বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

রানি ক্যাথেরিন ব্রাগানজা ও চা পানের ইতিহাস

সাইফুর রহমান

রানি ক্যাথেরিন ব্রাগানজা ও চা পানের ইতিহাস

১৬৬২ সালের ১৪ মে ঝকঝকে রৌদ্রের পড়ন্ত এক বিকাল। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন একজন রমণীর জন্য-যিনি শিগগিরই হতে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রানি বা কুইন। তিনি বিশেষ দূত মারফত আগেভাগেই খবর পেয়েছেন, আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজদরবারে পদার্পণ করবেন পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথেরিন ব্রাগানজা। রাজা চার্লস ক্যাথেরিনকে দেখতে এতটাই ব্যাকুল হয়ে আছেন যে, তিনি যেন নিজেকে আর কিছুতেই ধরে রাখতে পারছেন না। যদিও লোকমুখে তিনি জানতে পেরেছেন যে, ক্যাথেরিন দেখতে অতীব সুন্দরী ও একজন বিদূষী নারী। তার পরও তিনি মুখিয়ে আছেন রাজকুমারীর মুখ দর্শনের জন্য। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাজকুমারীর শুভাগমনে রাজদরবার প্রাঙ্গণ বাদ্য-বাজনার ঐশ্বরিক সুর মূর্ছনার ঝঙ্কারে চারপাশ আমোদিত হয়ে উঠল। রাজা বিলক্ষণ বুঝলেন এই সুর মূর্ছনার যথার্থ কারণ। রাজদরবারের অন্যান্য সভাসদ ও রাজ আমর্ত্যরাও সচেতন ও সটান দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ রইলেন আগত রাজকুমারীর জন্য। ক্যাথেরিন রাজদরবারে প্রবেশ করেই মাথাটি ঈষৎ ন্যুব্জ করে রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন ও অভিবাদন জানালেন। রাজা চার্লসও দাঁড়িয়ে রাজকুমারীর উদ্দেশে তার শুভেচ্ছা ও আন্তরিকতা প্রকাশ করলেন। চার্লস এবার রানিকে জিজ্ঞেস করলেন যাত্রাপথের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে তিনি কী ধরনের পানীয় পান করতে ইচ্ছুক? রানি কিছুটা লাজুক কিন্তু সপ্রতিভ ভঙ্গিতে রাজাকে বললেন, আমার আপাতত এক গেলাস (কারণ তখনো পর্যন্ত পেয়ালায় চা পানের সংস্কৃতি চালু হয়নি) চা হলেই চলবে।

শুধু রাজা চার্লসই নয়, রাজদরবারে সব উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও অতিথিরা অবাক হলেন। কারণ চা পানীয়টি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত তারা যৎসামান্যই অবগত। বিশেষ করে রাজা চার্লস মনেও করতে পারলেন না চা বস্তুটি তিনি জীবনে আদৌ দেখেছেন কি না? ইতোমধ্যে একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী রাজার কানে ফিসফিস করে কী যেন বললেন। রাজা এবার রাজকুমারী ক্যাথেরিনকে বললেন-আমরা দুঃখিত সম্রাজ্ঞী। আমাদের এখানে চা পানীয়টির একেবারেই প্রচলন নেই। আপনি আপনার ক্লান্তি দূর করতে এক গেলাস উৎকৃষ্ট বিয়ার পান করতে পারেন। এই হলো ইংল্যান্ডে প্রথম চা প্রচলন কাহিনি। সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন ব্রাগানজা ইংল্যান্ডে অনেক ভালো ভালো জিনিস প্রবর্তন করেছিলেন। ইংল্যান্ডে চায়ের প্রচলন তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যদিও জাপানি লেখক কাকুজো ওকাকুরা আমাদের জানিয়েছেন, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই প্রথম প্রতিষ্ঠান যে কি না ইউরোপে চা প্রচলন করেছিল।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এই তথ্যকে সমর্থন করি না। আমি মনে করি, পর্তুগিজরাই প্রথম ভারত, চীন ও জাপানে এসেছিলেন। তারাই সম্ভবত প্রথম ভারত কিংবা চীন থেকে চা আমদানি করেছিলেন ইউরোপে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামাই প্রথম ব্যক্তি যিনি ভারত থেকে চা ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ দার্জিলিং ও আসামে চা উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে কেরালাতেও সেই প্রাচীন যুগেও চায়ের বাগান ছিল। আর ভারতে অতি প্রাচীনকালেই যে চা জন্মাত আমার তার প্রমাণ পাই রামায়ণে। রামায়ণে চা গাছের উল্লেখ আছে, তবে তখন হয়তো এভাবে চা পান করা হতো না। চা গাছ ব্যবহৃত হতো ঔষধি গাছ হিসেবে। চা ফরাসিরা চিনেছিল ১৬৩৫ সালে। চা রাশিয়ায় পৌঁছল ১৬৩৮ সালে। ইংরেজরা চাকে স্বাগত জানাল ১৬৫০ সালে। আর তার প্রশস্তি গাইল এই বলে, ‘সকল চিকিৎসকের ছাড়পত্র পাওয়া এই সেই অপূর্ব চৈনিক নির্যাস। চীনারা যাকে বলে চা, আর পর্তুগিজ ভাষায় সেটিকে বলে তে এবং ইংরেজরা বলে টি।’

পৃথিবীতে চা পানের সূত্রপাত কীভাবে ঘটেছিল সে বিষয়ে চীন দেশটিতে এমটি মিথ ও কিংবদন্তি চালু আছে। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩৭ সালের দিকে চীনের বিখ্যাত সম্রাট শেনং যিনি চীনা ওষুধ ও কৃষিক্ষেত্রে বিপুল বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। তিনি একবার জনগণের উদ্দেশে একটি ফরমান জারি করলেন যে, শরীর সুস্থ ও ভালো রাখতে তার রাজ্যের প্রজারা দিনে অন্তত এক পেয়ালা করে গরম পানি পান করবেন। সন্দেহ নেই রাজা শেনং নিজেও সেই অনুশাসন মেনে চলতেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। এক দিন ঝড়ো বাতাসে দূরের চা গাছ থেকে কয়েকটি পাতা উড়ে এসে পড়ল রাজার গরম পানির পেয়ালায়। অমনি সেই পানির রং, স্বাদ ও গন্ধ গেল সম্পূর্ণ বদলে। রাজা শেনং অভিভূত হলেন সেই পানীয় পান করে। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত পান করতে শুরু করলেন সেই চায়ের পাতাযুক্ত পানীয়। পরে অবশ্য চা নানা রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। দুধ সহযোগে হালকা তামাটে রঙের চায়ের প্রচলন সম্ভবত ইউরোপিয়ানদের হাতেই হয়েছিল ১৬০০ শতকের দিকে। পাঠকবৃন্দের মনে হয়তো একটি প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে যে, এত গুরুগম্ভীর বিষয় থাকতে চায়ের মতো এমন একটি তরল ও লঘু বিষয় নিয়ে লিখতে কেন আগ্রহী হলাম সেটা একটু বলি- প্রথমত, মাঝেমধ্যেই নোয়াম নমস্কি, মিশেল ফুকো, জ্যাক দেরিদা প্রমুখ ব্যক্তির গুরুগম্ভীর ও খটমটে লেখাগুলো পড়তে পড়তে, মাথাটি যখন একেবারে ধরে ও এলোমেলো হয়ে যায় (আমি একজন বহুযুগের গ্রন্থ ভক্ষণকারী উইপোকা। তারপরও বেশির ভাগ সময়ই এসব বইয়ের বিষয়বস্তুর অনেক কিছুতেই দন্তস্ফুট করতে পারি না) তখনই হাতে তুলে নিই কিছু লঘু ধরনের বই, যেমন- ‘কী খাবেন, কেন খাবেন?’ ‘রঙ্গপ্রিয় বিদ্যাসাগর’ ইত্যাদি টাইপের বই। ঠিক এমনিভাবে একবার হাতে তুলে নিলাম জাপানি লেখক কাকুজো ওকাকুরা প্রণীত ‘চা চরিত’ বইটি। কিন্তু বইটির কয়েকটি পাতা উল্টোনোর পর মাথাটা যেন পুনরায় ধরে গেল। বইটি ছুড়ে ফেলে দিলাম সেলফের এক কোণায়। মনে মনে ভাবলাম এতদিন বিভিন্ন বইপত্র পড়তে গিয়ে চা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি এবং স্মৃতিতে যতটুকু ধরে রেখেছি সেখান থেকেই লিখব চায়ের ওপর একটি নিবন্ধ। এ ছাড়াও লেখাটি লিখতে প্রলুব্ধ হলাম আরও একটি কারণে। গত ২১ মে ছিল আন্তর্জাতিক চা দিবস, তো সেই দিবস উপলক্ষে আমার এক ব্যারিস্টার মেয়ে বন্ধু তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- আজরাইল যদি মৃত্যুর আগে জিজ্ঞেস করে জীবনের শেষ ইচ্ছে কী? তখন অম্লান বদনে বলব- এক কাপ কড়া লিকারের দুধ চা খেয়ে মরতে চাই। আমার সেই বন্ধুটির বসবাস যদিও চট্টগ্রামে কিন্তু লেখালেখির শুরুতে তিনি আমাকে বিস্তর উৎসাহ জোগাতেন। এ লেখাটি তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যরে-ই নিদর্শন।

মনে পড়ছে, ফরাসি বিশ্ববিখ্যাত লেখক মার্সেল প্রস্তের কথা। আত্মস্মৃতিমূলক কালজয়ী ফরাসি উপন্যাস ‘হারানো সময়ের খোঁজে’-এর প্রথম খণ্ডে এক জায়গায় প্রস্ত বলেছেন, কীভাবে এক দিন তিনি চায়ে এক টুকরো কেক ডুবিয়ে খেতে গিয়ে তার মন অপ্রত্যাশিতভাবে বাল্যকালে গ্রামের জীবনের অনুরূপ স্মৃতিতে আবিষ্ট হলো এবং কালক্রমে তিনি লিখে ফেললেন পাঁচ খণ্ডের ঢাউস সাইজের এক কালজয়ী উপন্যাস।

আরেক শ্রুতকীর্ত ফরাসি লেখক বালজাক ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রমাণ সাইজের মগে কফি পান না করে কোনো লেখা শুরুই করতে পারতেন না। সূর্য অস্তমিত যেতে না যেতেই ঘুমিয়ে পড়তেন বালজাক। রাত ১১টা কিংবা ১২টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠেই একটি বৃহৎ পেয়ালায় ল্যাটিন আমেরিকান থেকে আমদানিকৃত অতি উৎকৃষ্ট জাতের কফি পান করতেন। তারপর শুরু করতেন লেখালেখি। ইংরেজ লেখক অস্কার ওয়াইল্ড যেমন অতি দামি ও দুষ্প্রাপ্য সব পোশাক-পরিচ্ছদ কিনে দেউলিয়া হয়েছিলেন-ঠিক তেমনি বালজাকও অনেকটাই ফতুর হয়েছিলেন দামি কফি পান করতে গিয়ে। আর সেসব কথাই তিনি লিখেছেন তার- ‘দ্য প্লেজার অ্যান্ড পেইনস অব কফি’ অর্থাৎ ‘কফি পানের আনন্দ ও বেদনা’ নামক নিবন্ধে। পাঠকবৃন্দ শুনে অবাক হবেন যে, আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে চা। ১৭৭০ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেন থেকে চায়ের ওপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু তাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আমেরিকাতে কিন্তু চায়ের ওপর শুল্ক ঠিকই বহাল থাকে। যেহেতু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকার কোনো সংসদ সদস্য থাকার সুযোগ ছিল না- তাই তারা পার্লামেন্টে এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদও করতে পারলেন না। বরং তারা প্রতিবাদ করলেন অন্য একটি উপায়ে। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও সত্যি যে, আমাদের যেদিন বিজয় দিবস অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সালটি যদিও ১৭৭০-বস্টন নৌবন্দরে তিনটি চা-বোঝাই জাহাজ থেকে আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষ সমস্ত চায়ের পেটি ছুড়ে ফেলে দিলেন সাগরে। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল আমেরিকার স্বাধীন অর্জনের সংগ্রাম। অন্যদিকে এক আরব পর্যটকের বর্ণনা- ৮৭৯ সালের দিকে চীনের ক্যান্টন শহরের প্রধান আয়ের উৎস ছিল লবণ এবং চায়ের ওপর ধার্যকৃত শুল্ক। মার্কো পোলো তার বইতে লিখেছেন ১২৮৫ সালে বেপরোয়াভাবে চায়ের শুল্ক বাড়ানোর অপরাধে এক চৈনিক অর্থমন্ত্রীর পদচ্যুতির কথা। চা সংস্কৃতির প্রথমদিকে চায়ের দাম ছিল বেশ বেশি। পাউন্ডপ্রতি প্রায় ১৫-১৬ শিলিং, তাই সবার নাগালের মধ্যে ছিল না এই মহার্ঘ পদটি; এ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন আমিরি চালের প্রতীক হোমড়া চোমড়া আর রাজকন্যাদের জন্য কোনো দামি উপঢৌকন। তবু এত সব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও চা খাওয়া বেশ চমৎকার বেগেই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। আঠারো শতকের প্রথমার্ধে লন্ডনের কফি হাউসগুলো যেন হয়ে উঠল আসলে চায়ের আড্ডা। এডিসন আর স্টিলের মতোন বিদগ্ধ রসিকদের আখড়া। লেখক-সাহিত্যিক কবিরাও জড়ো হতেন সেই কফি শপে। তাদের মধ্যে কে নেই জর্জ বার্নার্ড শ, ওয়েলস, চার্লসল্যাম। তারা যেন চায়ের পত্তরে রসদ পেতেন লেখার উপকরণ কিংবা চিত্তবিনোদনের। অন্যদিকে প্যারিসের ক্যাফেগুলোতেও বসত লেখক-সাহিত্যিকদের আসর। বিখ্যাত ফরাসি লেখক জ্যাঁ পল সার্ত্র অনেকটা সময় ব্যয় করতেন ক্যাফেতে বসে লিখে। অন্যদিকে ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে শত সহস্র ঘণ্টা ব্যয় করেছেন কফি শপে। প্রচণ্ড শীতে কফি ও গরমের সময় ঠান্ডা বিয়ার পান করে লিখতেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের কফি হাউসের কথাও বিখ্যাত ও সুবেদিত- আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও শরৎ উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত সাহিত্য আন্দোলনটি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার কফি হাউস। কে নেই সেই আড্ডায়। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ মুজতবা আলী, কমলকুমার মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী আরও কত শত নাম। তবে সবচেয়ে কনিষ্ঠ লেখক হিসেবে সেখানে থাকতেন আমার অতি প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম চা পান করেছিলেন জ্ঞান তাপস অতীশ দীপঙ্কর। সম্ভবত ১০২০ সালে তিনি তিব্বত ভ্রমণ করার সময় চা পান করেছিলেন। এ তথ্যটি আমাকে জানিয়েছেন আমার এক অগ্রজ ও একনিষ্ঠ পাঠক খাজা ওয়াল্লিউল্লাহ মাসুদ। আঠারো শ শতকের দিকে ব্রিটিশরা আমাদের চা পানে উৎসাহ জোগাতে বিনা পয়সায় চা খাওয়াতেন। সে উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে একটি বিজ্ঞাপন এই তো বেশ কিছুদিন আগেও আমি দেখেছি- ‘চা পানে নাহি দোষ, চা করে চিত্ত পরিতোষ।’ এবার একটু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চা পানের প্রসঙ্গে আসি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সকালে উঠে তার বিশ্বস্ত বনমালীর হাতে তৈরি এক কাপ চা পান না করে লিখতে পারতেন না। এই প্রিয় ভৃত্য বনমালীকে নিয়েই তিনি লিখেছেন ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতাখানি। কবি রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিলেন ৭ আগস্ট, ১৯৪১, ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ মৃত্যুর দুই দিন আগে অর্থাৎ ৪ আগস্ট কবি ফিডিং কাপ থেকে সামান্য কফি খেয়েছিলেন। এই কফিটুকুই তার শেষ খাওয়া। এরপর তিনি আর কিছুই খাননি। এই মুহূর্তে আমার আরেক বিখ্যাত কবির কথা মনে পড়ছে- তার নাম বুদ্ধদেব বসু। ১৯৭৪ সালের কোনো এক রবিবার সন্ধ্যায় তিনি চা পান করছিলেন তার খানিক পরেই স্ট্রোক, সঙ্গে সঙ্গেই সংজ্ঞালুপ্তি। মৃত্যুর কারণ সেরিব্রেল থ্রমবোসিস। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডায়মন্ড হারবার রোডের ক্যালকাটা হাসপাতালে। সেখানে রাত পৌনে ৩টা নাগাদ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি নজরুলের চা খাওয়ার একটি কাহিনি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। এ ঘটনাটি আমি পড়েছিলাম কবি জসীমউদ্দীনের ‘ঠাকুর বাড়ির আঙ্গিনায়’ নামক বইটিতে।

“রাত্রিবেলা এক মুশকিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠিলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া যে চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিকালে কে সাহস করিয়া এত বড়ো পদ্মা নদী পাড়ি দিবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠানো হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েকটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন।গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া তাজ্জব বানাইয়া দিবার জন্য কলিকাতা হইতে তিনি কিছু চা-পাতা লইয়া আসিয়াছিলেন। গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা-পাতা যখন কম হইয়া আসিত, তখন তাহার সহিত কিছু শুকনা ঘাসপাতা মিশাইয়া চায়ের ভাণ্ডার তিনি অফুরন্ত রাখিতেন। তিনি অতি গর্বের সহিত তাহার কলিকাতা-ভ্রমণের আশ্চর্য কাহিনী বলিতে বলিতে সেই চা-পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ। এই মহামূল্য চা এখন কে জ্বাল দিবে? এ বাড়ির বড় বউ ও বাড়ির ছোট বউ সকলে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যাহার যত রন্ধনবিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া সেই অপূর্ব চা-রন্ধন-পর্ব সমাধা করিল।”

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর