বুধবার, ১৪ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে

স্কুলজীবনে বাংলা ব্যাকরণের কারক ও বিভক্তি পড়ানোর সময় আমাদের আবুল হোসেন স্যারের দরাজ কণ্ঠে প্রথমবার শুনেছিলাম একটি কবিতার লাইন- “আমি কি ডড়াই সখী ভিখারি রাঘবে? পরবর্তীতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ শীর্ষক কবিতায় এ বাক্যটি আবার পড়েছি। নিজ আগ্রহে জেনেছি প্রাচীন ভারতের রাজা দশরথের পুত্রদের কাহিনি নিয়ে মহাকবি বাল্মিকী রচিত ‘রামায়ণ’ নামক সংস্কৃত মহাকাব্যে উল্লিখিত উক্তির নেপথ্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। বর্ণানুসারে লঙ্কা নামক দ্বীপরাজ্যে শত্রুর আক্রমণ ঘটলে রাবণ তার প্রিয় ও তেজস্বী পুত্র মেঘনাদকে কেন্দ্র করে সব যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন। কিন্তু নানা ঘটনা ও অঘটনের মধ্য দিয়ে মেঘনাদকে নিরস্ত্র অবস্থায় শিরশ্ছেদের মাধ্যমে হত্যা করে রামের ছোট ভাই লক্ষণ। রাজপ্রাসাদের প্রার্থনা কক্ষে ঘটে যাওয়া এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর মুহূর্তেই অন্দরমহলে পৌঁছে যায়। এতে শোকে কাতর মেঘনাদের স্ত্রী প্রমীলা বিলাপ শুরু করে ও ঘটনাস্থলে যেতে চায়। কিন্তু তার সখী বাসন্তী ঘটনাস্থলের বিপজ্জনক পরিস্থিতি, বিশেষত রাঘব তথা রঘুবংশের শত্রুদের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং ঘটনাস্থলে যেতে বারণ করে। এতে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে সতী সাবিত্রী স্ত্রী প্রমীলা। তার সাফ জবাব, আমি একাধারে দানবের কন্যা, কুলো বধূ, রাবণের পুত্রবধূ ও মেঘনাদের স্ত্রী। তাইতো তার দৃপ্ত উচ্চারণ- ‘আমি কি ডরাই, সখী, ভিখারি রাঘবে?’

ছাত্রজীবনে পড়া এ ছত্রগুলো একের পর এক স্মরণে এলো সাম্প্রতিক ভিসাবিষয়ক ভেলকিবাজি ও কিছু ভ্রাতা-ভগ্নির ভগ্ন হৃদয়ের ভাবোচ্ছ্বাসের সূত্র ধরে। ভূগোল মতে ভুবনজুড়ে দেশ নামক ১৯৫টি ভূখণ্ড আছে। নিজ ভূখণ্ড ছাড়া অপরাপর ভূখণ্ডে ভ্রমণের জন্য ভিসাই ভরসা। এ ভিসার জন্য নিজ ভূখণ্ডে থাকা ভিন দেশের ভজনালয়ে ভাগ্যান্বেষী দেশীয় ভ্রাতা-ভগ্নিদের ভিড় দেখে রীতিমতো ভিরমি খেতে হয়। তবে নিজ ভূখণ্ডের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য (নিন্দুকদের ভাষায় নিজেদের ভাগ্য ভিজাতে) ভাবিত ভাগ্যবান ভাবুকেরাও ভোজসভার নামে ভালোমানছতা (উপহার) নিয়ে বেশ ভাবসাবের সঙ্গে ভিন দেশিদের ভিটিতে ভিড়েন বটে। ভিসাপ্রত্যাশী সাধারণ ভ্রাতা-ভগ্নির ভাষা এবং দেশের ভাবনায় ভাবিত ভদ্রবেশী ভাবুকের ভাবনা ও ভাষায় ভিন্নতার ভিত্তি দেখা যায়। দেশের ভাবনাই যাদের ভিত্তি বলে ভাবা হয় তাদের অনেকের ভগ্নহৃদয় যেন ভিন দেশ থেকে ভেসে আসা ভিসা সংক্রান্ত ভাষ্যটির ভাবার্থ ভুজঙ্গ তীর হয়ে ভেদ করেছে। ভুঁইফোড় বহু ভূস্বামী নিজ ভূখণ্ড ছেড়ে আমেরিকা নামক ভূখণ্ডে ভোগ-বিলাসের সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে ভবন ক্রয় করেন। ভরণপোষণের জন্য ভূরি ভূরি ভূষণ ভিজিয়েছেন সেই ভূখণ্ডে। ভিসার ভাষ্যমতে সেই ভবন ও ভূখণ্ডের কথা ভুলতে হবে যদি কেউ ভোট কিংবা নির্বাচন নামের ভবসিন্ধু পারাপারের ক্ষেত্র ভন্ডুল করে কিংবা ভদ্রতা ভুলে ভয়ংকর ভাব ধরে। এ ভাষ্যের মধ্যে গোলমালের চিহ্ন দেখেছেন অনেকে। অনেকেই ভয়ংকর রাজনীতিবিদদের মসনদে ভাশুররা আবার ভিড়বেন বলেও ভয়ার্ত ভাষায় ভাষণ দিচ্ছেন।

ভারী ভারী এসব ভাবের কথা ভুলে আসুন ভালো কিছু ভাবী। বাংলাদেশে অবাধ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২৪ মে ২০২৩ তারিখে তাদের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট সেকশন ২১২ (এ) (৩) (সি) (৩সি) অনুসরণ করে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এ নীতির আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা, নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো অবৈধ কাজে সহযোগিতা করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অগ্রহণযোগ্য ও অবমূল্যায়ন করার অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের ভিসা প্রদানে বিরত থাকার সক্ষমতা প্রদান করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়তে পারেন বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান বা প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা তথা সরকারি আমলাবৃন্দ, সরকারি অথবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, বিচার কাজে নিয়োজিত বিচারক ও কর্মকর্তা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ। এ ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়- যেসব কাজের দ্বারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে বিবেচিত হবে তার মধ্যে রয়েছে- ভোটে কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা প্রদান, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের মতো প্রকাশে বাধা প্রদান ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যে কোনো সময় যে কোনো দেশের যে কোনো নাগরিকের ভিসা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তাহলে বাংলাদেশে এমন ঘোষণা কেন দেওয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন মুখপাত্র বলেন, থ্রি সি পলিসি ঘোষণার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মার্কিন কর্তৃপক্ষকে ভিসা প্রদান না করার সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি বার্তাও পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন মার্কিন মুখপাত্র। তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো- বাংলাদেশের জনগণের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনকে সমর্থন করে এবং এ লক্ষ্যে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রস্তুত রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের কণ্ঠস্বর বা মতামত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য কারও যদি কোনো কর্মপরিকল্পনা থেকে থাকে তবে তাদের প্রতি এ ভিসানীতি একটি সতর্ক সংকেত ও স্পষ্ট বার্তা যে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর নজর রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনে কারচুপি বা অনিয়ম হবে- এমনটি মনে করে কি না এবং এ ভিসানীতি যে কোনোভাবেই হোক না কেন বাংলাদেশে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সতর্ক বাণী বা সমালোচনা কি না এমন প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। জবাবে মার্কিন মুখপাত্র মিলার বলেন, না, আমি মনে করি এটি আমাদের পক্ষ থেকে একটি সংকেত যে আমরা বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে সমর্থন করি এবং দেশে যে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাউকে জবাবদিহি করার ক্ষমতা আমাদের আছে।

এ ভিসানীতি সমাজের অপরাপর অংশের প্রতি এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, বিচার বিভাগের সদস্যবৃন্দের প্রতিও একটা সতর্ক বার্তা যে, যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা রয়েছে এবং দেশটি এ বিষয়ে নজর রাখছে। বাংলাদেশ সংক্রান্ত শেষ প্রশ্নের উত্তরে মিলার স্পষ্টত জানিয়ে দেন- যদি কোনো অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ভিসাসংক্রান্ত এমন নীতি ঘোষণার পরপরই দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এ সাক্ষাৎকারে তিনি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বে এগিয়ে থাকতে হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা অত্যাবশ্যক বলে মত প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক ভিসানীতি সরকারি এবং বিরোধী দলের ওপর সমভাবে প্রযোজ্য হবে বলে ডোনাল্ড লু স্পষ্টত জানিয়ে দেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বিরোধীদলীয় কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যদি সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ পাওয়া যায় তবে তাকেও ভিসা প্রদান করা হবে না। একইভাবে যদি দেখা যায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কোনো সদস্য ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, সন্ত্রাস সৃষ্টি বা মত প্রকাশে বাধা প্রদান করছেন তবে তাকেও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে না। নতুন এ ভিসানীতির আলোকে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাবঞ্চিত হবেন। কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, ভিসানীতিতে উল্লিখিত চারটি অপরাধের যে কোনো একটিতে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ চারটি অপরাধ পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ভোটারদের ভয় প্রদর্শন, ভোটে কারচুপি, মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ এবং জনসমাবেশের ওপর বাধা সৃষ্টি করলে, সর্বোপরি সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে বা অগ্রহণযোগ্য করে তুললে এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত নীতিমালার আলোকে যারা উল্লিখিত অপরাধের আদেশ প্রদান করবেন অথবা আদিষ্ট হয়ে অপরাধগুলো করবেন, উভয় পক্ষের ওপর সমভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না দেওয়ার নীতি প্রযোজ্য হবে। ডোনাল্ড লু তার ভাষ্য পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, যারা এ ধরনের আদেশ গ্রহণ করবে এবং বাস্তবে তা কার্যকর করতে গিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করবেন অথবা ভোটারদের ভয় দেখাবেন অথবা ভোটে কারচুপি করবেন তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা লাভ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের অযোগ্য হবেন। বিভিন্ন বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে ডোনাল্ড লু বলেন, এ নীতিমালা বাংলাদেশের সরকার, সুশীল সমাজ এবং জনগণকে একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রণীত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় এ নীতিমালা বাংলাদেশের সরকার, বিরোধী দল ও সুশীল সমাজসহ সবার মধ্যে আলোচনায় অবদান রাখুক, যার ফলে সামনের বছরগুলোতে একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের জন্য এখন কিছুটা অসুবিধা হলেও এ নির্বাচন আগের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অর্জন আনন্দের সঙ্গে উদযাপনের উপলক্ষ হবে বলেও মনে করেন ডোনাল্ড লু।

মূলত উল্লিখিত দুটি সূত্রে পাওয়া প্রতিটি বাক্য, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিটি শব্দ নিয়েও সব মূলধারা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা, সমালোচনা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের সুনামি শুরু হয়েছে। অতীতে কোনো স্পর্শকাতর বিষয়েও আলোচনায় ছন্দপতন ঘটায় নতুন কোনো উপলক্ষ বা নতুন কোনো ঘটনা বা অঘটন। তবে এবার দিনের পর দিন কিংবা রাতের পর রাত এ বিষয়ে আলোচনা ছাড়িয়ে যেতে পারেনি অন্য কোনো বিষয়। অথচ বাস্তবে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১৭ হাজার মানুষ আমেরিকার ভিসা নিয়ে আদৌ চিহ্নিত কি না সন্দেহ। তবে সন্দেহাতীতভাবে যা পরিলক্ষিত হচ্ছে তাহলো দেশের সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ নীতি ঘোষণার পর আচরণ, ভাষা প্রয়োগ ও সার্বিক কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন দেশের প্রধান তিন দলের শীর্ষ নেতারা।

এক সময় যে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপেক্ষা করেছিলেন আজ সেই দেশের মন্ত্রীরা বাংলাদেশের তৈরি শার্ট, প্যান্ট ও স্যুট পরেই বাংলাদেশে আসেন, নানা বিষয়ে উপদেশসহ গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। নানা কারণে রাশিয়া, চীন, জাপান ও ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থান এবং বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জাতিসংঘের অধীনে শান্তিরক্ষী প্রেরণ, তৈরি পোশাক, ধান, পাট, আলু, মিঠা পানির মাছ, ফল, শাক-সবজি, ছাগল প্রভৃতি উৎপাদন ও জাহাজ ভাঙা শিল্পের মতো বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রথম ১০টি দেশের একটি। এদেশের ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ বা যুবকের সংখ্যা কিংবা ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী কর্মজীবীর সংখ্যা পৃথিবীর বহু দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এমনকি এদেশের প্রশিক্ষিত সেনা, নৌ, বিমান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।

কোনো ভিসার ভেলকি নয়, এদেশের কোটি কোটি শিশুর ভবিষ্যতের স্বার্থেই আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। বিদেশিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সুশাসনের জন্য আমরা যে পরিমাণ রক্ত দিয়েছি ও ত্যাগ স্বীকার করেছি তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তবে দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসব ইতিহাসের পাশাপাশি এমন ইতিহাসও পড়বে, যেখানে লেখা থাকবে তাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের জাতির পিতা ও একজন রাষ্ট্রপতিকে খুন করেছিল, গ্রেনেড হামলাসহ নানাভাবে হত্যা করতে চেয়েছিল একজন দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীকে। দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছিল একজন রাষ্ট্রপতি ও একজন প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাসে আরও লেখা থাকবে ১/১১ নামক অদ্ভুত শাসনের কুশীলবদের স্থান হয়েছে গণতন্ত্রের সবক দেওয়া একটি দেশে। এক কথায় দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে সব সরকারপ্রধানের ভাগ্যে জুটেছে অপমৃত্যু, জেল বা অপমান। এ জন্যই কি যুগে যুগে শাসকরা ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন? সেই দুর্বলতার সুযোগেই কি ভিসার ভেলকি ভয় ঢুকিয়েছে ভদ্রলোকের ভাবনায়? কী দুর্ভাগ্য আমাদের! সময় এসেছে নিজেদের সমস্যা নিজেরা মিটিয়ে মোড়লদের বলা- ‘আমি কি ডরাই, সখী, ভিখারি রাঘবে?’ আত্মসম্মানে বলিয়ান হয়ে আমরা যদি তা বলতে না পারি তবে মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের এ কথাই হয়তো বলতে হবে :

“কি পাপে হারানু আমি তোমা হেন ধনে?

কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,

হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে

সহি এ যাতনা আমি? কে আর রাখিবে

এ বিপুল কুলো-মান এ কাল সমরে!”

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email: [email protected]

সর্বশেষ খবর