বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম ও কংগ্রেসের ঐক্য

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তৃণমূলের বিরুদ্ধে বাম ও কংগ্রেসের ঐক্য

কয়েক শ বছর আগে আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, ‘ব্যালট ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান বুলেট।’ কয়েক শ বছর পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন চলছে তাতে শাসক দল মনে করছে তাদের হাতে বুলেটই বেশি শক্তিধর। ইতোমধ্যে ৫-৬টি জেলায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গুলি-বোমা-পিস্তল- কী নেই! তার সঙ্গে আছে শাসক দলের পুলিশ। মনোনয়ন প্রক্রিয়ার প্রথম দিনই মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে জনৈক কংগ্রেস কর্মী ভোট দিতে গিয়ে দেখেন দীর্ঘ লাইন। তিনি বাড়ি ফিরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলতে বসেন। তৃণমূলের ১৫-২০ জন সমাজবিরোধী হাতে অস্ত্র নিয়ে তার বাড়িতে প্রবেশ করে। তাকে পর পর ছয়টি গুলি চালায়। তার মার সামনেই ছেলেকে গুলি করা হয় বলে তার মা টিভির পর্দায় বিবৃতি দিয়েছেন। নিহত যুবক একজন পরিযায়ী শ্রমিক। দক্ষিণ ভারতে কাজ করেন। ভোট দিতে বাড়ি ফিরেছিলেন। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় গত পাঁচ দিনে তিনজন কংগ্রেস-কর্মী তৃণমূলের হাতে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন তিন বিরোধী দলের শ-দুয়েক কর্মী। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী, সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ সেলিম এবং বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, রক্ত দেব, কিন্তু তৃণমূলকে জায়গা দেব না। এসব ঘটনা দেখেই রাজ্যপাল নির্বাচন কমিশনারকে ডেকে পাঠান। বলেন, মনোনয়ন জমা দেওয়ার কেন্দ্রে ১৪৪ ধারা জারি করুন। এও বলা হয়, মনোনয়ন কেন্দ্রের ১ কিলোমিটারের মধ্যে প্রার্থীসহ দুজনের বেশি থাকতে পারবে না। কোথায় গেল আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই উক্তি? ১৪৪ ধারা জারি করার সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল থেকে বলা হলো, আমরা এটা মানছি না। রাজ্যপাল থেকে শুরু করে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি তৃণমূলের ওই বিবৃতির ধিক্কার জানিয়ে বলেছেন, এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বাচন নিয়ে গত ৫-৬ দিনে যা ঘটছে, সেদিকে একবার তাকানো যাক।

স্ত্রী রুজিরাকে দিনভর জেরার পর যখন আবার ডাকা হবে এই কথা বলে আপাতত নিষ্কৃতি দেওয়া হলো, ঠিক তখনই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় দ্বিতীয়বারের জন্য সমন জারি করা হলো তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়বারের জন্য তাঁকে সিবিআইয়ের দফতরে জেরার মুখোমুখি হতে হবে। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের শাসক শিবিরের অন্দরে এবং রাজ্যের গোটা বহির্মহলে সঙ্গে সঙ্গে বার্তা ছড়িয়ে পড়ে, সপত্নীক মমতা-সাম্রাজ্যের যুবরাজের গ্রেফতারি সমাসন্ন। আর কার পরামর্শে জানা যায়নি, ইডি-সিবিআইয়ের এই সাঁড়াশি অভিযানকে বানচাল করতে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে শিখণ্ডী করা হচ্ছে। সেই মতো সরকারি অফিসের সময় শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ রাজ্যের সদ্য নিযুক্ত রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা ৮ জুলাই রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেন। দৃশ্যত বিসদৃশ ক্ষিপ্রতায় এই রকম কোনো ভোট ঘোষণার নজির ভূভারতে কখনো কোথাও দেখা যায়নি। উদ্দেশ্য একটাই- অনিবার্য গ্রেফতারি এড়াতে আপাতত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের করার চেষ্টা, এই আশায় যে পঞ্চায়েত ভোটের অজুহাত দেখিয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আপাতত রক্ষাকবচ বের করা। তবে মোদি ভাইকে পাঠানো দিদিভাইয়ের আমের ঝুড়ির কোনো পৃথক প্রতিক্রিয়া যদি না হয়, তবে অভিষেককে অতি দ্রুত গ্রেফতার করার জন্য চতুর্দিক থেকে সুপরিকল্পিতভাবে জাল গুটিয়ে আনছে ইডি-সিবিআইয়ের যৌথ অভিযান। রাজনৈতিক মহলের খবর, পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা অনেক আগেই হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এ কথা জানা থাকা সত্ত্বেও ভোট নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছিল। অন্য অনেক আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে এ কথা সত্ত্বেও ইডি-সিবিআইর তদন্ত অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন এখনই করা হবে কি না তা নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে ছিল তীব্র মতপার্থক্য। দলের একটা বড় অংশই বলেছিল, যেভাবে রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের নামে ‘চোর-জোচ্চর’ বলে ঢিঢি পড়ে গেছে তাতে এই রেশ কিছুটা না কাটার আগেই পঞ্চায়েত ভোট করতে গেলে ভরাডুবি অনিবার্য। দলের মধ্যকার এই যুক্তিকে এক সময় খণ্ডন করতে পারছিলেন না মমতা-অভিষেকসহ দলের বাকি অংশও। তবে এসব মত, পাল্টা মত সবকিছু পেছনে চলে যায় সিবিআইয়ের কাছ থেকে অভিষেককে পাঠানো হাজিরা সমন পাওয়ার পরই। তখন মূলত অভিষেকের একক সিদ্ধান্তেই মমতা ৮ জুলাই পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণায় রাজি হয়ে যান, কারণ এ মুহূর্তে পঞ্চায়েত ভোটে জেতা-হারার চেয়েও বড় অভিষেকের গ্রেফতারি এড়ানো।

রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা করেন রাজীব সিংহ। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে রাজ্যের নতুন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জানিয়ে দিলেন, ঠিক এক মাসের মাথায়, অর্থাৎ আগামী ৮ জুলাই, শনিবার রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হবে। রাজীব জানান, ভোট ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই রাজ্যে আদর্শ আচরণবিধি কার্যকর হয়ে গেছে। এবারের নির্বাচনে জেলা পরিষদের ৯২৮টি, ৪১টি পঞ্চায়েত সমিতির ৯ হাজার ৭৩০টি, ৩৩১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬৩ হাজার ২৮৩টি কেন্দ্রে ভোট হবে। সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলবে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া। দার্জিলিং এবং কালিম্পঙে ত্রিস্তর নয়, দ্বিস্তরীয় ভোট হবে। ২০১৮ সালের মতো এবারও এক দফাতেই পঞ্চায়েত ভোট হবে রাজ্যে। কিন্তু সর্বদল বৈঠক না ডেকে এভাবে পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করা হলো তা নিয়ে শাসক দল ও রাজ্য প্রশাসনকে আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। ‘গণতন্ত্রের হত্যা’ বলে টুইট করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার।

সূচি অনুযায়ী- মে মাস নাগাদ রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা পিছিয়ে যায়। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নবজোয়ার যাত্রা চলাকালীন জানান, ওই কর্মসূচি শেষ হলে পঞ্চায়েত ভোট হবে। এর মধ্যে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ ফাঁকা থাকায় তার প্রস্তুতি নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিল। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সৌরভ দাসের কার্যকাল শেষ হয় গত ২৮ মে। তারপর নতুন কমিশনার বাছাই নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে পদটি ফাঁকাই পড়ে ছিল। ওই পদে রাজ্য সরকার মনোনীত রাজীবের নামে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ছাড়পত্র না দেওয়ায় জটিলতা বাড়ছিল। বাড়ছিল পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তাও। নতুন কমিশনার হিসেবে রাজীবের নাম প্রস্তাব করে গত ১৮ মে রাজভবনে রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য ফাইল পাঠিয়েছিল নবান্ন। একক নামে ছাড়পত্র দিতে আপত্তি আরও একটি নাম চেয়ে পাঠায় রাজভবন। নবান্নও দ্বিতীয় নাম হিসেবে রাজ্যে কর্মরত অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার অফিসার অজিতরঞ্জন বর্ধনের নাম পাঠায়। তারপরও কমিশনার বেছে নিচ্ছিল না রাজভবন। দিন কুড়ির সেই টানাপোড়েনের পর বুধবার প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীবের নামেই সিলমোহর দেন রাজ্যপাল বোস। এরপরই পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণা করলেন রাজীব।

রাজ্য পুলিশকে দিয়েই পঞ্চায়েত ভোট করাতে চায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। মমতা মুখার্জির একসময়ের মুখ্যসচিব তথা মমতার পরিবারের ঘনিষ্ঠ এই নব্য মনোনীত নির্বাচন কমিশনার যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি নস্যাৎ করে দেবেন তা প্রথম দিনের সংবাদ সম্মেলনেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহারের কোনো নজির নেই। যদিও স্পষ্ট করে তিনি বলেননি, আদৌ শুধু রাজ্য পুলিশ দিয়ে ভোট হবে কি না। এদিকে বিরোধীদের একাংশ ইঙ্গিত দিয়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন না করা হলে তারা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, রাজ্য পুলিশ দিয়ে ভোটে তাঁর ভরসা নেই! বিরোধীদের পাল্টা কটাক্ষ করেছে শাসক দলও। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোটের প্রসঙ্গে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের মন্তব্য, ‘মামাবাড়ির আবদার’! রাজ্য পুলিশ দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের বিপক্ষে সব বিরোধীই। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘পুলিশ দিয়ে এ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে এ নির্বাচনে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন আছে।’ অধীর বলেন, ‘পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্য পুলিশের ওপর ভরসা রাখা সম্ভব নয়।’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীও বলেন, ‘৩ হাজার পুলিশ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই কাগজের ব্যালটবাক্স রক্ষা করতে পারছে না। তারা এত বড় নির্বাচন এক দফায় করে দেবে?’ কুণাল বলেন, ‘ত্রিপুরায় যখন হচ্ছে, এখানে ব্যতিক্রম হবে কেন? কোনো আইনে নেই যে, সর্বদল বৈঠক করতেই হবে। আর কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন আসবে? এটা কি মামাবাড়ির আবদার?’ তৃণমূল মুখপাত্র তথা রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেন বলেন, ‘যে স্টুডেন্ট সারা বছর পড়াশোনা করে, সেই স্টুডেন্টকে ভাবতে হয় না যে, পরীক্ষার তারিখ কবে ঘোষণা করা হবে। বা সেই স্টুডেন্টকে ভাবতে হয় না, আমি পরীক্ষায় পাস করব না ফেল করব?’

কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট হবে না কেন? প্রশ্ন তুললেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন না করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি রাজ্য সরকারকে হলফনামা জমা দিয়ে বক্তব্য জানাতে বলেছেন। সেই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ভোট আরও কয়েকটা দিন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষেও মন্তব্য করেছেন। বিচারপতি বলেন, ‘হনুমান জয়ন্তীর সময় আমরা বলেছিলাম সাধারণ মানুষের মনোবল বাড়াতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে। তারা রাজ্যকে সহযোগিতা করতে এসেছিল। এ ক্ষেত্রেও কমিশন চাইলে সহযোগিতা চাইতে পারে। কমিশন ৬ থেকে ১০টি জেলাকে স্পর্শকাতর ঘোষণা করেছে। প্রয়োজনে সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখা যেতে পারে।’

চুক্তিভিত্তিক কর্মী বা সিভিক ভলান্টিয়ারদের ভোটের কাজে ব্যবহার করা প্রসঙ্গেও সতর্ক করে আদালত বলেছেন, ‘এ বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, সিভিক কিন্তু পুলিশ নয়। তারা পুলিশকে সাহায্য করার কাজে যুক্ত।’

পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নের সময় বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম। বলেছেন, আগের বারের তুলনায় মনোনয়ন পেশের সময় কম। প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা মনোনয়ন পেশের জন্য অপর্যাপ্ত। এ প্রসঙ্গে কমিশন জানিয়েছে, চাইলে মনোনয়নের সময় একদিন বাড়ানো যেতে পারে। ৯ জুন থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত যে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তা ৯ জুন থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত করা যেতে পারে। এর প্রত্যুত্তরে বিচারপতি বলেন, সে ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ভোট ১৪ জুলাই করাতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে তাদের ক্ষমতার বিষয়ে সতর্ক করলেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘প্রার্থীর কথা ছেড়ে দিলাম, কিন্তু কমিশনের ওপর ভোটারদের আস্থা প্রয়োজন। আপনারা নিরপেক্ষ সংস্থা। আপনাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে অভিজ্ঞতা থেকে এবারও ত্রুটি থাকা উচিত নয়। কমিশনের ভূমিকা সন্তোষজনক হওয়া উচিত। আপনাদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন থাকুন। কমিশন চাইলে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু কমিশন পুরো বিষয়টি হাইজ্যাক করে নিজেদের কাছে রেখেছে।’ গত ৯ জুন থেকে শুরু হয়েছে মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া। ১৫ জুন মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। প্রধান বিচারপতি কমিশনের কাছে জানতে চাইলেন, ‘এখনো অবধি কত মনোনয়ন জমা পড়েছে কমিশনের কাছে?’ মনোনয়নের সময় বৃদ্ধি না করার যুক্তি দিতে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর উদাহরণ দিল কমিশন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী বললেন, ‘ধর্মাবতার! ধরুন, আমি আমার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে যাচ্ছি। আমি তো জানি কী কী নথিপত্র লাগে। এর জন্য অতিরিক্ত সময় তো দাবি করতে পারি না।’ প্রধান বিচারপতি কমিশনকে বললেন, আপনারা দিনে ৪ ঘণ্টা সময় দিচ্ছেন। কিন্তু তাও পর্যাপ্ত সময় নয়। জবাবে কমিশন বলল, ‘চার ঘণ্টা সময় দেওয়া হচ্ছে মানে ওই সময় পর্যন্ত মনোনয়ন, তার পর দরজা বন্ধ, এমনটা নয়। বিকাল ৩টা পর্যন্ত যারা প্রবেশ করবেন তাঁরা মনোনয়ন দিতে পারবেন।’ বিজেপির আইনজীবী জানিয়েছেন, দায়িত্ব নেওয়ার একদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা করলেন। সর্বদলীয় বৈঠকও ডাকা হয়নি। ‘প্রতিদিন ৪ ঘণ্টা করে মনোনয়ন নেওয়া হচ্ছে। পাঁচ দিনে হিসাব করলে ৭৩ হাজার প্রার্থীর জন্য গড়ে ৪০ সেকেন্ড সময়ও মেলে না।’ এসব সমস্যা নিয়ে এত কম সময়ে মনোনয়ন জমা পড়বে কীভাবে? বিজেপির আইনজীবীর অভিযোগ শোনার পর কমিশনের আইনজীবী বললেন, ‘আইন মোতাবেক আমাদের হাত বাঁধা রয়েছে। তবে অবাধ এবং সুষ্ঠু ভোট করাতে আমরা বদ্ধপরিকর।’ কমিশনের আইনজীবীর দাবি প্রসঙ্গে আগেই আদালত বলেছেন, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিন বাদ দিলে এবার মনোনয়নের জন্য পাঁচ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। বিজেপির আইনজীবীও বললেন, ‘৭৩ হাজার আসনে এত দ্রুত মনোনয়ন সম্ভব নয়।’ ১৪ জুলাই পঞ্চায়েত ভোট করানোর পরামর্শে পাল্টা যুক্তি দিল কমিশন। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী বললেন, দিন পিছিয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া, গতবার মনোনয়নের জন্য সাত দিনই সময় দেওয়া হয়েছিল।

সাগরদীঘির কংগ্রেস বিধায়ক দলবদল করলেও সমঝোতা অকেজো হয়ে পড়ছে না বলে রাজ্য কমিটির বৈঠক করে সদ্যই জানিয়ে দিয়েছে সিপিএম। এবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেন, পঞ্চায়েত ভোটে তাঁরা বামদের সঙ্গে সমঝোতা করেই লড়তে চান। সেই মর্মে জেলায় জেলায় দলের নেতৃত্বকে তৎপর হওয়ার বার্তা দিয়েছেন তিনি। তবে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ায় আগামী ১৫ জুন কলকাতায় শহীদ মিনার ময়দানে কেন্দ্রীয় সমাবেশ আপাতত স্থগিত রাখছে কংগ্রেস।

বিধান ভবনে অধীর বলেছেন, সর্বস্তরের কংগ্রেস কর্মীর কাছে আবেদন করছি, পঞ্চায়েত নির্বাচন যদি মানুষকে করতে দেওয়া হয়, তা হলে কংগ্রেস বামেদের সঙ্গে জোট করে নিজ নিজ এলাকায় ভোট করবে। যত দূর সম্ভব বামেদের সঙ্গে সমঝোতা করে বা জোট করে আমরা নির্বাচনে লড়ব। মনোনয়নের জন্য খুবই অল্প সময় দিয়ে, ভোটের নিরাপত্তা বা অনলাইন মনোনয়নের বিষয়ে কোনো আশ্বাস না দিয়ে পঞ্চায়েত ভোটকে ‘প্রহসনে’ পরিণত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন অধীর। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, তৃণমূলে দুর্নীতি এবং বিজেপির সাম্প্রদায়িক নীতির প্রতিবাদে ১৫ তারিখের সমাবেশের জন্য রাজ্যজুড়ে প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু জেলায় জেলায় মনোনয়ন চলবে বলে ‘নিরুপায়’ হয়ে আপাতত কলকাতার ওই সমাবেশ স্থগিত রাখতে হচ্ছে। মনোনয়নের সময়সীমা বাড়ানো এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনসহ একগুচ্ছ দাবি নিয়ে এদিনই কমিশনে গিয়েছিলেন নেপাল মাহাতো, শুভঙ্কর সরকার, আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়, কৌস্তভ বাগচীসহ কংগ্রেস নেতারা।

কংগ্রেসের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘বিজেপি এবং তৃণমূলকে হারাতে যেখানে যে শক্তিশালী, সেখানে তাদের সামনে রেখে লড়াইয়ের নীতিতেই আমরা চলব। কংগ্রেস, আইএসএফ, কোথাও সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই হবে। তবে স্থানীয় ভিত্তিতেই ঠিক হবে।’ উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদে বামফ্রন্ট এদিনই প্রথম প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলে রাখার কথা বলেছে। রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অবশ্য জোটকে কটাক্ষ করেছেন, ‘শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ, বিয়োগ, গুণ যা-ই হোক, ফল শূন্যই! আর রাজনৈতিকভাবে এটা হলো, সিপিএমের হাতে খুন হওয়া কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।’

লেখক : ভারতীয় সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর