রবিবার, ১৮ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বোবারা জনপ্রিয়, সত্যবাদীরা ঘৃণিত

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

বোবারা জনপ্রিয়, সত্যবাদীরা ঘৃণিত

এক. মার্চ ১৯৯৩। হাতে এসএলআর ক্যামেরা, এলোমেলো চুল, গলায় ঝুলছে রংবেরঙের লকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্রসাংবাদিক কেভিন কার্টার সুদানের দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকায় ক্যামেরা তাক করলেন শরীর থেকে মাংস ভেদ করে বেরিয়ে আসা হাড্ডিসার, অভুক্ত ও জরাজীর্ণ এক শিশুর দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল, শিশুটির ঠিক পেছনে খুব সন্তর্পণে নেমে এসেছে এক ক্ষুধার্ত শকুন। ধীরে ধীরে শিশুটির দিকে এগোচ্ছে ক্ষুধার যন্ত্রণায় বেপরোয়া হয়ে ওঠা শকুন। চোখে-মুখে তার আগুন, অথচ শিশুটিও যে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে সেটা বোঝার মতো অনুভূতি তো শকুনের থাকে না। হয়তো শকুনটা ভাবছে, কখন ‘ছোঁ’ মেরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে তার শিকারকে। শরীরটা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে খুবলে খুবলে ছিঁড়ে খাবে সংকুচিত মাংসগুলো।

খুব এক্সক্লুসিভ একটা দৃশ্য, যেখানে দুর্ভিক্ষে পতিত মানুষের ছবি চিত্রসাংবাদিকদের কাছে খুব লোভনীয় একটা বিষয়। লোভ কখনো কখনো মানুষের চিন্তাকে খেয়ে ফেলে, যদিও মানুষের কাছে অসহায় মানুষের আর্তনাদ পৌঁছে দেওয়ার লোভ আপাতদৃষ্টিতে মন্দ কিছু নয়।

ক্যামেরার ফ্লাশে চাপ দিতেই ক্লিক ক্লিক শব্দ করে কয়েকটা স্ন্যাপ ক্যামেরাবন্দি হলো। জন্ম হলো এক বিখ্যাত ছবির, যে ছবি কথা বলতে পারে, কিন্তু এমন কিছু গোপনও করে রাখে যখন সেটার জন্ম হয়, তখন তা বোঝা যায় না।

২৬ মার্চ, ১৯৯৩। ‘দ্য ভালচার অ্যান্ড দ্য লিটল গার্ল’ নামে কেভিন কার্টারের ছবিটি প্রকাশিত হলো আমেরিকার বিখ্যাত সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে। আমেরিকার সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সংগীতের সর্বোচ্চ পুরস্কার পুলিৎজারও ১৯৯৪ সালে পেয়েছিলেন তিনি।

এত বড় প্রচারণা, এত বড় পুরস্কার পেয়ে তিনি যখন সেগুলো উদযাপনে ব্যস্ত ছিলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার পুরস্কার প্রাপ্তি ও অবিস্মরণীয় সৃষ্টি নিয়ে যখন খবর বের হচ্ছিল, তখন সাধারণ মানুষের ভিতরেও কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছিল। সবার একটাই প্রশ্ন, শিশুটির শেষ পরিণতি কী হয়েছিল? সে কি শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়েছিল? নাকি কেভিন কার্টার শিশুটিকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন?

কথিত আছে, সে সময় টেলিফোন ইন্টারভিউয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্নগুলোই করেছিলেন একজন সাংবাদিক। কার্টার বুঝতে পারলেন, তিনি সৃষ্টির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে সৃষ্টির চেয়েও যে বড় মানবিকতা সেখানটায় এক ধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচয় হয়তো দিয়েছেন। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে অনেক খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরলেও তিনি সাংবাদিককে উত্তর দিলেন, শিশুটির শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল তিনি তা বলতে পারছেন না, কারণ উনার ফ্লাইট ধরার তাড়া ছিল।

টেলিফোনের অপর প্রান্তের সাংবাদিক তখন বলেছিলেন, আসলে সেদিন সেখানে দুটো শকুন ছিল, তার মধ্যে একজন শকুনের হাতে ক্যামেরা ছিল। এই কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করে কার্টার বিচলিত হয়ে পড়েন, গভীর অনুশোচনায় নিজেই পুড়তে পুড়তে অঙ্গার হতে থাকেন, শেষে অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেন। কারণ ক্যামেরা হাতে আরেক শকুনের ভূমিকায় কেভিন কার্টার স্বয়ং নিজেই ছিলেন, যেটা সে সময় তিনি বুঝতে পারেননি। শিশুটির সে সময় যদি মৃত্যু ঘটে, তবে এর দায় কেভিন কার্টার কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। কারণ সবকিছুর চেয়ে বড় মানুষের জীবন, সে জীবনকে তুচ্ছ ভেবে শিল্প বা পণ্য বানানোর অধিকার কারও নেই।

ভারতের বিখ্যাত আনন্দবাজার পত্রিকা পুরো ঘটনাটিকে বলেছে ক্যামেরার মৃত্যু। ক্যামেরাটা জড় পদার্থ, মৃত্যু ক্যামেরার হয়নি, মৃত্যু হয়েছিল ক্যামেরাকে পরাধীন করে রাখা মানুষের। আনন্দবাজার পত্রিকায় কেভিন কার্টারের সুইসাইড নোটে লেখা কথাগুলো তুলে ধরেছে এভাবে, ‘আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। জীবনের যন্ত্রণা সব আনন্দকে এতটাই ম্লান করে দেয় যে, আনন্দ বলে কিছু অনুভব করা যায় না। আমি অবসাদে ডুবে গিয়েছি। চারপাশে বড় দৈন্য... খুনের পর খুন, লাশের পাহাড়, মানুষের রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা, অভুক্ত ও জখম শিশু, বন্দুক-পাগল উন্মাদ, খুনি পুলিশ আর জল্লাদের দল যেন আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি চললাম বন্ধু কেনের সঙ্গে দেখা করতে, যদি ভাগ্যে থাকে।’

কেভিন কার্টারের আত্মহত্যা করাটা যুক্তিসংগত নয়, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, কাপুরুষরাই এমনটা করে থাকে। বরং সবচেয়ে ভালো হতো তিনি যদি তার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন। কারণ যখন তিনি ছবিটি তুলেছিলেন, তখন মুদ্রার একটা পিঠই তিনি দেখেছিলেন, মুদ্রার অপর পিঠটা দেখেননি। এটা পাপ, অপরাধ না অজ্ঞতা এর বিচার সময় করবে, মানুষ নিজে নয়।

আমাদের সমাজের অনেক মানুষই মুদ্রার দুই পিঠটা জেনেও সাধারণ মানুষের মুদ্রার একটা পিঠই দেখান। সাধারণ মানুষের যেটা দেখান সেটা দেখে মনে হতেই পারে, হয়তো এর মধ্যে ভালো কিছু আছে। সবটাই আসলে মিথ্যা, এক ধরনের হিপোক্রেসি।

মানুষ মাথায় হাত বুলালেই সেটা ভালোবাসা, ত্যাগ, মহত্ত্বের হাত হয় না, অনেক সময় মানুষের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ মানুষকে তার দাস বানায়। যে মানুষটা সাধারণ মানুষের টাকা চুরি করে বিদেশে বাড়ি, গাড়ি বানাচ্ছে, টাকা দিয়ে রাজনীতির ক্ষমতাকে কিনছে, ব্যাংকের মালিক হচ্ছে, পত্রিকা খুলে বসছে, সে মানুষটাই তার অপরাধকে আড়াল করতে দুই হাত ভরে টাকা ছড়িয়ে সমাজের মাথা হচ্ছে, নন্দিত নেতা হচ্ছে।

সাধারণ মানুষও বোকা, দুই মুখো সাপের একটা মুখ দেখেই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেগুলো প্রচার করে নিজেদের গর্বিত ভাবছে।

কিছুই বলার নেই, মানুষ যখন গিনিপিগ হয়ে যায়, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না, ল্যাবরেটরির পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটা নগণ্য বস্তু হয়ে যায়। আংশিক দেখে মানুষ এখন ভালোমন্দ বিচার করে, সত্য-মিথ্যা যাচাই করে, কারণ পুরোটা দেখার মতো চোখগুলো এখন আর খোলা থাকে না।

দুই. জালাল উদ্দিন রুমি খুব মূল্যবান একটা কথা বলেছেন, ‘আমি অনেক মানুষ দেখেছি যাদের শরীরে কোনো পোশাক নেই, আমি অনেক পোশাক দেখেছি যার ভিতরে মানুষ নেই।’

ছোটবেলায় স্কুলে চয়নিকা নামের একটি বই আমাদের পড়ানো হতো। কতগুলো ছোট ছোট গল্প সেই বইটিতে থাকত। সেখানে রাজার পোশাক সংক্রান্ত একটা গল্প ছিল। তখন গল্পটার মর্ম বুঝিনি, এখন বুঝি, তবে বোবা হয়ে থাকি। কারণ বোবার শত্রু নেই। সমাজের কাছে বোবারা জনপ্রিয়, সত্যবাদীরা ঘৃণিত। গল্পটা হুবহু মনে নেই, তবে গল্পটা মোটামুটি এরকম ছিল, এক রাজার খুব ইচ্ছা হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও দামি পোশাকটি তিনি পরবেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুজন ভালো দর্জির খবর পাওয়া গেল। তাদের দুজনকে রাজার পোশাক তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হলো। রাতদিন ধরে পোশাক বানানোর কাজ চলছে তো চলছেই, এতটুকু বিরাম নেই। দর্জিদের পোশাক বানাতে চাহিদারও শেষ নেই। রাজার পোশাক বলে কথা, তাই রাজার কোষাগার থেকে দেদার সোনা, রুপা, হীরা, জহরত, মণিমুক্তা, অর্থ যখন যা দরকার তা দর্জিদের চাহিদা অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে। দর্জিরা সবাইকে জানিয়ে দিল যারা মূর্খ ও পাগল তারা এই পোশাক দেখতে পাবে না। পোশাক ঠিকমতো তৈরি হচ্ছে কি না সেটা দেখার দায়িত্ব রাজা তাঁর একজন মন্ত্রীকে দিলেন। গভীর রাত অবধি সবার কানে পৌঁছাচ্ছে কাঁচির শব্দ।

মন্ত্রীর একদিন শখ হলো, দর্জিরা কীভাবে কাজ করছে সেটি দেখার। মন্ত্রী দেখলেন, দর্জিরা কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। এদের মধ্যে একজন শূন্যের ওপর কাঁচি চালাচ্ছে, আরেকজন সুই দিয়ে শূন্যের ওপর সেলাই করছে, কখনো কাপড় ভাঁজ করছে। মন্ত্রী কোনো কাপড় দেখতে পেলেন না, কিন্তু মনে মনে ভয় পেলেন, এখন যদি তিনি বলেন কোনো কাপড় দেখতে পাচ্ছেন না, তাহলে সবাই তাকে মূর্খ ও পাগল বলবে। তখন মন্ত্রিত্বের মতো লোভনীয় পদ হারাতে হবে। মন্ত্রীমশাই পোশাকের অনেক প্রশংসা করলেন। মন্ত্রীর পর আরও যারা পোশাক তৈরির কাজ দেখতে এলো, সবাই পোশাকের প্রশংসা করল।

পোশাক বানানোর কাজ শেষ হলে রাজা পোশাক দেখতে এলেন। দর্জিরা নানাভাবে পোশাকটি রাজাকে দেখাতে লাগল। আসলে রাজামশাই কিছুই দেখতে পেলেন না। কিন্তু মন্ত্রীমশাইয়ের মতো তিনিও ভয় পেলেন এই ভেবে যে, এত বড় রাজ্যের রাজা উনি, তিনি যদি বলেন কোনো পোশাক দেখতে পাচ্ছেন না, তখন তাকে সবাই মূর্খ ও পাগল ভাববে, প্রজাদের কাছে তার কোনো মূল্যই থাকবে না। তাই রাজা নিজেও পোশাকের ভূয়সী প্রশংসা করে দর্জিদের পুরস্কৃত করলেন।

রাজার খুব ইচ্ছা হলো, প্রজাদের মহাসমাবেশ করে তিনি এই পোশাক পরে বের হবেন। চারদিকে এ নিয়ে উৎসব উৎসব আমেজ সৃষ্টি হলো। রাজা দর্জিদের বানানো পোশাকে জনসম্মুখে এলেন। কেউ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু রাজাকে খুশি করতে সবাই পোশাকের প্রশংসা করতে লাগল। রাজা সবার এমন প্রশংসা শুনতে পেয়ে মহাখুশি হয়ে উঠলেন।

কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে একটা ছোট ছেলে বলে উঠল, ‘একি আমাদের রাজা যে ল্যাংটা।’ গল্পের শেষটা কী ছিল তা মনে নেই। হয়তো এখানে এসেই গল্পটা শেষ হয়েছিল বা আরও দুই-একটা লাইন ছিল।

তবে সবাই মিথ্যের ঘোরের মধ্যে থাকলেও ছোট ছেলেটা অপ্রিয় সত্য বলেছে। কারণ তার তখনো জ্ঞান হয়নি, অপ্রিয় সত্য কথা সবখানে বলতে নেই।

গল্পের মতো করে আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষ নিজে যা বিশ্বাস করে না, সেটি বিশ্বাস করার অভিনয় করে যাচ্ছে। নিজে যা মানছে না, সেটি মানার মিথ্যে দাবি করে যাচ্ছে। সত্য মিথ্যার ভিতরে, মিথ্যা সত্যের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে না, মানুষ কি মন্দকে ভালো বলছে, নাকি ভালোকে মন্দ বলছে। সারা পৃথিবীতে যেন এই মিথ্যের অভিনয় চলছে। বিষয়গুলো খুব সেনসেটিভ। তবে এখন আর বেশির ভাগ মানুষের শরীরেও পোশাক নেই, পোশাকের ভিতরেও মানুষগুলো নেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর