। তার লেখা ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, স্বাধীনতা, এ শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কিংবা ‘হুলিয়া’ এক একটি মাইলস্টোন। হুলিয়া পড়ে এই কবির কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম। আজও গোটা কবিতাটা আমার মুখস্থ। যার প্রতিটা লাইন আমাকে উদ্বেলিত করে। এমন নিশ্চয়ই অজস্র ভক্ত-পাঠক তার আছে! তার কবিতা তো এমনিতেই বেঁচে থাকবে। তারপরও তিনি পুরস্কার চাইলেন এবং উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। এখন তিনি আরও কিছু চাইছেন তাও এই ফেসবুকে। তার দেখাদেখি অন্য কবিরাও চাইতে শুরু করেছেন। পুরস্কার/সম্মাননা এখন আর দেওয়ার বিষয় না, চাওয়ার বিষয়। শুনেছি কয়েক বছর আগে একজন লেখক কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন, এবার যদি আমাকে পুরস্কার দেওয়া না হয় আমি আত্মহত্যা করব। আর একজন কর্তাব্যক্তির পা ধরে বসেছিলেন, অন্য একজন এককাঠি ওপরে উঠে টেবিল চাপড়ে বলেছিলেন, কেন আমি পাব না, দিতে হবে। এরা সবাই পেয়ে গেছেন।

এসব অপসংস্কৃতি! বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ এই অমোঘ বাক্য এখন যেন আর সত্য নয়। ফেসবুক লাইভে এসে আবেগ জাগ্রত করা যায়। অনেক কিছু আদায় করে নেওয়া যায়। অনেক কান্নাকাটি করেও যা পাওয়া যায় না তা কাউকে কাউকে ফেসবুক দেয়। সবাইকে নয়। যেমন আমি আমার এলাকার কবরস্থানে মধ্যরাতে বুলডোজার চালানো নিয়ে ফেসবুকে অনেক কেঁদেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চেয়েছি। কেউ দৃষ্টিপাত করেনি, কর্ণপাত করেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো বিষয়টি জানেনও না। জানলে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন এ বিশ্বাস আমার আছে! কেউ কখনো শুনেছে কবরে বুলডোজার চালানো যায়! পাকিস্তানিদের বাঙালির ওপর এত আক্রোশ ছিল, গণহত্যা করেছে নির্বিচারে কিন্তু তারাও কবরে বুলডোজার চালায়নি। নড়াইল পৌরসভা চালিয়েছে। এ বিষয়টি আমার একার নয়, নিজের জন্য কিছু চাইনি। নড়াইলের আপামর জনসাধারণের জন্য চেয়েছিলাম। পাইনি।

নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। আমাদের জীবন গতিময় হয়েছে, সহজ হয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের কারণে বিদেশের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতে পারছি, তাদের খোঁজখবর রাখতে পারছি। এটা অনেক বড় বিষয়। কিন্তু ফেসবুক আমাদের জীবন জটিল করে দিয়েছে, ফেসবুকের অপব্যবহার হচ্ছে এটাও ভাবার বিষয়। ফেসবুক লাইভে এসে কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করছে। যেন হরর মুভি দেখছি। আমি আত্মঘাতী হচ্ছি এটাও মানুষকে দেখাতে হবে যাতে তারা এ পথে হাঁটতে উৎসাহী হয়। আমি হাতের রগ কাটছি এটা দেখিয়ে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করতে হবে। আরেকজনের বউ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি, কী প্রশংসার কথা! এটাও দেখাতে হবে। শত পদ রান্না করে খাচ্ছি ছিটাচ্ছি হল্লা করছি এটাও দেখাতে হবে! মৃতদেহের পাশে বসে ছবি তুলে দেখাতে হবে, মুমূর্ষু রোগীকে বিছানা থেকে তুলে ছবি তুলে দেখাতে হবে আমি তাকে দেখতে গিয়ে তার জীবন ধন্য করে দিয়েছি। এক পোঁটলা চাল ১০ জন মিলে দিয়ে ছবি তুলে দেখাতে হবে আমি কত বড় দানবীর!

ফেসবুক চলানোতে কি কোনো নিয়মনীতি নেই? নেই কোনো বিধিনিষেধ? কোন কথা বলা যাবে, কোন কাজ করা যাবে, কী করা যাবে না এগুলো কি বলা নেই?

চেয়ে কিছু নেওয়াতে কোনো কৃতিত্ব নেই। অর্জন করায় আছে। সে যদি ছোট্ট একটা চাকরি বা কাজ হয় তাতেও সন্তুষ্টি আছে। আমি যখন বিসিএসে যোগদান করি কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিল, জেলা কোটায় এসেছ? বলেছিলাম, না। এরপর প্রশ্ন ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটায় এসেছ? সজোরে বলেছিলাম, না। এরপরের প্রশ্ন ছিল, তাহলে? যেন এর বাইরে আমি আসতে পারি না, আসার যোগ্যতা নেই। বলেছিলাম, প্রশাসনের মেধা তালিকায় ১০ জনের একজন হয়ে এসেছি। শহীদ পরিবার হিসেবে আমরা কোনো বাড়ি, চাকরি, জমি, সুযোগ-সুবিধা নিইনি। আমিও না, আমার পরিবারও না। আমার মতো অসংখ্য শহীদ পরিবার কোনো সুযোগ নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধে যাদের বিন্দুমাত্র অবদান নেই এমন অনেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, নিচ্ছে। অনেকের মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বাতিল হয়েছে। এতে কোনো গৌরব নেই। যা আমার না, তা অনৈতিক উপায়ে নেওয়ায় গ্লানি মেশানো আছে।

এ দেশ নির্মাণে যারা রক্ত দিয়েছেন, যারা যুদ্ধ করেছেন, যাদের পরিবার সাফার করেছে, সাপোর্ট করছে তারা চায় সবকিছু হোক যোগ্যতার ভিত্তিতে। তারা চায় এ দেশে কেউ বেকার থাকবে না, সবার কর্মসংস্থান হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। সবাই আত্মসম্মান আর আপন মহিমায় বাঁচবে। চেয়ে-চিন্তে নয়। তাহলেই যে সংগ্রাম আর ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে তা অক্ষুণ্ন থাকবে। শহীদের আত্মা শান্তি পাবে।

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্ম সচিব

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর