বুধবার, ২১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রতারণার ফাঁদ পাতা ভুবনে

আফরোজা পারভীন

প্রতারণার ফাঁদ পাতা ভুবনে

আমেরিকায় এসেছি দুই দিন হলো। ডালাসে মেয়ের সযত্ন পরিচর্যায় আছি। দেড় বছর পর এলাম। গেলবার এসেছিলাম সাউথ ডাকোটার ছোট্ট সুন্দর শান্ত শহর ভারমিলিয়নে। পেয়েছিলাম মেয়ে পারিজাতের রুমমেট শতাব্দীসহ কয়েকজন দেশি আর একঝাঁক মুগ্ধকরা বিদেশি মানুষের সান্নিধ্য। তাদের সঙ্গে বিস্তর ঘুরে বেড়িয়েছি, আড্ডা দিয়েছি। তাদের খুব মিস করছি! এবার যাত্রা মোটেও আরামদায়ক ছিল না। ঢাকা টু দুবাইয়ের প্লেনটাকে কোনোক্রমেই বিজনেস ক্লাস বলা চলে না। দুবাই থেকে ডালাসের যাত্রা ছিল মোটামুটি সুখকর। আমার অসুস্থতার কথা বিবেচনায় রেখে ছেলেমেয়ে যাত্রা নিরাপদ ও আরামদায়ক করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে আমার নিষেধ অমান্য করেই। তারপরও তারা পুরোটা পারেনি। আসলে আমরা যতই বলি, উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে গেছি, বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি কতটা উজ্জ্বল হয়েছে সেটা এখনো প্রশ্নাতীত নয়। নইলে সবচেয়ে রদ্দি বিমানগুলো বাংলাদেশে পাঠিয়ে উচ্চমূল্য নিতে পারত না বিদেশি বিমান কোম্পানিগুলো! ‘গরিবের বউ সবার ভাবি’ এ কথাই মনে পড়ল। হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’। আমরা এখন তলাবিহীন না হলেও, ঝুড়ির নিচটা বেশ পোক্ত হলেও বিদেশিরা তা কতটা মানে বা জানে! মানলে আর যাই হোক যাত্রী পরিবহনের বিমান আর একটু অন্তত ভালো দিত। এটা এক ধরনের ঠকানো!

ঢাকা বিমানবন্দরে একজন অল্পবয়সী মহিলা আমার পাশে এসে বসলেন। কথা বলতে শুরু করলেন। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, একা যাচ্ছি না সঙ্গে কেউ আছে। আমার ভগ্ন শরীর, হাতে লাঠি দেখে তার বুঝি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমি একা এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছি। তিনি দুবাই-এর একটা ক্লিনিকে কাজ করেন। স্বামী আর একমাত্র সন্তান দেশে ফেলে রেখে পরিবারকে একটু ভালো রাখা, নিজে ভালো থাকার জন্য বিদেশে কাজ করছেন। বললেন, ইতালিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একজন তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকে ব্লক করে দিয়েছে। অবাক হয়ে বললাম, চিনতেন? না, ম্যাসেঞ্জারে চেয়েছে। চাকরি দিয়েছে এমন অনেকের ছবি দেখিয়েছিল।

বললাম, এভাবে কেউ টাকা দেয়, কষ্টের টাকা! উনি সমবেদনার স্পর্শ পেয়ে ছলছল চোখে বললেন, সত্যিই খুব কষ্টের টাকা! বিদেশে থেকে খেয়ে না খেয়ে রোজগার করেছি। ভুল করেছি। ভয়ে স্বামীকে বলতে পারিনি। মনটা ভার হয়ে গেল। আমাকে তুলে দিতে ছেলে বউমা এসেছিল। তাদের বললাম ঘটনাটা। বললাম, এভাবে অজানা-অচেনা লোককে কেউ টাকা দেয়। আহারে বেচারা! ছেলে বলল, দেয়। অসংখ্য লোক দেয়। কতভাবে কত টাকা যে নেয় ভাবতেও পারবে না।

মনে পড়ল আমার পরিবারই তো একাধিক বার বড়সড়ো প্রতারণার শিকার হয়েছে। আমি নিজে হয়েছি দুবার। একবার টেলিফোনে আর একবার ম্যাসেঞ্জারে। দুবারই আমার দুই বন্ধুর নাম করে তাদের অসুস্থতার কথা বলে টাকা চেয়েছে। বন্ধুরা অসুস্থ, তাদের চিকিৎসা হচ্ছে না জেনে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে গিয়েছি। এই দুই বন্ধুর আত্মসম্মান বোধ আমার জানা। জানতে চাইলে টাকা নেবে না ভেবে যাচাই না করেই টাকা পাঠিয়ে তাদের জানিয়েছি। আর হায় হায় করে উঠেছে তারা। এখানে আসার আগের দিনও ঠকেছি। পার্লারের একজন মহিলাকে বাড়িতে ডেকেছিল আমার বউমা আমার জন্য। বলেছিলাম টাকা পয়সা ঠিক করে নিতে। মহিলা আগেও এসেছে। যতবার কত টাকা দিতে হবে জানতে চেয়েছে ততবারই বলেছে কোনো অসুবিধা হবে না। আগেও তো এসেছি। জানেনই তো কত নিই। বাসায় আসার পর আমিও জানতে চেয়েছি। একই কথা বলেছে। ধরে নিয়েছি আগে যা নিয়েছে তাই নেবে। একই কাজ করিয়েছি। কিন্তু কাজ শেষ করার পর সে যখন চার গুণ দাম হাঁকালো তখন হতভম্ব হয়ে গেলাম। একটু বিরক্তি প্রকাশ করাতে বলল, আগের চেয়ে ভালো জিনিস দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুই করার ছিল না। সে চার গুণ টাকা নিয়ে চিরকালের মতো ক্লায়েন্ট হারিয়ে চলে গেল। আর আমি নিজেদের নির্বুদ্ধিতায় ধিক্কার দিতে লাগলাম নিজেকে। কিন্তু যতই ধিক্কার দিই এসব অতি চতুর মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠার জন্য যে শিক্ষা দরকার হয় সেটা কখনই পাইনি বলে ঠকতেই থাকব। আর মনে মনে স্বপ্ন দেখব প্রকৃতি বিচার করবে।

দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। প্রতারণার আছে হাজারো কৌশল। প্রেম, বিয়ে চাকরি দেওয়া, বিদেশে নেওয়া, ব্যবসা দেওয়া, টেন্ডার দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দেওয়াসহ নানান সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে মানুষ নিয়ত মানুষকে ঠকাচ্ছে। হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা-পয়সা। কেউ কেউ নিচ্ছে নানান সুযোগ-সুবিধা। বোকারা ঠকছে নিয়ত। এক শ্রেণির মানুষের এটাই এখন ব্যবসা। এ নিয়ে তাদের কোনো যন্ত্রণা নেই, বরং মানুষকে বোকা বানিয়ে, সর্বস্বান্ত করে মজা লুটছে। আর প্রতারণার শিকার সর্বস্ব হারানো মানুষ আত্মাহুতি পর্যন্ত দিচ্ছে।

সমাজ এই বঞ্চিতদের দিকেই আঙুল তুলে বলছে, ও একটা আহাম্মক না হলে এই কাজ কেউ করে। মেয়ে হলে তো সর্বনাশ! সরাসরি আঙুল উঠছে তার চরিত্রের দিকে। বলছে, মেয়েটাই খারাপ, ও প্রতারণার শিকার হলো কেন। মেয়েদের দিকে আঙুল তুলছে মেয়েরাই বেশি। সবাই নয়, কেউ কেউ। ভুলে যাচ্ছে তারাও মেয়ে।

সম্প্রতি আমার এক প্রিয় বান্ধবী মারা গেছে। মেধাবী সুন্দরী সতেজ প্রাণবন্ত সংবেদনশীল আমার এই বন্ধু। প্রথমে শুনেছিলাম ও হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছে। ওকে দেখতে যাওয়ার জন্য যখন রওনা হয়েছি তখনই শুনলাম, পুলিশ ওর বডি নিয়ে গেছে পোস্টমর্টেম করতে। ও ডিপ্রেশনে ছিল, আত্মহত্যা করেছে।

আমার বয়সী একজন নারী কেন ডিপ্রেশনে যাবে, কেন আত্মহত্যা করবে, আমি ভেবে উঠতে পারছিলাম না কিছুতেই। ওর চরিত্রের সঙ্গে আত্মহত্যা যায় না মোটেও। এটা আমার জন্য মারাত্মক এক আঘাত যা আমি আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আর ও যদি ডিপ্রেশনে থাকে আমাদের কেন বলেনি, ওর হাসবেন্ড কেন আমাদের জানায়নি, একা একা কেন বাড়িতে ফেলে রেখেছিল কাউন্সিলিং না করে এগুলোও বড় প্রশ্ন। জানি আমাদের দেশে ডিপ্রেশন লুকিয়ে রাখার একটা টেনডেন্সি আছে। পরিবার সমাজ কেউই ভালো চোখে দেখে না। অথচ এটা তেমন কিছুই নয়। আমরা কেউই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না, আমরা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। সবার মধ্যেই কিছু না কিছু পাগলামি আছে। কিন্তু অধিকাংশ পরিবার আজও প্রাচীন ধ্যান-ধারণা আগলে বসে থাকে। তাই ডিপ্রেসড রোগী না পায় সংবেদনশীলতা না চিকিৎসা। এসব নিয়ে যখন মন ভীষণ খারাপ তখনই একটা কথা শুনে অবাক হয়ে যাই। হার্টঅ্যাটাক বা ডিপ্রেশন কিছুই না ওকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। আর সেটা নাকি করেছে ওর পরিবারের লোকজনই! আর এর পেছনে আছে প্রতারণার একটা বিশাল ইতিহাস।

ছোট প্রতারক মাঝারি প্রতারক বড় প্রতারকে ছেয়ে গেছে দেশ। বেশ কয়েকজন ধরাও পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এখন প্রতারক বিশ্বজুড়ে। গলার স্বর নকল করে পুরুষ মেয়ে সেজে, মেয়ে পুরুষ সেজে ঠকানো, বউ থাকতে মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া এখন সর্বজনীন কৌশল।

আমি ফেসবুকে আসার প্রথম দিকে বিদেশিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী ছিলাম। ভাবতাম ইংরেজিটা ভুলে গেছি। ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে ইংরেজির চর্চাটা ভালো হবে। তাই কোনো বিদেশির ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলে একসেপ্ট করতাম। নিজেও কাউকে কাউকে রিকোয়েস্ট পাঠাতাম। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই এদের আমার সন্দেহ হতে থাকে। প্রোফাইল চেক করে দেখি প্রায় সবাই সিঙ্গেল বা উইডো। তারা ম্যাসেঞ্জারে যেসব কথা বলতে থাকে তাতে আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠি। দুজন আমাকে গিফট পাঠাবে বলে ঠিকানা চায়। আমি স্ট্রেট না করে দিই।

কিন্তু তারা লেগেই থাকে। একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে আমি ব্লক করে দিই। মেইলেও মাঝে মাঝে অচেনা লোকদের কাছ থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত অফার পাই। অন্তত তিনজন আমাকে বিশাল অঙ্কের টাকা দিতে চেয়েছে। আমি সাবধান ছিলাম বলে কারও খপ্পরে পড়িনি। পরে জেনেছি এরা অনেকেই বাংলাদেশে থেকে বিদেশি সেজে টাকা হাতানোর জন্য এসব করে। এদের আছে নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির। যা সাধারণের অগম্য। আমার মতো চাকরি বাকরি শেষ করে শেষ বয়সে উপনীত একজন মানুষকে যদি ঠকানোর চেষ্টা করতে পারে তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এরা কী করে!

আমরা ছেলেবেলায় পরিবার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আদর্শ, নীতিবোধের শিক্ষা পেয়েছি। আমাদের পাঠ্যবইগুলোতে ছিল নীতিকথা। এখন যান্ত্রিকতার আগ্রাসনে টাকাই অধিকাংশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। খেটে খুটে নয়, যেনতেনভাবে টাকা-পয়সা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য মরিয়া। আর এই মরিয়া দৌড়ে অতি সহজ একটা উপায় প্রতারণা। তাই নিত্যনতুন প্রতারণার ফাঁদ পড়ছে ভুবনে। সে ফাঁদ বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হচ্ছে। মানুষ অন্ধের মতো পা রাখছে সে ফাঁদে।

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্ম সচিব

সর্বশেষ খবর