সোমবার, ১২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

সবাই যা চায় তা কেউ চায় না

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

সবাই যা চায় তা কেউ চায় না

আমরা সবাই শান্তি চাই। তাহলে অশান্তি আসে কোথা থেকে। প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করা অতি সহজ, কিন্তু নিজেদের ত্রুটি চিহ্নিত করা অনেক কঠিন কাজ। যারা সেটা পারে তারা নিজেদের শক্তিশালী করে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী করতে পেরেছিলেন বলেই বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা হয়েছিল বলেই প্রথমে রাজনৈতিক বিজয় এবং সে পথ ধরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি সামরিক বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়।  যদি দলকে সুসংগঠিত এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিতে না পারতেন তাহলে শুধু পাকিস্তানকে দোষারোপের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হতো না। সম্প্রতি গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা আজমত উল্লা নৌকা মার্কা নিয়ে হেরে যাওয়ার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণ হয়েছে, আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ, অন্য কারও প্রয়োজন নেই। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ১৬ হাজার ১৯৩ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন। কেন্দ্রভিত্তিক ভোট প্রদান ও তার ফলের যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যায় নৌকার নিশ্চিত বড় একাংশ ভোটার কেন্দ্রে আসেনি, বাড়িতে বসেছিল। প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৪১.৫৫ ভাগ ভোট পেয়েছেন আজমত উল্লা। যে কোনো নির্বাচনে এই হারে প্রাপ্ত ভোটে প্রার্থীর জয়ী হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা থাকে। গাজীপুরের নির্বাচনে যদি শতকরা ৭০ ভাগ ভোট পড়ত তাহলে শতকরা ৪১.৫৫ ভাগ ভোট প্রাপ্তিতেই আজমত উল্লা জিতে যেতেন। তাতে তার প্রাপ্ত ভোটের মোট সংখ্যা হতো ৪ লাখ ৯০ হাজার ৬৬। উপরোক্ত সংখ্যা থেকে আজমত উল্লার প্রাপ্ত ভোট বিয়োগ করলে দেখা যায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৩২৯ জন আওয়ামী লীগের নিশ্চিত ভোটার ভোট কেন্দ্রে আসেনি। কেন তারা আসেনি, এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গত ৬ জুন প্রায় সব পত্রিকায় দেখলাম, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও আজমত উল্লার উপস্থিতিতে পরাজয়-উত্তর মূল্যায়ন সভায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে চেয়ার ছোড়াছুড়ি করেছেন এবং তাতে কয়েকজন আহত হয়েছেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, গাজীপুর আওয়ামী লীগের কী অবস্থা। নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য, শ্রদ্ধা ও শৃঙ্খলাবোধ না থাকলে যা হয় গাজীপুরে সেটাই হয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা এমন কেন, তার সঠিক কারণ দলের সিনিয়র নেতারা নিশ্চয় জানেন। আমরা যেহেতু তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিচার-বিশ্লেষণ করি, তাই এ প্রসঙ্গে বহুল পঠিত দুটি পত্রিকার দুটি শিরোনাম এখানে তুলে ধরছি। ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘ওরা সবাই এখন আওয়ামী লীগ, জেলা, উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত ও ফ্রীডম পার্টির লোকজন যোগ দিয়েই পদ বাগিয়েছে।’ এর প্রায় দেড় বছর আগে ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘জামায়াত-শিবির থেকে আওয়ামী লীগে পদধারী।’ দুই পত্রিকার দুটি প্রতিবেদনে জেলা-উপজেলা উল্লেখপূর্বক নামধামসহ দেখানো হয়েছে। কারা কোথায় কী কী পদ বাগিয়ে নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, দুই পত্রিকার মাত্র দুটি প্রতিবেদনে দেশব্যাপী দলের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছে তা নয়, এখানে কয়েকটি মাত্র জেলা-উপজেলার নাম আছে। তার মানে এই নয় যে, এর বাইরে অন্যান্য জায়গায় এটা ঘটেনি। আবার সব জেলায়ই এরকম ঘটনা ঘটেছে সেটাও হয়তো নয়। অন্যান্য দল থেকে নেতা-কর্মীরা এসে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে দলের শক্তি বৃদ্ধি পায় এ কথা যেমন ঠিক, তেমনি এর বিপরীত যে হবে না, তার নিশ্চয়তা খুবই কম। কে নিজের উপলব্ধির পরিবর্তন ঘটিয়ে নীতি-আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আর কে নিজের বিগত সময়ের অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয় নিয়েছেন, অথবা কারা সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়ার জন্য এসেছেন তা নির্ণয় করা বাংলাদেশের বাস্তবতায় খুবই কঠিন কাজ। যুগে যুগে দেখা গেছে, শত্রুপক্ষের চর পরিকল্পিতভাবে যে কোনো ছদ্মবেশে ভিতরে ঢুকে যায় এবং সময় হলেই তারা ঘরের শত্রুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তাই ইতিহাসের শিক্ষা হলো, নবাগতদের প্রথমেই নেতৃত্বের স্থান দিতে নেই। তাদের আসল স্বরূপ বোঝার জন্য একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে, দলের যে কোনো একটি দুঃসময়ে তাদের ভূমিকা মূল্যায়ন করার পরই কেবল নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকলে পদ-পদবি পেতে পারে। এখন প্রায়ই শোনা যায়, গত ১৪-১৫ বছরে বিভিন্ন সময়ে অনেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই বড় নেতা, এমপি, মন্ত্রী হয়ে গেছেন এবং ক্ষমতা হাতে পেয়েই এলাকায় দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া নেতা-কর্মীদের শুধু উপেক্ষা নয়, কোণঠাসা ও নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছেন। ক্রাইসিস হলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ঋতুভিত্তিক নেতা, এমপি, মন্ত্রীরা এলাকায় যেতে পারবেন না, যাবেনও না। আর পোড় খাওয়া স্থানীয় নেতা-কর্মীরা দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকাতে ঘরে বসে সবকিছু দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারবেন না। তবে দুই সামরিক শাসকের হাত ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে বিনষ্ট ও কলুষিত হয়েছে তা থেকে এখনো রাজনীতি মুক্ত না হওয়ায় শুধু নীতি-আদর্শের ওপর অটল থেকে নির্বাচনে জয় পাওয়াটাও এখন কঠিন কাজ হয়ে গেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হেরে যাওয়াটা এক কঠিন বাস্তব শিক্ষা। বাস্তবতা ও নীতি-আদর্শের দ্বন্দ্ব এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে সবাই যা চায় তা কেউ চায় না, চাইতে পারে না। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মতিউর রহমান নিজামীর মতো ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী এবং গণহত্যাকারী যখন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে পবিত্র সংসদকে অপবিত্র করে তখন সেই নির্বাচনের কোনো পবিত্রতা থাকে না বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোনো অর্থ থাকে না। যে বড় দলের ঘাড়ে চড়ে এহেন যুদ্ধাপরাধীরা মহান জাতীয় সংসদের পবিত্রতা নষ্ট করেছে সেই দল যখন গণতন্ত্র আর সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে তখন বুঝতে হবে যা মুখে চাওয়া হচ্ছে সেটি তারা বাস্তবে চায় না। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে আওয়ামী লীগ বলছে, তারা জাতিসংঘের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায়। আলোচনা, সমঝোতা ভালো কথা, এর বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না। কিন্তু শেকড় কাটা গাছের মাথায় পানি ঢেলে গাছকে জীবিত করা যাবে কি? যারা জাতির পিতাকে মানে না, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অবজ্ঞা করে, একাত্তরে যুদ্ধজয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার জয় বাংলাকে ছুড়ে ফেলে দেয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত দীর্ঘ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে কবর দেয় এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রণেতা, তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কীভাবে সমঝোতা করবে তা কেবল আওয়ামী লীগই বলতে পারবে। আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে কোনো পথ দেখি না। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে বিএনপিকে সংলাপের জন্য আওয়ামী লীগ আহ্বান জানায়নি, আর জানাবেও না। দেশে-বিদেশে প্রশংসিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কর্তৃক জাতীয় সংসদে সব রকম ডিউ প্রসেস, অর্থাৎ নিয়মনীতি অনুসরণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, কারও এক কথায় বা সামরিক আদেশ দ্বারা সেটা হয়নি। সুতরাং বিএনপির রাজনৈতিক দাবি এখন আওয়ামী লীগ মেনে নেবে কেন। আওয়ামী লীগ কি এমন কোনো দায়ের মধ্যে পড়েছে, দৃশ্যমান তেমন কিছু তো দেখা যায় না। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত যতগুলো উপনির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচন হয়েছে তা নিয়ে কোনো পক্ষ থেকে একটি প্রশ্নও ওঠেনি। তাহলে ২০১৪ সালে কীসের ভিত্তিতে বিএনপি ধরে নিল যে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কোনো ভিত্তি ছিল না। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক তখন বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনের সময় সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবও বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে। তাতে কি প্রমাণ হয় না যে, মুখে সুষ্ঠু নির্বাচন, আর অন্তরে অন্য চিন্তা বা অন্য কথা। বিএনপি কর্তৃক ২০১৪ সালের ভোট বর্জনের আসল কারণ অন্য জায়গায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা, হাওয়া ভবনের দুঃস্মৃতি; সঙ্গে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে একঘরে হয়ে যাওয়া বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে যেভাবে জনগণ কর্তৃক চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয় তাতে ২০১৪ সালে পুনরায় সেরকম আরেকটি বিপর্যয়কর গ্লানি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে। ২০১৪ সালে এসেও পাঁচ বছর আগের বিএনপির দুঃশাসনের দুর্বিষহ স্মৃতি মানুষের মনে দগদগে ক্ষতের মতো জাগ্রত ছিল। বিএনপি নিজেরাও সেটা জানত।

২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে হলেও তার সাংবিধানিক ও আইনগত ভিত্তির কোনো সংকট ছিল না। আন্তর্জাতিকভাবেও সে নির্বাচন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়, যার প্রমাণ ওই সংসদের দুজন সদস্য যথাক্রমে ইন্টারন্যাশনাল পার্লামেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও কমনওয়েলথ পার্লামেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। কিন্তু নেতৃত্ব সংকটের কারণেই বিএনপিকে চরম মূল্য দিতে হয়। এখন তো বিএনপির সিনিয়র নেতারাও প্রকাশ্যে বলছেন, ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করা তাদের জন্য চরম ভুল ছিল। ২০১৮ সালের গ্লানি ঢাকার জন্য বিএনপি অনেক রকম দোষারোপ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে করে থাকে। কিন্তু তার সপক্ষে কোনো রকম প্রমাণ এ পর্যন্ত তারা জনগণের সামনে দেখাতে পারেনি। আর প্রমাণ নেই বলেই সেই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করে একবারও আদালতে যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলীয় চিন্তা ও এজেন্ডা জনগণের নামে চালিয়ে দেয়। ১৭ কোটি জনগণের মধ্যে বিএনপির সমর্থক রয়েছে, তারাও জনগণ। কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কি না সেটাই প্রশ্ন। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলীয় ভোট প্রাপ্তিকে যদি জনসমর্থনের একটা মানদন্ড ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে গড়ে শতকরা হিসাবে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগ অনেক এগিয়ে আছে এসব রেকর্ড এখন সহজেই পাওয়া যায়। সুতরাং বিএনপি যা বলছে সেটাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা, তা বলার কোনো ভিত্তি ও সুযোগ নেই।  তবে কার পাল্লা কতখানি ভারী তা প্রমাণের জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচন সব পক্ষের জন্যই আরেকটি সুযোগ। মুখে এখন সবাই বলছে তারা সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। তাহলে তো আর কোনো সমস্যা নেই। তাই সবাই নির্বাচনে অংশ নিলেই বোঝা যাবে এখন যা সবাই বলছে, সেটা তারা আসলে চায় কি চায় না।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর