বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

দ্বিতীয় পদ্মা সেতু : বিকল্প ভাবনা

অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ

দ্বিতীয় পদ্মা সেতু : বিকল্প ভাবনা

১. নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদী মায়ের মতো। বহু বিস্তৃত নদী, উপ-নদী, শাখা নদী আঁচল বিছিয়ে বিপুল জলরাশিতে সুজলা, শস্য-শ্যামল বাংলাদেশ। নদী মরে যাচ্ছে। তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ’৭০ সালের নির্বাচনে জাতির পিতা ‘ক্রগ মিশন’ বাস্তবায়নের কথা বলেছিলেন। ‘নদী বাঁচাও’ তাঁর প্রতিশ্রুতি আমরা ভুলেই গেছি। বর্তমান যুগে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ‘নদী-উন্নয়ন’ নয়; ব্রিজ-সেতু নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে দেশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাজেটে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোটি মানুষের অব্যক্ত দাহ ও যন্ত্রণার কথা তুলে ধরা প্রয়োজন।

২. প্রথমেই যমুনা ও পদ্মা নদীর বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক। যমুনার তীর ধরে উৎসমুখে দেখা যায়, নদীটি এসেছে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে, ব্রহ্মপুত্র যার নাম। তিব্বতের ভিতর ১৭০০ কিমি., ভারতের ৯০০ কিমি. এবং বাংলাদেশে ৩০০ কিমি. বিপুল জলরাশি নিয়ে শেষ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে পাবনার বেড়া উপজেলার শেষ প্রান্তে, গোয়ালন্দের কাছে। উৎস থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত নদীটির দৈর্ঘ্য হলো ২৯০০ কিমি.। ১৭৮৭ সনে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে আদি ব্রহ্মপুত্র যা মেঘনায় গিয়ে পড়েছিল তার মুখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আদি ব্রহ্মপুত্র আজ মৃত প্রায়। ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় প্রবেশ করলে এই মূলধারার নাম হয় যমুনা। তথ্যে উল্লেখ আছে যে, এর অববাহিকা হলো ৫ লাখ ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর অন্যতম প্রধান পানিপ্রবাহ এসেছে তিস্তা থেকে। তিস্তা নদী নেপাল-ভারত হয়ে বাংলাদেশের ডিমলায় প্রবেশ করে। করতোয়া ভারতের জলপাইগুড়ি অতিক্রম করে বাঙ্গালি নদীতে এসে যমুনার ধারাকে পুষ্ট করে, যার জলস্রোত ২১ হাজার কিউসেক। নদীটি বহু খালবিল, উপ-নদীর পানি ধারণ করেছে এবং আদি পাবনা জেলার বড়াল নদী যা বেড়া শাহজাদপুর উপজেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত। বর্ষায় যমুনায় লাখ কিউসেক জলস্রোত গোয়ালন্দে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়।

৩. ভারতের গঙ্গা থেকে এসেছে পদ্মা। রাজমহল হয়ে বাংলাদেশের ফারাক্কার লগ্নে ঢুকেছে। গঙ্গা নদীর দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৬০০ কিমি.। এর অববাহিকা ৯ লাখ ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। পদ্মা ১২০ কিমি. ধরে বিপুল জলপ্রবাহ নিয়ে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত এসেছে। ’৮২ সালের জরিপে দেখা যায়, গঙ্গার পানির জলধারার পরিমাণ ৭৬ হাজার কিউসেক। বাংলাদেশে মাতামুহুরী, গড়াই নদীসহ বহু উপ-নদীর জলধারা ভারত থেকে এসে পদ্মাকে সমৃদ্ধ করেছে।

৪. এ বছরের পাসকৃত সম্পূরক বাজেটে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান বেছে নেওয়া হয়েছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া (গোয়ালন্দ) ঘাট। ব্যয় হবে ১২ হাজার কোটি টাকার অধিক। আমলাতান্ত্রিক চক্রে তা বেড়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে তা অনুমিত। যমুনা এবং পদ্মার সঙ্গমস্থল গোয়ালন্দের কাছাকাছি। এ স্থানে দুই নদীর প্রচণ্ড প্রবাহ, ঘূর্ণাবর্তসহ প্রচণ্ড স্রোতধারা সৃষ্টি করে, যা বর্ষাকালে অবর্ণনীয়। এ স্থানে জলের গভীরতা প্রায় ৩০ মিটার। এখানে সেতু নির্মিত হলে যেমন বিপুল অর্থ অপচয় হবে তেমনি টেকসই হবে কি না প্রশ্ন থেকে যায়।

৫. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত নগরবাড়ি-আরিচা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা। পাবনার ঢালারচর রেলস্টেশন থেকে রাজবাড়ী পর্যন্ত যদি পদ্মার ওপর ব্রিজ করা হয় সেখানে কমবেশি ৩-৪ হাজার কোটি টাকার বেশি লাগার কথা নয়। পদ্মার প্রস্থ কম। কিন্তু বাজেটে এর কোনো আলামতই নেই।

৬. সম্পূরক বাজেটে সেতু বিভাগের ৪৩ নম্বর প্রকল্পে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় দ্বিতীয় পদ্মা ব্রিজ উত্তর বাংলার অন্তত সাতটি জেলাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ অঞ্চলের কয়েক কোটি কৃষক এবং মানুষ বিপন্ন হবে। জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হবে যা সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘনের শামিল। একই সঙ্গে আয় বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে, যা সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদের রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী।

৭. বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও জটিল হয়ে পড়বে। পাবনা জেলা ও রাজশাহীর তাহেরপুর এলাকার পিঁয়াজসহ ওইসব অঞ্চলের শাক-সবজি, ফলমূল ও খাদ্যশস্য যদি সহজে স্বল্প সময়ে চলাচল না করতে পারে তাহলে দেশের অন্য এলাকায় আকাল পড়বে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পার হয়ে টাঙ্গাইল চন্দ্রা-টঙ্গী হয়ে ব্যাপক ঘুরপথে পদ্মা সেতু দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, বরগুনা ও ভোলা যেতে প্রায় ৬০০ কিমি. পথ অতিক্রম করতে হয়। বর্তমানে পাবনা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে রাজধানীতে আসতেই সময় লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। বরিশাল যেতে আরও ২-৩ ঘণ্টা। এভাবে জ্বালানি, শ্রমঘণ্টা এবং যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ বেড়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষের ক্রয়ের সীমা অতিক্রম করায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

৮. ২৮ অক্টোবর ’৭০ সালে অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী মেনিফেস্টো ‘রাজনৈতিক সম্প্রচার’ নামে বেতার ও টিভিতে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি যমুনা সেতু নির্মাণের বিষয়টি ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণ করা হবে’ বলে জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। স্বাধীন হওয়ার পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে পাবনার নগরবাড়ী ঘাটে ‘মুজিব বাঁধ’ (পাবনা সেচ প্রকল্প) উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘ঈশ্বরদী-নগরবাড়ী রেলপথ হবে এবং মানিকগঞ্জ হয়ে তা ঢাকায় যাবে। ৫২ বছরেও তা নির্মিত হয়নি। যমুনার ওপর ওই সেতু-রেলপথ আজও কালের ধুলাই ঢেকে গেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি।

৯. পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর-রাজবাড়ী সেতু-রেলপথ দিয়ে উত্তরাঞ্চলের যানবাহন দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে যদি প্রবেশ করে তাহলে মাত্র ৩৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে। এসব বিবেচনা না করেই বর্তমানে বিপজ্জনক ভয়াবহ স্থান দিয়ে পদ্মা দ্বিতীয় সেতু করার নামে যে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে, দেখে শুনে মনে হয় তা সিন্ডিকেটবাজির কর্মকাণ্ড। প্রশ্ন জাগে, আমরা কি জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেব? না জনগণের অর্থ হরিলুট করার জন্য সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি থাকব? ৩-৪ কোটি মানুষ এ অসহায় ও দুর্বিষহ ব্যবস্থা থেকে মুক্তি চায়। না হলে অবহেলিত, বঞ্চিত, শোষিত ও দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলের মানুষের চিরায়ত দুঃখ-দুর্দশার কোনো লাঘব হবে না, হওয়া সম্ভব নয়। আন্তপ্রজন্ম কি ধুঁকে ধুঁকে মরবে?

লেখক : ’৭২-এর খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর