শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হতে পারে যেভাবে

মো. আবদুল লতিফ বকসী (সবুজ)

সরকার আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের চামড়া ও চামরাজাত পণ্য রপ্তানি করে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে চায়। বলাই যায় সে সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। নিজস্ব কাঁচামাল, দক্ষ জনবল আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদা সবই বাংলাদেশের পক্ষে। তবে বাধা সিন্ডিকেট। চামড়া শিল্প আজ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি। তারা যা চাবে সেভাবেই দেশের চামড়া শিল্প খাত চলবে। সবদিক বিবেচনা করে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি করার অনুমতি প্রদান করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাধা হয়ে দাঁড়ায় চামড়া শিল্প খাতের সিন্ডিকেট, আটকে যায় সরকারের চামড়া রপ্তানির বিশেষ উদ্যোগ। রপ্তানির জন্য প্রচুর আদেশ পাওয়া যাচ্ছে, আমাদের দেশে পর্যাপ্ত রপ্তানিযোগ্য ওয়েট ব্লু চামড়া মজুদ রয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রপ্তানির অনুমতি দিচ্ছে কিন্তু রপ্তানি হচ্ছে না। রপ্তানিকারকদের ওপর একটি মহলের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি করা যাবে না, এর কোনো প্রতিকার নেই। কোরবানির ঈদ এলেই কম দামে চামড়া ক্রয়ের জন্য দেখানো হয় হাজারো অজুহাত। ফলে সুযোগ আসে পানির দামে চামড়া ক্রয়ের, বঞ্চিত হন চামড়ার মূল্যের প্রকৃত হকদাররা আর লাভবান হন সিন্ডিকেটের অসৎ সদস্যরা।

প্রতি বছর কোরবানির চামড়া নিয়ে ছিনিমিনি খেলা নতুন নয়। কোনো বছরই ন্যায্যমূল্য পান না প্রকৃত হকদাররা। কোরবানির চামড়ার মালিক ফকির-মিসকিন, এতিম, হাফেজিয়া মাদরাসার মতো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো। এতিমদের হক গ্রাস করে ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছে একটি গোষ্ঠী। সারা বছর চামড়া নিয়ে তেমন কোনো কথা শোনা যায় না, কোরবানির ঈদ এলেই শুরু হয় তোড়জোড়। গণদাবি ওঠে কোরবানির চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার, সরকারও উদ্যোগ নেয় উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে। সরকার বেঁধে দেয় ক্রয়মূল্য, তাও চামড়া ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার বাইরে নয়। শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয় না। লাভের ফসল গোলায় তোলেন সেই ব্যবসায়ীরা। আন্তর্জাতিক মানের চামড়াজাত পণ্য তৈরির জন্য উন্নত মানের চামড়া প্রয়োজন। উন্নত চামড়ার মান বিষয়ে সার্টিফিকেট প্রদান করার দায়িত্ব হলো লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি)। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গ্রুপ, বিশ্বের সব ব্র্যান্ড এ সার্টিফিকেটকে সম্মান দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট ইস্যুর ব্যবস্থা নেই। সে কারণে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো চামড়াজাত পণ্য তৈরির ফ্যাক্টরিগুলোতে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ থেকে সরাসরি চামড়া ক্রয় করতে পারছে না। আমাদের দেশের চামড়া বিদেশে রপ্তানি হওয়ার পর তা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হয়ে উচ্চমূল্যে আবার বাংলাদেশের ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হয় এবং বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। আমাদের প্রচুর উন্নত মানের চামড়া আছে অথচ বাংলাদেশে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সার্টিফিকেট প্রদানের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে বাংলাদেশ বরাবরই চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকার কতিপয় ব্যবসায়ীর কূটকৌশল ঠেকাতে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। চামড়ার মূল্য নির্ধারণ, ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থের জোগান, কাঁচা চামড়া পাচার রোধে সীমান্তে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, কাঁচা চামড়া পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেক বাধা অতিক্রম করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি প্রদান শুরু করে ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে। এর আগে ৩০ বছর এ চামড়া রপ্তানি বন্ধ ছিল। ঢালাওভাবে না হলেও কেস টু কেস পদ্ধতিতে আবেদনের ও ক্রেতাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দিচ্ছে। কিন্তু এতেও সুফল পাচ্ছে না। ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি প্রদানের উদ্দেশ্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, রপ্তানির ফলে দেশের চামড়ার গোডাউনগুলো খালি হবে, রপ্তানি আয় থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার সমৃদ্ধ হবে। ব্যবসায়ীরা আবার নতুন চমড়া উপযুক্ত মূল্যে কিনতে উৎসাহী হবেন। সরকারের সে উদ্দেশ্য সফল করতে দিচ্ছে না কতিপয় চামড়া ব্যবসায়ী। তারা চামড়া রপ্তানি করতেও দেবে না, চামড়া কেনার সময় উপযুক্ত মূল্যও দেবেন না। উদ্দেশ্য নিজেদের পকেট ভারী করা।

পশু থেকে চামড়া সংগ্রহের পর লোম ছাড়িয়ে বিশেষ প্রক্রিয়া করার পর ওয়েট ব্লু চামড়া হয়। রপ্তানি কারকরা বিদেশ থেকে রপ্তানি আদেশ নিয়ে আসছে কিন্তু একটি শ্রেণি এ ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি করতে দিচ্ছে না। তাদের আন-অফিশিয়াল অলিখিত এবং অনৈতিক কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের চামড়া শিল্প, কোরবানির চামড়ার প্রকৃত হকদার এতিম, ফকির মিসকিন বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য পাওনা থেকে। সামনে কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা। এখন থেকেই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে কীভাবে বিগত বছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যে ধস নামানো যায়। ঈদুল আজহা এলেই দেশের প্রচারমাধ্যমগুলো সরব হয়ে ওঠে, প্রচুর লেখালেখি হয়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নাজুক পরিস্থিতি প্রচার করা হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সংবাদমাধ্যমে কোরবানির চামড়ার মূল্যে ধস এবং ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির প্রতিবন্ধকতার বিস্তারিত বিবরণ ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদকের কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বক্তব্যে প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের চামড়ার মান বেশ ভালো। পৃথিবীর অনেক দেশেই বাংলাদেশের চামড়ার বেশ চাহিদা রয়েছে। বিগত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ছিল ১,০৮৫.৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, তা ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১,২৪৫.১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রপ্তানি বাড়ছে, তবে সুযোগ থাকার পরও তা প্রত্যাশিত রপ্তানি হচ্ছে না। এখনো রপ্তানিযোগ্য ওয়েট ব্লু চামড়া দেশে পর্যাপ্ত মজুদ আছে, রপ্তানি আদেশ আছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানির অনুমতি আছে, কিন্তু অদৃশ্য শক্তির বাধায় ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানি করা যাচ্ছে না।

বছরে ২ কোটি বর্গফুট চামড়া রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে রপ্তানিকারকরা কাজ করলেও তা পারেন না। বিপুল মূল্যের চামড়া রপ্তানির ক্রয় আদেশ এখনো রপ্তানিকারকদের কাছে থাকলেও সমিতির সনদের বা রপ্তানির অনুমতির অভাবে তা রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। রপ্তানিকারকরা ভয়ে এবং বাধার মুখে এ বিষয়ে অভিযোগ করতে পারেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও অভিযোগ না পেলে অফিশিয়াল ব্যবস্থা নিতে পারছে না, এভাবেই চলছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রাধিকারভুক্ত রপ্তানি খাত চামড়া শিল্প। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) চামড়া রপ্তানির প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে আসছে বরাবরই। দেশে চামড়া শিল্পের বিকাশ হয়েছে বহুগুণ। আন্তর্জাতিক মানের চামড়ার শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে অনেকগুলো। দেশের কাঁচামাল, দক্ষ জনশক্তি, পণ্য উৎপাদনে খরচ কম কিন্তু দোকানে গেলে চামড়া পণ্যের মূল্য অনেক বেশি। চামড়ার পণ্য মানেই ব্যয়বহুল পণ্য। অথচ কাঁচা চামড়ার মূল্য নেই। পানির দামে চামড়া কিনে কয়েক হাত বদল হয়ে কারখানায় গেলেই হয়ে যায় বহু মূল্যবান পণ্য। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ঈদুল আজহায় দেশে ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি করা হয়। এর ৪০-৪৫ ভাগ গরু ও মহিষ। দেশের ট্যানারিগুলো বছরের মোট চামড়ার সংগ্রহের সিংহভাগ হয়ে থাকে ঈদুল আজহার সময়। সারা বছর আসে খুবই সামান্য। সরকারের কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপই কোরবানির চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারে।

লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার (পিআরএল) ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

সর্বশেষ খবর