বুধবার, ২১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণার ঝুঁকি এড়াবেন কীভাবে

তপন কুমার ঘোষ

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণার ঝুঁকি এড়াবেন কীভাবে

অধুনা ডিজিটালমাধ্যমে আর্থিক লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। লেনদেন অনলাইনে সারতেই বেশি পছন্দ করে নতুন প্রজন্ম। কেনাকাটা থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল পরিশোধ বা টাকা আদানপ্রদান সবকিছুই এখন ঘরে বসে করা যায়। যে কোনো সময়। এমনকি ছুটির দিনেও। ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের সামগ্রিক আর্থিক লেনদেনের ৭৫ শতাংশ নগদ টাকাবিহীন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতারণার ঘটনাও কম নয়। প্রতারকদের পাতা ফাঁদে পড়ে অর্থ খুইয়েছেন অনেকে। গ্রাহকের অজ্ঞতা বা সরলতার সুযোগ নেয় প্রতারকরা। পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে অনেক প্রতারক। এর পরও থেমে নেই। নতুন নতুন কৌশল নিয়ে হাজির হয় প্রতারকরা। লোকলজ্জার ভয়ে প্রতারণার ঘটনা অনেকে প্রকাশ করতে চান না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ না করলে প্রতিকার মিলবে কীভাবে?

সাম্প্রতিক ঘটনা। অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি ফোন করে একজন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীকে বলেন, তার (ব্যবহারকারীর) মোবাইল অ্যাকাউন্টে ভুল করে টাকা ঢুকে গেছে। অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। তবে সমস্যা নেই। ব্যবহারকারীর মোবাইল ফোন থেকে সামান্য কয়েকটি কাজ করতে হবে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সচল হয়ে যাবে বন্ধ ফোন। টেলিফোনের অন্য প্রান্তের লোকটির কথাবার্তা শুনে তাকে ভদ্র ও বিনয়ী মনে হয়েছে মোবাইল ব্যবহারকারীর। ঘুণাক্ষরেও তার মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। সরল বিশ্বাসে ফোন করা ব্যক্তির কথামতো কাজ করতে থাকেন তিনি। একসময় আঁচ করতে পারেন প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়ে গেছে। মিশন সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারক চক্র টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ওই নম্বরে বারবার টেলিফোন করেও আর সংযোগ পাওয়া যায়নি। কয়েক জায়গায় অভিযোগ করেও উদ্ধার হয়নি খোয়া যাওয়া অর্থ।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণার ঝুঁকি কমাতে আইটি বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দেন। এগুলো অবহেলা করা যাবে না। পরামর্শগুলো একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেলিফোনে আলাপের সময় প্রতারণার ঘটনা আঁচ করতে পারলে কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দিতে হবে। অপরিচিত কারও কাছ থেকে আকর্ষণীয় উপহার বা বড় অঙ্কের লটারি জেতার মেসেজ পেলে বুঝবেন বিপদ খুব বেশি দূরে নেই। খুশিতে আটখানা না হয়ে বিশ্বস্ত দু-এক জনের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। মিথ্যা প্রলোভনে না ভুলে এসব প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ ভুক্তভোগীদের।

অনেক সময় আমরা একই পাসওয়ার্ড সব অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করি। যেমন কম্পিউটার, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ও এটিএম কার্ডে। এটা ঝুঁকিপূর্ণ। সব অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করার পরামর্শ দেন আইটি বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া পাসওয়ার্ড হতে হবে শক্তিশালী। এর অর্থ হচ্ছে সংখ্যা, অক্ষর ও বিভিন্ন চিহ্নের সমন্বয়ে গঠিত পাসওয়ার্ড। উদ্দেশ্য, পাসওয়ার্ড যেন কমন না হয়। কেউ যেন আঁচ-অনুমান করতে না পারেন। মাঝেমধ্যে পাসওয়ার্ড বদলানো উচিত। আইটি বিশেষজ্ঞরা দুই স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দেন। এক. শক্তিশালী পাসওয়ার্ড; দুই. ওয়ান টাইম পিন (ওটিপি)। পাসওয়ার্ড ও ওটিপির গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। অ্যাকাউন্ট লগইন করার সময় পাসওয়ার্ড প্রয়োজন হয়। আবার দুই স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থায় অ্যাকাউন্টে লেনদেনের সময় ওটিপি প্রয়োজন। গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য গ্রাহকের মোবাইল ফোন বা ইমেইলে ওটিপি পাঠানো হয়। এগুলোর গোপনীয়তা রক্ষিত না হলে যে কেউ অ্যাকাউন্টে প্রবেশের সুযোগ পায়। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড হাতছাড়া করা খুবই বিপজ্জনক। কার্ড হারিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্লক করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জানাতে হবে। কার্ডের পাসওয়ার্ড/পিন কারও সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। মোবাইল ফোনে পাসওয়ার্ড/পিন সেভ করে রাখা ঠিক নয়।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গ্রাহকস্বার্থ সংরক্ষণে গ্রাহকের কী করা উচিত আর কী করা অনুচিত, এ বাপারে নানা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, অনেক সময় বন্ধু সেজে দেশবিদেশ থেকে উপহার বা পার্সেল পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। লটারির পুরস্কার পাওয়ার কথা বলা হয়। সুকৌশলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের মূল্যবান তথ্য জেনে নেয় প্রতারকরা। গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, কখনোই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের গোপন তথ্য (অ্যাকাউন্ট নম্বর, ব্যালান্স, চেকবই, টাকা পাঠানোর পরিমাণ, পাসওয়ার্ড, ওটিপি) অন্য কাউকে জানানো যাবে না। ব্যাংক বা কোনো আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সেজে নানা অজুহাতে অ্যাকাউন্টের তথ্য ও পিন নম্বর চাইতে পারে প্রতারকরা। অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখাতে পারে। মাথায় রাখতে হবে, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কখনোই গ্রাহকের কাছে গোপনীয় তথ্য চাওয়া হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনো গ্রাহকের সঙ্গে সরাসরি কোনো ধরনের ব্যাংকিং লেনদেন করে না।

এসব নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু সরল বিশ্বাসে বা প্রলোভনে পড়ে অনেক সময় আমরা ভুল করি। ভুলের চড়া মাশুল দিতে হয়। তখন আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকে না। কথায় বলে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। বহু চোর পালিয়েছে। কিন্তু আমাদের বুদ্ধি বাড়ছে কই? ‘সাবধানের মার নেই।’

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর