জেনেভা থেকে বাংলাদেশ বিমানের ম্যানচেস্টারের নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইটে দেশে ফিরছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণের কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি হাঁটতে থাকলেন। সাধারণ যাত্রীদের কাছে চলে গেলেন। যাত্রীরা চমকে ওঠে দেখলেন, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রী। সবার সঙ্গে কথা বললেন। শিশুদের আদর করলেন। কাউকে কোলে তুলে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অনেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুললেন। হলেন আবেগ আপ্লুত। এত কাছে প্রধানমন্ত্রীকে পাবেন কেউ ভাবতে পারেননি। কেউ বললেন, নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা। একটা সময় রিপোর্টার হিসেবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে সারা দেশ সফর করেছি। ’৮১ সালে দেশে ফিরে তিনি কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন। তিনি জানেন, কীভাবে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিতে হয়। মোকাবিলা করতে হয় ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এভাবে সবাইকে চমকে দিয়ে মানুষের ওপর আস্থা রেখে তিনি অতিক্রম করতে চান কঠিনতম পথ।
আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা এক থাকলে বরিশালের মতো ফল আসে। বিভক্ত হলে তৈরি হয় গাজীপুরের পরিবেশ। রাজনীতির নানা হিসাব-নিকাশ থাকে। আজকাল অনেকে ফিসফাঁস করেন। প্রশ্ন করেন দেশের অবস্থা কী? কেউ বলেন চারদিকে কী দেখছেন? সবকিছু ঠিক আছে তো? সেই দিন এক রিকশাচালক জানতে চাইল, তার আমেরিকা-ইউরোপ যেতে কোনো সমস্যা হবে কিনা। বুঝতে পারি পরিকল্পিত গুজবের ডালপালার প্রভাব পড়ছে সাধারণ পর্যায়ে। সবকিছু ঠিক না থাকার কী কারণ বুঝতে পারি না। বাঙালি কল্পনার ফানুস উড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। কান চিলে নিয়ে গেছে বলে ছুটতে থাকে। হাত দিয়ে নিজের কানও দেখে না। আবার কেউ নেমেছে সালিশ দরবারে। গ্রাম্য প্রবাদের মতো, নিজের মুরোদ নেই, ডেকে আনছে পাড়াপড়শিকে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে হিসাব-নিকাশের শেষ নেই দেশ-বিদেশে। গরিবের সুন্দরী বউ সবারই যেন ভাবী লাগে। ভোটের আরও ছয় মাস বাকি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের একটাই পথ নির্বাচন। যারাই জয়লাভ করবেন তারাই ক্ষমতায় বসবেন। রাজনৈতিক দল বারোমাস জনগণকে নিয়ে কাজ করে। জনগণ পছন্দের দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়। এই যুগে এ সময়ে আসমান থেকে কেউ কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয় না। দিতে পারে না। ৫০ বছর আগের বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি বদলে গেছে। ভূ-রাজনীতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। ক্ষমতায় বসতে হয়, আসতে হয় জনগণের ওপর ভর করে। জনগণ যাকে নির্বাচিত করবে তারাই ক্ষমতায় বসবেন। গুজব ছড়িয়ে, চারদিকে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের গন্ধ খুঁজে সাময়িক লাভ হয়। মানুষ মজা পায়। ভোট বর্জনে অর্জন আসে না। ১৯৭০ সালের ভোটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অংশ না নিয়ে মওলানা ভাসানীর মতো বর্জন করলে দেশ স্বাধীন হতো না।
আওয়ামী লীগ কর্মীরা এক থাকলে কোথাও কোনো সমস্যা দেখি না। দেশে রাজনৈতিক ধারা দুটি। একটি আওয়ামী লীগ। আরেকটি এন্ট্রি আওয়ামী লীগ। সামান্য ইস্যুতে আওয়ামী লীগ বিরোধীরা এক হয়ে ওঠে। বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান থাকলে কোনো সমস্যা হয় না। ঝামেলা হয় অভ্যন্তরীণ বিরোধে। আওয়ামী লীগ নিজের খেয়ে বিরোধ জিইয়ে রাখে। ভাবখানা এমন আমার অঞ্চল বাদ দিয়ে সারা দেশে নৌকা জিতুক। কেউ ভাবতে চান নিজের এলাকায় না জিতলে অন্যখানে কীভাবে জোয়ার তৈরি হবে? অনেক দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের ভিতরে একটা আয়েশি ভাব তৈরি হয়েছে। বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব এমনই। বাঙালিকে স্বর্গে রাখলে তারা হইচই করে। চিৎকার করে বলতে থাকে বের হতে দাও। ভালো দেখতে দেখতে ক্লান্তি এসেছে। স্বর্গের রক্ষীরা যখন প্রশ্ন করে তোমরা এমন সুখ-শান্তি রেখে বের হতে কেন চাও? জবাব আসে, স্বর্গ তো দেখলাম। নরক কেমন দেখতে হবে না? এ নিয়ে আরেকটি গল্পও আছে। নরক থেকে সাজা মাফ হয়েছে কয়েক হাজার মানুষের। সব দেশের মানুষ যাচ্ছে শৃঙ্খলা নিয়ে। বের হতে একজন সহায়তা করছে আরেকজনকে। আর বাঙালিরা কেউই সামনে যেতে পারছে না। কারণ পিছনে থাকা মানুষটি টেনে ধরে রাখছে সামনের জনকে। দিচ্ছে না এগোতে।
অভ্যন্তরীণ টানাটানির প্রতিযোগিতা না থাকলে কোনো কিছুতে সমস্যা নেই ক্ষমতাসীনদের। নেতা না, আওয়ামী লীগ কর্মীরা এক থাকলে বরিশালের ফল আসে। আর বিরোধে গাজীপুর তৈরি হয়। সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র ছিলেন পাঁচ বছর। নানা কারণে দল মনে করেছে তাকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হবে না। এমন সিদ্ধান্ত দল নিতেই পারে। চট্টগ্রামে পাঁচ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালনের পর আ জ ম নাছির মনোনয়ন পাননি। নির্বাচনের সময় নাছির নৌকার পক্ষে খেটেছেন। প্রার্থীকে জয়ী করে এনেছিলেন। বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাকে দলের দায়িত্বে রেখেছেন। সবাই আ জ ম নাছিরের মতো হবেন এমনটা আশা করি না। তারপরও রাজনীতিতে একটা শালীনতা বলে কথা থাকে। প্রথম দিনেই সাদিক আবদুল্লাহদের দায়িত্ব ছিল নৌকার পক্ষে কাজ করা। তিনি তা করেননি। পুত্রের জন্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ তার ভাইয়ের পক্ষে যে ভূমিকা নেওয়ার কথা, নেননি। তাদের অনুসারী নেতারা ঘর থেকে বের হতে নানামুখী টালবাহানা করেছেন। তারপরও বিজয় থেমে থাকেনি। কেন্দ্রীয় নেতারা বরিশাল গেলেন। তারা মাঠে বার্তা দিলেন, নেত্রী বরিশালে বিজয় দেখতে চান। প্রথম দিকে বিভ্রান্ত কর্মীরা ফের ঘুরে দাঁড়ালেন। তারা কাজ শুরু করলেন। ভোটের দিন দল বেঁধে নৌকায় ভোট দিলেন। পরাস্ত হলো অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র। কর্মীদের ঐক্য দৃঢ় অবস্থানের প্রকাশ মানুষ দেখল ভোটের ফলে।
রাজনৈতিক দলে অনেক মত ও পথ থাকে। সবাই একই চিন্তার হবেন কথা নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সরকারের ভিতরে সরকার হয়। দলের ভিতরে তৈরি হয় দল-উপদল কোন্দল। অনেকেই হারিয়ে ফেলেন বাস্তবতা। মাঠের কর্মীদের কোনো সমস্যা নেই। তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতি, শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দর্শনের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। দলের সভানেত্রীর প্রতি তাদের রয়েছে গভীর আস্থা। দলের প্রতিটি কর্মী শেখ হাসিনার শক্তি। খারাপ সময়ে নেতারা চুপসে গেলেও কর্মীরা থেকেছেন শেখ হাসিনার পাশে। ১৯৮১ সাল থেকে দলের ভিতরের প্রতিটি চক্রান্ত শেখ হাসিনা মোকাবিলা করেছেন কর্মীদের ভালোবাসা নিয়ে। ড. কামাল হোসেনের মতো নামিদামি বড় নেতারা অস্তিত্বহীন হয়েছেন চক্রান্তে জড়িয়ে। কলকাতার প্রথমা টিভির একটি রিপোর্ট দেখছিলাম। বিষয়বস্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য ও অবস্থান। রিপোর্টার বলছেন, ‘কতটা পায়ের নিচে মাটি শক্ত হলে একজন নেত্রী আমেরিকার বিরুদ্ধে এভাবে কথা বলতে পারেন। ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানই শেখ হাসিনার শক্তি ও সাহস। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন দেশের জনগণ। এ কারণে তিনি শুধু আমেরিকা নন, অনেক প্রতিবেশীকেও দেখিয়ে দিচ্ছেন সফলতার সঙ্গে কীভাবে দেশ চালাতে হয়। কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়।’
জল অনেক দূর গড়িয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিরোধ জিইয়ে রাখার মানে নেই। কূটনৈতিক সংকটের সমাধান কূটনৈতিকভাবেই করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূল কথা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। বিদেশে আমাদের কূটনীতিকদের আরও সোচ্চার হতে হবে সম্পর্ক বাড়াতে। সম্পর্ক তৈরি কঠিন। নষ্ট সহজ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অনেক বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করে আজকের অবস্থানে। কোনোভাবেই সম্পর্ক নষ্ট নয়, বাড়াতে হবে। উন্নয়ন সমৃদ্ধি ধরে রাখতে আমাদের আরও কৌশলী হতে হবে। দেশে সমস্যা নেই। বিদেশও ধরে রাখতে হবে। ভোট নিয়ে কথা হচ্ছে, হোক। সমস্যা দেখি না। গাজীপুর, বরিশাল, খুলনার ভোট প্রমাণ করল আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠান সম্ভব। এই দেশে গ্রহণযোগ্য ভোটের পরিবেশ তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা নিজে। সামরিক স্বৈরাচারী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে ভোট ও ভাতের আন্দোলন করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর মেয়ের পক্ষেই সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য ভোট উপহার দেওয়া। নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো সমস্যা নেই। গত সাড়ে ১৪ বছর এই দেশের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে গেছে। কেউ ভাবতেও পারেননি নদীর নিচে টানেল, পদ্মার ওপর ব্রিজ, রেল হবে। ঢাকা শহরে মেট্রোরেলে চড়ছে মানুষ। এখন কক্সবাজার যাবে রেলে চড়ে। পূর্বাচল সড়কটি দেখলে মন ভরে যায়। খ্যাতিমান সাংবাদিক এম জে আকবরকে পদ্মা সেতু দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বিস্ময় নিয়ে পদ্মা সেতু দেখলেন। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত হাইওয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, বাংলাদেশ বদলে গেছে। শেখ হাসিনা নতুন উচ্চতা দিয়েছেন বাংলাদেশকে। তিনি ঠিকই বলেছেন। বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। উন্নয়নে ভোট নেই এই কথা বিশ্বাস করি না। মানুষের কাছে কাজগুলো তুলে ধরতে হয়।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন