শনিবার, ১৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

সামুদ্রিক মৎস্যজীবীরা চান জীবিকার নিরাপত্তা

শাইখ সিরাজ

সামুদ্রিক মৎস্যজীবীরা চান জীবিকার নিরাপত্তা

দেশের মৎস্য সম্পদের সুরক্ষা ও মাছের বংশবিস্তারে সাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে গত ১৯ মে, ২০২৩ থেকে। এই নিষেধাজ্ঞা আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। কিন্তু খবর নিয়ে জেনেছি সমুদ্রে মাছ ধরা থেমে নেই। রাতের আঁধারে ঠিকই মাছ ধরে বেচাকেনা চলছে। চ্যানেল আইয়ের পটুয়াখালী প্রতিনিধি এনায়েতুর রহমান আমাকে কিছু ভিডিওচিত্র পাঠিয়েছেন। এ সময়ে মাছ ধরা নিয়ে জেলেরা দুই ভাগে বিভক্ত। একদল সরকারের নির্দেশনা মানছে। আরেক দল বলছে, আমরা মাছ না ধরলেও ভারতীয় জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরা শুরু করেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরা নিষেধ ছিল।

দেশের সমুদ্র অর্থনীতির বড় একটি অংশজুড়ে আছে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ। এই সম্পদ আহরণে নিবেদিত মৎস্যজীবীদের প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিকূল পরিবেশের। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারাতে হচ্ছে তাদের। উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের দাবি জীবিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের শতকরা ১৫.০৫ ভাগ সমুদ্র থেকে আহরণ করা হয়। (সূত্র : মৎস্য অধিদফতর)। এ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রের বুক থেকে মাছ ধরে আনা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে আকস্মিক ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে জেলেরা সমুদ্রে জীবনবাজি রেখে জীবিকা নির্বাহ করেন। আজ মাছ উৎপাদনে দেশের যে সাফল্য তার অংশীজন এই প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করা জেলেরাও। তাদের নিরাপদ জীবিকা ও উন্নত জীবনমানের দাবি দীর্ঘদিনের।

গত ৪০ বছরে কক্সবাজার, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণে গিয়ে সেখানকার মৎস্যজীবী মানুষের কথা শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। মনে পড়ে ২০০৭ সালে এক বৃষ্টির দিনে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় মহিপুর ফিশ ল্যান্ডিং স্টেশনে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মাছ ব্যবসায়ী ও জেলেদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলাম তাদের সুখ-দুঃখ এবং সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনে। সে সময় তারা বলেছিলেন, অতল সমুদ্রে ভেসে মাছ ধরতে গিয়ে আবহাওয়ার খবর জানার একমাত্র মাধ্যম রেডিও। কিন্তু অনেক ট্রলার মালিক ট্রলারে রেডিও রাখতে দিতেন না। কারণ, ঝড়ের পূর্বে জালে মাছ পড়ে বেশি। ঝড়ের খবরে ভয় পেয়ে জেলেরা আগেই ফিরে এলে লোকসান গুনতে হয়। আবার কেউ কেউ বলছিলেন, রেডিওতে যে সময় সংকেত দেওয়া হয়, সে সংকেত পেয়ে ফিরতে ফিরতে সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে, ৫ নম্বর মহাবিপদ সংকেত চলে আসে। এ ছাড়াও মোহনার নাব্যতা কম। বয়াবাতি, সংকেত বাতি না থাকায় অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলায় ঝড়ের কবলে অনেক জেলের জীবনহানি ঘটে।

জীবিকার তাগিদে জীবন হাতে নিয়ে সমুদ্র দাপিয়ে রুপালি মাছের অর্থনীতি রচনা করেছেন যে চঞ্চল নাবিকরা তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে আমাদের। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু সমুদ্র অর্থনীতির বিকাশে যাবতীয় জটিলতা দূর করতে উদ্যোগী হতে হবে। আজকের দিনে বৈরী আবহাওয়ায় কিংবা যে কোনো সংকটে যোগাযোগের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান খুব একটা কঠিন কাজ নয়

এসবের পাশাপাশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের দাবি ছিল মৎস্যজীবীদের। তাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আন্ধারমানিক নদীর দুই তীরে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র স্থাপন করে। গত বছর (২০২২) সেগুলো উদ্বোধন করা হয়। নদীর উত্তর তীরে মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আর দক্ষিণে আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। বিএফডিসির মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি উদ্বোধন হলেও মৎস্য ব্যবসায়ী আড়তদারদের সংখ্যা ও স্থান সংকুলানসহ নানা জটিলতায় চালু হয়নি দীর্ঘদিন। তবে আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে জেলে আর মাছ ব্যবসায়ীরা দারুণ উৎসাহে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। কয়েক মাস আগে আলীপুর ফিশ ল্যান্ডিং স্টেশনটি ঘুরে দেখে এসেছি। জেলে, আড়তদার আর মাছ ব্যবসায়ীদের হাঁকডাকে সরগরম। ট্রলার থেকে মাছ নামানো হচ্ছে। সেই মাছ তোলা হচ্ছে ডাকে। এরপর প্যাকেট হয়ে চলে যাচ্ছে সারা দেশের বাজারে।

সেখানে মৎস্যজীবীরা আমাকে জানালেন সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রায়ই ইলিশের একটি জাত চন্দনা ইলিশকে জাটকা ভেবে হয়রানি করেন। তারা আমাকে জাটকা এবং চন্দনা ইলিশ দেখালেন। বললেন, চন্দনা ইলিশকে কেউ-কেউ ‘সার্ডিন’, ‘চাকোরি’, ‘কলোম্বো’ ও ‘ডটেড গিজার্ড শাড’ নামেও চেনেন। এই মাছের গায়ের রং ইলিশের মতো সাদা হলেও পিঠ ইলিশের মতো সুরমা রঙের নয়। চোখ জাটকার চেয়ে বড়। ইলিশের চেয়েও চ্যাপ্টা। সাইজে জাটকার মতোই, কিন্তু আদতে পূর্ণবয়স্ক। দেখতে অনেকটাই ইলিশের কাছাকাছি হওয়ায় সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাটকা ভেবে আটকে দেয়। আবার ব্যবসায়ীরাও ক্রেতাদের কাছে ইলিশ বলে বিক্রি করে অধিক লাভ করে।

২০১৬ সালে এই অবতরণ কেন্দ্রগুলো নির্মাণ শুরুর সময় একবার আসার সুযোগ হয়েছিল। মূলত সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের অপচয় রোধ এবং মান অক্ষুণ্ন রেখে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতেই এই অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এই অবতরণ কেন্দ্রের পরিবেশ ততটা পরিচ্ছন্ন নয়। আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. শাকিল আহমেদ অবশ্য তাদের লোকবল সংকটের কথা বললেন।

নদীতীরে সারি সারি ট্রলার। সাগর থেকে মাছ ধরে ট্রলার ভিড়ছে ঘাটে। কথা হয় কয়েকজন মৎস্যজীবীর সঙ্গে। এই মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা যেমন অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ ও শঙ্কাময়। প্রায়ই মুখোমুখি হতে হয় ঝড়-ঝঞ্ঝার। যেন জীবনবাজি রেখে জীবিকার লড়াই।

২০০৭ সালে মৎস্যজীবীদের দাবিগুলোর প্রতিধ্বনি এখনো তাদের কণ্ঠে। তারা জানালেন, মোহনার নাব্যতা কম থাকায় ঝড় বা বন্যার সময় তাদের ঘাটে ফিরতে সমস্যা হয়। এখনো পর্যন্ত বয়াবাতি বা সংকেত বাতি না থাকায় অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলে ঝড়ের কবলে অনেক জেলের জীবনহানি ঘটছে।

জেলেরা আরও বলছিলেন, মা ইলিশ মাছ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ-এপ্রিলের দুই মাসের অভয়ারণ্যের নিষেধাজ্ঞা এবং সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে বছরে ১৪৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা পালন করতে হয় তাদের। নিষেধাজ্ঞাকালে খাদ্য সহায়তা হিসেবে চাল পেলেও তা অপ্রতুল বলে দাবি করেন জেলেরা। এ নিষেধাজ্ঞার সময়টি কমানোর দাবি তুলেন তারা। তারা বলেন, যেখানে ভারতে ৪০-৪৫ দিনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে, সেখানে আমাদের এখানে ৬৫ দিনের কেন? কয়েকজন জেলে জানালেন আমাদের সমুদ্রসীমায় ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের কথাও।

ঝড়-ঝঞ্ঝায় ভুল করে আমাদের জেলেরাও কখনো কখনো ভারতীয় সীমানায় ঢুকে পড়ে। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন এমন দুজন জেলের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তারা জানালেন, ঝড়ের কবলে পড়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতীয় সীমানায়। সেখান থেকে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিয়ে যান চব্বিশ পরগনায়। আটক ছিলেন তিন মাসের মতো। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তেমন তৎপরতা ছিল না বলেই এত দেরি হলো। অথচ ভারতের কোনো জেলে বাংলাদেশে আটকা পড়লে সাত-আট দিনের মাঝেই ফিরে যেতে পারে।

জীবিকার তাগিদে জীবন হাতে নিয়ে সমুদ্র দাপিয়ে রুপালি মাছের অর্থনীতি রচনা করেছেন যে চঞ্চল নাবিকরা তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে আমাদের। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু সমুদ্র অর্থনীতির বিকাশে যাবতীয় জটিলতা দূর করতে উদ্যোগী হতে হবে। আজকের দিনে বৈরী আবহাওয়ায় কিংবা যে কোনো সংকটে যোগাযোগের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান খুব একটা কঠিন কাজ নয়। সামুদ্রিক মাছের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে প্রয়োজন মাছ আহরণ থেকে বাজারজাত পর্যন্ত নিয়মবদ্ধ পরিচর্যাগুলোর অনুশীলন। সারা বিশ্বেই ব্লু ইকোনমির ধারণা বিকশিত হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর