মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

কতটা এগোল দেশের স্বাস্থ্য খাত

ডা. এ জেড এম মোস্তাক হোসেন

কতটা এগোল দেশের স্বাস্থ্য খাত

স্বাধীনতার ৫২ বছরে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। অনেক উন্নত দেশের চেয়ে কভিড-১৯ মহামারি সামলাতে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ। অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসা চাহিদা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সূচকগুলোর ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বাংলাদেশকে এগিয়েছে বহুদূর। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। এখন স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলের কাতারে। বাংলাদেশের এ উত্তরণের পেছনে রয়েছে এক কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মূলত প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক সেবা দিয়ে চিকিৎসাসেবা শুরু হয়। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মাত্র ছয়টি মেডিকেল কলেজ, একটি ডেন্টাল কলেজ ও পিজি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতাল দিয়ে মধ্যম ও তৃতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা শুরু হয়। গত চার যুগে বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রায় ২০০ মধ্যম, তৃতীয় ও বিশেষায়িত পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে।

বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট চিকিৎসা সাময়িকী ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে  ছয়টি সিরিজে এ দেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্যকে এশিয়ার বিস্ময় হিসেবে তুলে ধরে। নানাবিধ প্রতিকূলতা ও অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অসাধারণ স্বাস্থ্য সাফল্য এবং এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো অনুসরণীয় বিবেচ্য বলে উল্লেখ করে সাময়িকীটি।

স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দেশে ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র ২ শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশের বেশি।

টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন ও ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)। ১৯৯৩ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১ হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে মৃত্যুহার ছিল ১৩৩। ২০২২ সালের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু (প্রতি হাজার জীবিত শিশুর) কমিয়ে ৩৪ জনে আনার জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। শিশুমৃত্যু হার রোধে সফলতার জন্য ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে পুরস্কৃত করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা নিজেই গ্রহণ করেন।

গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারা দেশে ১৩ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে; যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে।

দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই আগে ছিল না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম মেয়াদে সরকার গঠন করে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আইপিজিএমআরকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের প্রস্তাব দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা যেমন রোগীর চিকিৎসা, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান চিকিৎসকদের উচ্চতর ডিগ্রি, প্রশিক্ষণ এবং সর্বশেষ জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা। সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও তিনটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এগুলো হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে চলছে নিরলস চেষ্টা। দেশের স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ বিশ্ববিদ্যালয়।

দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৫৮টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে প্রতি বছর সাড়ে ১১ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। আগে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩০০-এর মতো। দেশের মেডিকেল শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি নার্সিং কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও মিডওয়াইফ ইনস্টিটিউট আছে ৩১৭টি। এর মধ্যে সরকারি ৯৯টি, বেসরকারি ২১৮টি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর ১২-১৩ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বের হচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই তরুণরা।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চাহিদার শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ওষুধ আমদানি করতে হতো। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ১৪৫টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। গত ছয় বছরে ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ৫ থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলার।

দেশের ২২ জেলায় ৪২১ মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ উদ্বোধন করা হয়েছে। সরকারের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ কোম্পানি এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধিতে আরও সক্ষমতা অর্জনের জন্য গোপালগঞ্জে একটি বিশাল ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছে।

প্রায় ১০০ হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে। ‘হেলথ কল সেন্টার স্বাস্থ্য বাতায়ন’ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে দিনরাত যে-কেউ বিনামূল্যে চিকিৎসকের পরামর্শ, অ্যাম্বুলেন্স বুকিং, অভিযোগ ও পরামর্শ জানান এবং স্বাস্থ্য তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ নিতে পারেন।

লেখক : উপাচার্য, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর