মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঝরা পাতার নূপুর

হোসেন আবদুল মান্নান

ঝরা পাতার নূপুর

এবার শিরোনামটি ধার করেছি বাংলা গানের প্রবাদপ্রতিম গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গানের কলি থেকে। এর আগের দুটো শিরোনাম ‘আমি কান পেতে রই’ এবং ‘মম সরসীতে তব উজল প্রভা’ যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গান থেকে নেওয়া হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বেদনা সব সময় ক্ষণিকের, বিস্মৃতিটাই স্থায়ী’। কবি মাত্র ৪১ বছর বয়সে বিপত্নীক হন। তারপর একেক করে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়জনদের হারানোর অসহনীয় ও অব্যক্ত ব্যথা বুকে নিয়েই যাপন করে গিয়েছেন জীবনের সুদীর্ঘ সময়। তাই অনেকে মনে করেন, শোকাবহ জীবন নিয়ে অনেক দিন বেঁচে থাকার এক বিস্ময়কর প্রেরণার নাম রবীন্দ্রনাথ। মানুষের জীবনের দুঃখ-বেদনা নাকি সাময়িক, এটা দীর্ঘস্থায়ী কোনো বিষয় নয়। তবে সত্য হলো, মানুষ জন্মগতভাবে বিস্মৃতিপ্রবণ প্রাণী, সবকিছু দ্রুত ভুলে গিয়ে বাঁচতে চায়। পৃথিবীতে মানুষের জন্য সে এক আশ্চর্য অমোঘ বিধিলিপি। হারানোর শোক-তাপ-হাহাকার একটা সময়ে এসে কমে যায় এবং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই তা হ্রস্ব হয়ে আসে। মানুষের মস্তিষ্কের ভিতরের স্মৃতির কোষগুলো নাকি আগের মতো সক্রিয় থাকে না। তাই ভুলে যাওয়া যেন বাঁচার আরেক নাম। ফলে মানুষ অবলীলায় ফিরে আসতে পারে চলমান জীবনের নিত্য কোলাহলের গহিন ভিতরে।

২. তবে যেন আমি মেনে নিতে পারছি না। আমার কাছে মনে হয় বিস্মৃতিটা স্থায়ী নয়। বরং অতীতের সুখ-দুঃখের স্মৃতিময় মুহূর্তের ডালপালাগুলো ক্রমাগত বিস্তার লাভ করছে। বারবার সামনে নিয়ে আসছে সুদূর অতীতের সাদাকালো দৃশ্যাবলিকে। ১৪ জুন আমার স্ত্রী জেবুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে ছাড়া তিনটি দীর্ঘ বছর চলে গেছে। আমরা কি কোনো এক দিনের জন্য তাঁকে ভুলতে পেরেছি? অন্তত দিনশেষে খাবার টেবিলে একবার হলেও কেউ না কেউ তাঁকে স্মরণ করেই চলেছে। কখনো কখনো মনে হয়, এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। সব আছে, সবাই আছে একজন নেই তবু তাঁর অনুপস্থিতি কত শক্তিমান, কত কার্যকর ও কত অপরিহার্য! মনে হয় ইংরেজিতে একেই বলে Larger than life.

৩. আমি জানি তুমি এখন অদৃশ্য অনন্তলোকের একজন স্থায়ী বাসিন্দা। তবু এবারও তোমার জন্য কিছু তাজা খবর এনে আকাশের লক্ষ কোটি নক্ষত্রের কাছে পাঠিয়ে দিতে চাই। নক্ষত্রগুলো ত্রস্ত ডাক হরকরার মতন ধ্রুবতারাকে খুঁজে ফিরবে, তুমি কিন্তু তা গ্রহণ কোরো, প্লিজ।

শোনো, তোমার চলে যাওয়ার পর আমি আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে আর কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারিনি। অনেকটা অন্যমনস্ক পথিকের মতন প্রতিদিন পথের মাঝে পথ খুঁজে ফিরি। তোমার অদৃশ্য আততায়ী সেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেবল হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় নয়, কর্তৃপক্ষের নজিরবিহীন নিষ্ঠুরাচরণ ও অপশক্তির হস্তক্ষেপের কারণে আমাকে বদলি যেতে হয়েছিল। জীবদ্দশায় তুমি আমার স্থায়ী শত্রু হিসেবে যাদের চিহ্নিত করে গিয়েছিলে এবং আমাকে পুনঃ পুনঃ সতর্ক করেছিলে, তারাই আমাকে হত্যা করার জন্য পুনর্বার আঘাত হানে। আমার ইমেজকে হনন করার চেষ্টা চালায়। এমনকি তোমার সর্বস্ব দিয়ে গ্রামে যে ঘরখানা তৈরি করেছিলে তারা সেটিও গুঁড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছিল। তবে পারেনি, কারণ আমি জীবনের বিনিময়ে এদের প্রতিহত করার সিদ্ধান্তে অনড় ও অটল আছি। মাঝেমধ্যে ভাবি, প্রত্যেক মানুষের জীবৎকালের মধ্যে একটা মাহেন্দ্র সময় থাকে, যা তাকে শিকড় থেকে ক্রমাগত পাদপ্রদীপের আলোয় উপবিষ্ট করে দেয়। এর জন্য সব সময় ক্ষমতা বা অর্থবিত্তের প্রয়োজন হয় না। নিষ্পাপ অজাতশত্রু ধর্মপ্রাণ মানুষের নিঃশব্দ প্রার্থনাই এর জন্য অব্যর্থভাবে কাজ করে; যা এখন আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব এবং বিশ্বাস করি। আর এর বাস্তব প্রমাণ আমার অকালপ্রয়াত মা আর তুমি নিজে। আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে শিখরে আরোহণ করতে দেখেই তুমি আকস্মিক অন্তরালে ডুবে যাও। তুমি চোখের আড়াল হওয়া মানে আমার ক্রমাগত অধোগামিতা, যা কেউ রোধ করতে পারেনি। তোমার প্রস্থানের পর তিনটি বছর ব্যক্তিগত হিসেবে আমি একটাও সুসংবাদের মুখ দেখিনি। ভাবি, তোমার ছায়াকে ঘিরেই আমার সব পার্থিব ভুবন ছিল ঝলমলে আলোকিত।

৪. নটর ডেম কলেজে পড়ুয়া আমাদের সবচেয়ে আদরের ছোট্ট ছেলেটা তোমার কাক্সিক্ষত বিমান বাহিনীতে প্রশিক্ষণরত আছে। মুখে সারাক্ষণ মামণির জপমালা, তার ভবিষ্যতের বিশাল আকাশজুড়ে এখনো তুমিই সূর্যতারা। ছেলেটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অনেক স্বপ্ন দেখে। সে বড় হতে চায়, মানুষের মতো মানুষ হতে চায়। তার মধ্যে সততা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও দেশপ্রেমবোধ প্রবলভাবে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। বাবা হিসেবে আমি খুব গর্ব অনুভব করছি। ছেলেটা কী বলে জানো? বাবা দ্যাখো, একদিন বিমান চালিয়ে মামণির কবরের ওপর দিয়ে স্যালুট জানিয়ে আসব। কবরে থেকেও মামণি নিশ্চয় অনুভব করতে পারবে! যাক, ছেলেমানুষ তো, কী করা বল?

৫. নাতনির পর আজ কয়েক দিন হলো এবার আমাদের নাতি হয়েছে। আমাদের ডাক্তার ছেলে বাবা হয়েছে। বল, কী মজা হতো! আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে জানান দিয়েছি।

তুমি দ্যাখো, কী লিখেছি-

‘আমি দাদা হলাম। জীবন থামতে জানতে না। সে যেন নিরন্তর পূর্ণতার দিকে ধাবমান। কিছু অসমাপ্ত রেখে যাওয়া তার কাজ নয়। সবকিছুকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলাই যে তার ধর্ম। আমাদের বড় ছেলে আদিত্য, আজিমপুর কলোনিতে বেড়ে ওঠা এই তো সেদিনের শিশু। তার অবয়বে আমার ছায়া দেখে শৈশবে যাকে সহকর্মী বন্ধুরা ছোট মান্নান বলে আদর করত। সেও আজ বাবা হয়েছে। উত্তরাধিকারীর পদধ্বনিতে আমার জীবন আজ কানায় কানায় পূর্ণ। একই সঙ্গে আমার এবং আমাদের অনেক পূর্বপুরুষের তালিকায় সদ্য যুক্ত হলেন আরও একজন মহান অতিথি। তাকে স্বাগত। কালের যাত্রায় তার আসন নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ যেন চির বহমান পরম্পরার এক অমোঘ খেলা।

নানা হয়েছি আড়াই বছর আগে। আত্মজার কন্যাকে প্রথম দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলাম। তখন চাকরির খ্যাতি ও জৌলুস ছিল। চারপাশে আত্মীয়-শুভাকাক্সক্ষীর পরিবেষ্টনে ছিলাম। এখন আমি সারাক্ষণ নানাভাই ডাক শুনছি, তার ছোট্ট আঙুল ছুঁয়ে প্রায়ই বাইরে বেরিয়ে হাঁটছি। ঘরে আমি একাই নানা হয়ে আছি। এর কোনো অংশীদার নেই। অথচ নানির অদম্য শখ ছিল নাতনি দেখার। সে সুযোগই পেল না, নির্দয় পৃথিবী তাঁকে সুযোগটি দেয়নি।

ভাবছি, আজকে নানি বা দাদিমা হিসেবে আমার প্রয়াত স্ত্রী যা দায়িত্ব পালন করতে পারতেন, আমি কি এর ধারেকাছেও আছি? সারা জীবনই তিনি আমাকে বলে দিতেন, ‘আজ তোমাকে এ কাজটা করতে হবে’। আমি তাঁর হাত দিয়েই বিনা বাক্যে কেবল সামাজিক রীতি পালন করেছি। ভাবলে অবাক হয়ে যাই, আগামী মাসে তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাই এখন আমার আর সেই সুযোগ নেই। আমার বোধের এমন সীমাবদ্ধতা আজন্ম। বড় হয়ে নিশ্চয় আজকে আসা আমার দাদাভাই এবং কিছু দিন আগে আসা নানাভাই দুজনই আমাকে ভুল বুঝবে না। লক্ষ কোটি মানুষের আশীর্বাদ কামনায় আজ আমার দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরলাম।’

বল, লেখাটা তোমার পছন্দ হয়েছে?

আমি কিন্তু পাঠককে তোমার মনের কথাই বলেছি। সত্যিই বলেছি নানি বা দাদি হিসেবে বেঁচে থাকলে তুমি যা করতে পারতে এর তুলনা এখন আমি কার সঙ্গেই বা করব?

লেখক : সাবেক সচিব, গল্পকার ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর