সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বই হোক এগিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

বই হোক এগিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার

গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের বিপরীত রাস্তা ধরে হরহামেশাই ইলিশিয়াম অফিসার্স কোয়ার্টারে যাতায়াত করতাম। উপচে পড়া ভিড়, প্রচন্ড যানজট, হকারদের বিরামহীন হাঁকডাক আর মাজার দর্শনার্থীদের ভিড়ের মধ্যে যেতে যেতে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রটির সাইনবোর্ড দু-একবার চোখে পড়লেও কখনো এর কী কাজ বা কীভাবে পরিচালিত হয় ভেবে দেখার আগ্রহ অনুভব করিনি। কিন্তু গ্রন্থ কেন্দ্রটির পরিচালক কবি সাংবাদিক, লেখক মিনার মনসুর সরকারি তিতুমীর কলেজে এসেছিলেন রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমাদের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌস আরা বেগম ও প্রফেসর ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকীর (রতন সিদ্দিকী) আমন্ত্রণে প্রধান অতিথি হয়ে।  তাকে জানার সুযোগ পেয়েছি, আমরা গৌরবান্বিত বোধ করেছি।

গত ১৩ জুন অধ্যক্ষ মহোদয়ের আচমকা ফোন পেয়ে এবং সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে আমি খুশি হয়ে ম্যাডামের সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত সেই ‘জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে’ চলে আসি। মিনার মনসুর যথার্থই বলেছেন, পুরো গুলিস্তানে এ গ্রন্থ কেন্দ্রটি যেন এক টুকরা মরূদ্যান। শুনেও ভালো লাগল। বস্তবতাও তেমনি।

চমৎকার এক ব্যতিক্রমী আয়োজন। ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্রন্থ পাঠে উদ্বুদ্ধকরণে পরিবারের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনা। যেখানে আমাদের সম্মানিত অধ্যক্ষ বিশেষ অতিথি হিসেবে আসন অলংকৃত করেছেন। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ম. হামিদ প্রধান অতিথি এবং গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর সভাপতির দায়িত্বে থেকে চমৎকার একটা আয়োজনের পথিকৃৎ হয়ে রইলেন। জেনেছি আয়োজনটি তিন দিনব্যাপী চলেছে।

বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়নি। খুব ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি শুধু নয় প্রাত্যহিক জীবনের পরতে পরতে সে অনুশীলন করেছি গভীর মনোযোগের সঙ্গে বইকে গভীরভাবে ভালোবেসে। নতুন বা পুরনো মলাটের হোক সেটা ডাল, চাল কিংবা মুড়ির ঠোঙা হোক যত্ন সহকারে খুলে পড়েছি। কল্পনার আকাশ যে সেই ছেলেবেলায় খুব বিস্তৃত ছিল তা কিন্তু নয়! তবে পড়ার আনন্দ ছিল সবটুকুন ভালোলাগা নিয়ে। আগ্রহের জায়গাটা আপনা থেকেই তৈরি হয়েছিল, আজও তার ঘাটতি নেই এতটুকুন। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ বিস্তার এবং সেই প্রবাহকে সেন্সর করতে না পারার অক্ষমতা নতুন প্রজন্মকে বইবিমুখ করে তুলেছে। তা ছাড়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর পাঠ্যপুস্তকের আলাদা একটা চাপ তো রয়েছেই বছরজুড়ে। তাই অপাঠ্য বইয়ের জগৎটা অজানাই থেকে যায়।

জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র- বইবিমুখ অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের কীভাবে বিচিত্র গ্রন্থের বিচিত্র চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে জীবনকে যাপনের উপযোগী করে তোলা যায় সেই লক্ষ্যেই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত লেখক, পাঠক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের সুধীজনদের আহ্বান করেছেন, যুক্ত করেছেন এক মনোজ্ঞ আড্ডায়। যেখানে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডা. মোহিত কামালের চমৎকার বক্তব্য উপস্থিত অডিয়েন্সকে সমৃদ্ধ করেছে। আপন অভিজ্ঞতা থেকে চমৎকার বক্তব্য তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শিক্ষক রূপা চৌধুরী। নতুন নতুন আইডিয়া দিয়েছেন উপস্থিত শিক্ষার্থী এবং তাদের মায়েরা; যারা লাইব্রেরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নিজেদের এবং পরিবারসহ আশপাশের লোকজনকেও আলোকিত করে যাচ্ছেন, বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলছেন। সমাজ বাস্তবতার চলমান ও অতীত ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করে সাহিত্যের জ্ঞান জীবনকে পরিপূর্ণ মানবিক মূল্যবোধে বিকশিত করে আত্মতুষ্টির জায়গাটাকে সুরক্ষিত করার প্রয়াস পায়। অবিকশিত জীবনের বিকশিত রূপ বইয়ের পাতায় পাতায় গ্রন্থিত থাকে, মুগ্ধ পাঠককে তীব্র আকর্ষণে হাতছানি দিয়ে ডাকে। জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়, খুলে দেয় অপার পৃথিবীর সুমহান দরজা। মনের জানালায় নির্মল হাওয়ার সঙ্গে শরতের সাদা মেঘ যেন পলকে পলকে উড়ে উড়ে চলে। বাস্তবাশ্রয়ী কল্পনার বর্ণবিভায় জীবন ক্যানভাস হয়ে ওঠে অপরূপ রঙে রঙিন।

বেহিসেবি জীবনতৃষ্ণায় চাই বেহিসেবি রসবোধে উজ্জীবিত প্রজ্ঞাময় কল্যাণময় মানবিকতায় পরিপূর্ণ এক শক্তিশালী প্রত্যায়ধর্মী আধার। যে তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম মলাটবন্দি কালো অক্ষরের অসংখ্য বই, শুধুই বই। চরিত্ররা যেখানে অবলীলায় সমাজের অলিগলি ঘিঞ্জি থেকে উঁচু তলার স্বপ্নস্পর্শী মানুষদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়।

আমাদের গোলটেবিল আড্ডায় গ্রন্থপাঠ বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশমালা উঠে এসেছে। প্রজন্মের প্রথম যারা শিক্ষার আলো হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছে, আমাদের অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌস আরা বেগম সেসব ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের সন্তান এবং অভিভাবকদের প্রতি মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সমাজ কাঠামোতে হঠাৎ বড়লোক হওয়া নব্য ধনিক শ্রেণির প্রতিও মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এসব নব্য ধনিক শ্রেণির না আছে সভ্যতা-ভব্যতা, না আছে ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়, শিক্ষা তো দূরের কথা। এসব পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা সঠিক motivation থেকে বঞ্চিত অবাধ অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচারে অভ্যস্ত। কিশোর গ্যাং, রেগিং, মাদক, সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এসব কোমলমতি কিশোর। যৌথ পরিবার নানা কারণে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়েছে, হচ্ছে। শিশুরা বেড়ে উঠছে স্নেহবর্জিত পরিজনহীন আত্মীয়বিহীন বাসায় গৃহপরিচারিকার অনাদর-অবহেলায়; মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়ে, টিভি সিরিয়াল অথবা অন্য কোনো সর্বনাশা অ্যাপের গভীর খাদে জড়িয়ে। সব মিলিয়ে শিশুদের অনিরাপদ পরিস্থিতির উত্তরণে ভাবতে হবে অভিভাবক এবং সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুরদের মতো ভবিষ্যৎ পড়তে পারা মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের, সংস্থার এবং ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের; আদরে-সাদরে স্নেহে-রুচিতে আগ্রহে চাষ করতে হবে কোমলমতিদের মননভূমি। পাড়ায়-মহল্লায় নির্বাচনী প্রচারণার মতো পাঠাগারের প্রচারণাও আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে।  হাতে নিতে হবে গঠনমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি। আশাবাদী আমাদের হতেই হবে। আজকের শিশুরাই আগামীর সুন্দর সম্ভাবনাময় পৃথিবীর কর্ণধার। প্রজন্মকে অধিক মানবিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সৃজনশীল, সহিষ্ণু এবং সর্বোপরি দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত উজ্জ্বল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে হলে ঘরে ঘরে জাগরণের বিপ্লব ঘটাতে হবে। সেই বিপ্লবে বই-ই হোক সবার প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।

লেখক : সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর