রবিবার, ১১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইদানীং করোনা কোথায়?

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ইদানীং করোনা কোথায়?

শাহ আমানত বিমানবন্দরে ঢাকাগামী আকাশতরীর জন্য অপেক্ষা করছি গণভিআইপি লাউঞ্জে। ভিআইপি লাউঞ্জটি ‘বর্তমান’ মহোদয়গণের জন্য। সেখানে সালামও লম্বা, যত্ন-আত্তিও। যারা ‘সাবেক’ তারা ছোট সালাম পেয়ে থাকেন, তাদের সঙ্গে এ গণভিআইপি লাউঞ্জে আরও আসেন অনেক ‘আমি অমুক-তমুক’ টাইপের পাতিনেতা। যা হোক, আমি একা বিরসবদনে বিলম্বিত ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছি। ফ্লাইট ধরার জন্য খুলসী রেস্ট হাউস থেকে সেই ভোরে যাত্রা করে আমার শাহ আমানতে পৌঁছানো। ঢাকা থেকে ফ্লাইট ছাড়তে দেরি করছে কী যেন কী কারণে। শাহ আমানতের আকাশ ঝলমলে। সোফায় হেলান দিয়ে একটু তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলুম- মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর এ ধরনের গানের সুর বাজাতে বাজাতে এলো এলোকেশী রুক্ষ অথচ সৌম্যকান্তি একজন। মনে হলো চিনি তাকে। কিন্তু মনে করতে পারছি না। চিনতে দেরি তো হবেই। ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে বাজালেন আরেকটি গান (আমার বেশ প্রিয়) ‘তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম’। আমি বললাম ধরা দিচ্ছেন না কেন? সে বলল, ‘করোনা ধরা দিলে তো আপনার পিলে চমকাবে! কেননা বুস্টার ডোজ নিয়ে আমাকে তাড়িয়েছেন ভেবে আপনার দেহতরীতে চেক ইন করি কেমনে?’ ওঃ এতক্ষণে চিনলাম এবং বুঝলাম ইনি করোনা কভিড-১৯-এর স্বপ্নবিলাস। মনে পড়ছে লাদাখ সীমান্তে সৈন্যসামন্ত জড়ো করে চীন ভারতকে যখন টানটান উত্তেজনায় নিয়ে এসেছে তখন সিমলায় শান্তিসংলাপের সুযোগ সমুপস্থিত হয়। সে প্রায় আড়াই বছর আগের কথা। সেবার সিমলা এয়ারপোর্টে করোনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। দেখা থেকে কত কথা। পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এক নিমেষে পড়ে শেষ করেছিলেন আমার এক সুহৃদ।

এখন আমার সামনে সে দাঁড়িয়ে। লাবণ্য নেই কিন্তু স্নিগ্ধতা আছে, কর্কশ কণ্ঠে মোলায়েম সুরের পালে বাতাস লাগার মতো মিয়া তানসেনের তানপুরায় তাল ধরার মতো তাল লয় সব ঠিক আছে। কুশল বিনিময় হলো। প্রথমেই এপোলেজিটিক করোনা। আপনাদের বছর দুই বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিলাম। আপনারা আমাকে নিয়ে রাজনীতির খেল কম দেখালেন না। ব্যবসাপাতিও কম করলেন না। রাজনীতি, ভূরাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগে আর আপনাদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে আমি কেন দাবার ঘুঁটি হলেম তা ভাবলে অবাক হই। ভূরাজনীতির ভায়রাভাইদের তো দেখলাম এখন অস্ত্রে শান দিচ্ছে, কামান দাগছে ইউক্রেন আর রাশিয়ায়। পুতিন সাহেবের সঙ্গে সেদিন মধ্যাহ্নভোজের টেবিলে আলাপ হচ্ছিল পুতিন-জেলেনস্কি দুজনেই বোঝেন তাদের কাজটা ভালো হচ্ছে না। কিন্তু পুতুল খেলার শেষ অঙ্কে পৌঁছাতে মনে হয় দুজনই ধাঁধার মধ্যে আছেন। হঠাৎ ফিক করে হাসি দিয়ে জানালেন, জানেন সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তি যে বলেছিল এপ্রিলে গরম শুরু হলে করোনা পালাবে। তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। যাক, সবচেয়ে বড় খবর হলো আজ তেনাকে জেলে পুরেছেন সে দেশের বিচারকম লি। সে দেশের সাবেক কোনো ক্ষমতাধরের এই প্রথম শ্রীঘরে পদার্পণ! মাইলস্টোনরূপী ঘটনা, নয় কি? তার খায়েশ আবার খাড়াবেন। আমার কোনো মন্তব্য নেই। দেখছেন না চীনা প্রেসিডেন্ট পুতিনের রাজপ্রাসাদে। কলির আকাল আর কি? যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা অনেক আগে থেকে চলছিল। কিন্তু আমার আগমনে যুদ্ধবাজরা বিশ্বায়নে বিভক্ত, মুক্তবাজতন্ত্রীরা কেমন যেন চুপসে যাচ্ছিল। আমাদের ফাইনাল রিপোর্ট দেখা হলো না। বারবার ভোল পাল্টাচ্ছে করোনার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর। কীসব বাহারি নাম তাদের। জানলুম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমি আর নেই মর্মে ঘোষণা দিয়েছে। আপনাদের সব বিমানবন্দরে করোনা সনদ পরীক্ষা বা প্রশ্ন আর করতে হবে না। এবার করোনা মনে হয় একটু সিরিয়াস হয়ে বলতে শুরু করল।

আমাকে ঠেকানোর জন্য, আমার থেকে বাঁচার জন্য আপনাদের দেশগুলোর সরকারেরা যেখানে যেভাবে পেরেছে (হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় সাপেক্ষে) ভ্যাকসিন জোগাড় করে জনগণকে ‘ফ্রি’ দিয়েছে। নকল করার সময় পাওয়া যায়নি। যদিও পরিস্থিতি ততটা খারাপ হয়নি। ভ্যাকসিনগুলো কায়েমি সিন্ডিকেট বা ব্যবসায়ীদের জন্য প্রচুর পয়সা বানানোর উপায়-উপলক্ষ হয়ে দাঁড়াল। অনেককেই তিনটা অর্থাৎ বুস্টার ডোজও দেওয়া হলো, তারাও হাউস করে তা নিলেনও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তা ভাই কী হয়েছে? বুস্টার তো আমিও নিয়েছি।

প্রথমটা এস্টারজনিকা, দ্বিতীয়টা ফাইজার এবং তৃতীয়টা মডার্না। প্রতিবার ধারণা দেওয়া হয়েছে এ যৌতুক আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে। ‘বুঝেছি, এটা করোনাকে ঠেকানোর জন্য যতটা না ছিল, তার চাইতে এটা ছিল কেনাকাটার ফাইল হারিয়ে হলেও ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক ফায়দার জন্য। আমি করোনা এখন বেশ রিল্যাক্সড। তবে একটা কথা না জানিয়ে পারছি না। করোনার ভ্যাকসিন আপনার বা আপনাদের শরীরে এমন একটা ভাবসংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে যে, এ ভ্যাকসিন আপনাদের শরীরে অন্য ওষুধ সহজে গ্রহণ করতে দিচ্ছে না। আমি করোনা নিজে মেডিকেল কারসাজি কম বুঝি, তবে এটা বুঝি বেশি/দামি পাহারাদার খুচরা চোরেরা ধরতে পারে না, খুচরা চোরেরা একবার ঘরে ঢুকলে সহজে বের হতে চায় না। এখন কারও সর্দিকাশি হলে লক্ষ করবেন সহজে সারতে চাচ্ছে না। সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। বললাম, ‘করোনা তুমি এভাবে আমাদের আর কষ্ট দেবে? শুনছি তুমি ইতোমধ্যে আবার নতুন করে আমাদের প্রতিবেশী দেশে আসার চেষ্টা নিচ্ছ, এটা কি ঠিক। একমাত্র কথা বলার মতো বিরোধী এক নেতাকে তুমি নাকি আবার আক্রমণ করেছ।’ করোনা পেশাদার কূটনীতিকের মতো জবাব দিল- ‘আমার বক্তব্যকে এখনকার ভিসা বিতর্কের মতো ভাববেন না, ভোল পাল্টিয়ে ভিন্নতর কিছু করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। আমাদের পলিটব্যুরো সম্প্রতি পরীক্ষা পর্যালোচনায় দেখেছে যে, যে উদ্দেশ্যে অতিমারি হিসেবে আমার আবির্ভাব হয়েছিল তার তেমন কিছু অর্জিত হয়নি। আমার সুশীল আচরণকে ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়ে সবাইকে ভয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে অনেকে নানান ধান্দায় টাকা বানিয়েছে।’ করোনা এ পর্যায়ে হঠাৎ বিরসবদনে, শোক প্রকাশ করার মতো, করোনার প্রথম পর্যায়ে দ্রুত করোনা শনাক্তকরণ, গণ ও স্বল্পমূল্যে চিকিৎসার পথ বাতলিয়েছিলেন তার কথা তুলল, সম্প্রতি তার মৃত্যুর খবর করোনার অজানা নয় দেখে বিস্মিত হলুম।

করোনা বিজ্ঞজনের মতো বলতে থাকল- ‘আগের অতিমারির ১৭২০ (প্লেগ), ১৮২০ (কলেরা), ১৯২০ (স্প্যানিশ ফ্লু) মতো, ২০২০ সালে এবারও আমার প্রত্যাশা ছিল সবাই মানবিক হবেন, সামাজিক অধঃগতিতে সম্মান ও সৌহার্দ্য গড়ে উঠবে, আত্মসমালোচনার মধ্যে দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে, আপনারা বুঝতে পারবেন আপনাদের কোন কোন অপকর্মের প্রতিফল হিসেবে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, মানব জাতি কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু গত দুই-আড়াই বছরে এত ধাক্কা দিয়েও আপনাদের সেই উপলব্ধির স্তরে গঠনমূলক কিছু কি করতে পেরেছি? এখন মনে হচ্ছে, না, পারিনি। আমাকে মোকাবিলায় ফিফথ স্ট্যান্ড করায় আত্মবিশ্লেষণের পরিবর্তে আত্মশ্লাঘা দেখছি।’ আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার জন্য আমরা সবাই এখন এক ধরনের আত্মভোলা (ডিমেনশিয়া) রোগে আক্রান্ত হয়েছি। তবে হ্যাঁ এখন মহিলারা মাস্ক পরেন, তারা বুঝেছেন হিজাব পরার মতো মাস্ক তাদের মর্যাদাবান করছে। দুই হাত ধোয়াকে অভ্যাস হিসেবে রেখেছেন অনেকেই, জুম বা অনলাইনে মিটিং করার চল ক্রমে বাড়ছে। ফিজিক্যালি দেখাসাক্ষাতের সামাজিক মূল্য আছে সত্য কিন্তু পিঠ চুলকানিও তো চলে দেখা হলে, মিটিংয়ের ভ্যালু এডিশন তেমন নেই। অথচ অনলাইন মিটিং পরিচালনা সহজ এবং একসঙ্গে দেশবিদেশের মেহমানের অংশগ্রহণ করানো যায়।’ করোনা বলল, ‘দেখছেন আগের দোষগুলো সবই আছে, কিছুটা উন্নতি হলেও হচ্ছে।

আমার বড় ভয় পারমাণবিক যুদ্ধ আপনারা বাধিয়ে ছাড়বেন। তাইওয়ানের বড় মহোদয়া মার্কিন একজন কর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তাতেই চীন তাইওয়ানের লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। আপনারা শুধু আমার দোষটা দেখলেন নিজেদেরটা তো দেখলেন না। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে নিজেরা সমস্যা তৈরি করে দোষটা-দায়টা করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর চাপানো!! আপনাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমি নাকি ব্যাঘাত ঘটিয়েছি, আমি এসব ব্যাপারে বেশি কিছু বলব না। সময় সব বলে দেবে।’ এ সময় প্লেনে আসন নেওয়ার ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমার তন্দ্রাও গেল, করোনাও কোথায় জানি হাওয়া হয়ে গেল।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর