বুধবার, ১৪ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’

মো. খসরু চৌধুরী

বিশ্বজুড়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’

অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিল্প খাত। এক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ খাত শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করেনি, একই সঙ্গে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। পোশাক শিল্পের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বিপাকে অন্যান্য শিল্প বিপাকে পড়লেও সবার আগে ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। দেশে রপ্তানি খাতে ৮৫ শতাংশ অবদান রাখছে তৈরি পোশাক। রপ্তানি খাতে সুপারস্টার তৈরি পোশাক। আমাদের রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আসছে। নতুন পণ্যের ক্ষেত্রেও যেমন ম্যান মেড ফাইবার ও হাই ভ্যালু প্রডাক্ট পোশাক খাতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসছে। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে এ ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ। পরের অবস্থানেই ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৮ হাজার ৭৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোট রপ্তানিতে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অবদান ছিল ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সারা পৃথিবীতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি দিয়েছে এ পণ্য। শ্রমঘন এ শিল্পটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। আশির দশক পর্যন্ত মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশ ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এরপর পাটকে পেছনে ফেলে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৮২ সালে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং ১৯৮৫ সালে ৫৮৭, আর ১৯৯৯ সালে ২ হাজার ৯০০ এবং বর্তমানে কারখানা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৮৯ ভাগ। কিন্তু গত ১০ বছরের গড় হিসাবে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসছে এ খাত থেকে। পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ নতুন উদ্যোক্তা দল সৃষ্টি করেছে। যারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বেসরকারি খাত গড়ে তুলেছেন। এ খাতের হাত ধরেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিকাশ হয়েছে। গার্মেন্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরে তারা অন্যান্য শিল্পে রূপান্তর ঘটিয়েছে। আর বর্তমানে রাজস্ব আয়ের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আসছে বেসরকারি খাত থেকে। অন্যদিকে পোশাক শিল্পের বিকাশে নারীর ক্ষমতায়নসহ বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্পে ২৫ লাখের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এতে শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণে এসব নারীর সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে। চাকরির সুবাদে পুরুষের কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।

স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে পোশাক শিল্প দেশকে অনেক দিয়েছে। কর্মসংস্থান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিশাল অবদান এ খাতের। আজকের যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, তার পেছনে পোশাক শিল্পের অবদান অন্যতম। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশকে ধরা হয়।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিরূপ অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকার জন্য যে দুটি খাতকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় তার একটি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। রপ্তানি বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখা এ শিল্প কেবল দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের ভূমিকাই রাখছে না, নারীর ক্ষমতায়নেও বিপ্লবের সূচনা করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রপ্তানি থেকে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এর মধ্যে কেবল তৈরি পোশাক খাত থেকে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮১.৮১%। এটি রপ্তানি ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯.৭৩%। বিপুল অঙ্কের এ রপ্তানির পেছনে রয়েছেন গ্রাম থেকে উঠে আসা লাখ লাখ নারী।

জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্ট শিল্প একধাপ এগিয়ে। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। রপ্তানি বাণিজ্যেও তৈরি পোশাক শিল্পের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এ খাত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পণ্যের মান এবং ডিজাইন আধুনিক করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে কিছু বিদেশি দক্ষ কর্মী ছিল, এখন আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মীরাই কাজ করছে। শিল্প বিকাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। অনেকগুলোর কাজ এখন শেষ পর্যায়ে।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বমানের ও আধুনিক তৈরি পোশাক তুলনামূলক কম দামে সরবরাহ করতে সক্ষম। সরকারের সহযোগিতায় তৈরি পোশাক শিল্পসহ দেশের অর্থনীতির চাকা চলমান ছিল। বাংলাদেশ এখন যে কোনো পরিমান পণ্য সরবরাহ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প এক নতুন সম্ভাবনাময় সংযোজন। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে এ খাত থেকে। বেকার সমস্যা সমাধান বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত অর্ধশিক্ষিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার পেছনে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য।

লেখক : পরিচালক, বিজিএমইএ, সিআইপি

সর্বশেষ খবর