সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিনিয়োগের এত সহজ রিটার্ন আর কোথাও আসে না

ড. এ কে আবদুল মোমেন

বিনিয়োগের এত সহজ রিটার্ন আর কোথাও আসে না

বাংলাদেশ বিপুল সম্ভাবনার দেশ। সুদূর অতীতে এ দেশের সৌন্দর্য এবং সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আরব ও ইউরোপ থেকে বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এ দেশে আসত। এখন সে অবস্থার আরও উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীর অত্যন্ত কাক্সিক্ষত গন্তব্য বাংলাদেশের বাজার। কারণ বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ রয়েছে। নিশ্চয়তা আছে সব ধরনের অবকাঠামোগত সুুবিধার। এখানে বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ভৌগোলিকভাবেও বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। দক্ষিণ এশিয়ার বিনিয়োগ কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বাজার হতে পারে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দায়িত্ব নিয়েই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাঁর সরকারের নিরলস পরিশ্রমে বিদ্যুৎ, আইসিটি এবং যোগাযোগ খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, তৃতীয় সমুদ্রবন্দরসহ ছোট-বড় অসংখ্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মহেশখালীতে দেশের প্রথম দুটি (প্রতিটি ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন) ভাসমান LNG টার্মিনাল স্থাপন কার্যক্রম ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে।

একটি দেশের বিনিয়োগের জন্য চাই উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থা। শেখ হাসিনা সরকার দেশের সড়ক যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহন খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নীত হয়েছে। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। গত ১০ বছরে ৩৩০ কিমি. নতুন রেললাইন নির্মাণ ও ১ হাজার ১৩৫ কিমি. সংস্কার/পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে দেশের অভ্যন্তরে এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। চট্টগ্রাম ও  মোংলা সমুদ্রবন্দর অত্যাধুনিক সমুদ্রবন্দর হিসেবে গড়ে উঠেছে। দেশের ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১৩টিতে শিল্প উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং আরও ১৫টি নির্মাণাধীন রয়েছে। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে ২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক বিনিয়োগ ১০০ কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে, ২০১৫ সালে তা ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায় এবং বর্তমানে তা ৩৮৯ কোটি মার্কিন ডলার।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বিনিয়োগবান্ধব জায়গা। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি শিল্পাঞ্চলগুলোকে পরিবেশবান্ধব করায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বর্তমান সরকার। ভৌগোলিকভাবেও দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপসহ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ গন্তব্য হতে পারে বাংলাদেশ। কাজেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে আমাদের সমুদ্র, সড়ক ও আকাশপথ ব্যবহার করতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির কেন্দ্র হয়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। পূর্ব এশিয়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এবং ভারতের ব্যবসার অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক হাব হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। গতানুগতিক খাতের বাইরে বাংলাদেশের শিক্ষা, হালকা শিল্প, ইলেকট্রনিকস, গাড়িশিল্প, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করার এখনই সময়।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার একটু কমে এলেও অচিরেই তা আবারও ঊর্ধ্বগামী হবে। করোনার মধ্যে বিশ্বের বড় বড় দেশ যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, বাংলাদেশ সেখানে অত্যন্ত সক্ষমতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে ৭ শতাংশ। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ও যেমন বেড়েছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। নিত্যনতুন পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছে বাজারে। এসব উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী দিকনির্দেশনার ফলে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বর্তমানে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনকারী দেশ। বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ দেশ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে পঞ্চম এবং মৎস্য উৎপাদনে চতুর্থ। বিভিন্ন শস্য ও ফলের জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে এ খাতে দেশ আরও এগিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও রয়েছে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন। ২০০৯ সালের পরই তৃণমূলের শতভাগ মানুষের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে গেছে। বর্তমানে গোটা দেশ ডিজিটাল সুবিধা ভোগ করছে, ফলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ যে উদার বিনিয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অর্থনৈতিক এলাকায় কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ১৫টি নির্মাণাধীন রয়েছে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের জন্য রয়েছে পৃথক দুটি অর্থনৈতিক এলাকা। বেশ কয়েকটি হাইটেক পার্কও প্রস্তুত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে দেশ যেমন উন্নয়নের মহাসোপানে এগিয়ে চলেছে, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণের উত্তম ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।

দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলও বিষয়টি খুব গভীরভাবেই অবগত এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে নিবিড়ভাবে। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সহজলভ্য, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে সরকার। পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্য আইনি সুরক্ষা, উদার রাজস্ব ব্যবস্থা, মেশিনপত্র আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়, আনরেস্ট্রিকটেড এক্সিট পলিসি, সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ও পুঁজি নিয়ে চলে যাওয়ার সুবিধাসহ নানাবিধ সুবিধা রয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশে আগের তুলনায় বিনিয়োগও বাড়ছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে বিদেশি বিনিয়োগের এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।

বাংলাদেশের বিনিয়োগ অবাধ ও বহুমুখী করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ ব্র্যান্ডিংয়ে যুক্ত হয়েছে ‘বিনিয়োগ বিকাশ’ কর্মসূচি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে এ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগের ফলে দেশে বিনিয়োগে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ‘বিনিয়োগ বিকাশ’ বহির্বিশ্বে এমনভাবে ব্র্যান্ডিং করা হবে যাতে বিদেশিরা এ দেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। এ ছাড়া দেশি উদ্যোক্তাদেরও আস্থা ফিরিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে।

বিনিয়োগ বিকাশ কর্মসূচির আওতায় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতোমধ্যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিনিয়োগের প্রধান বাধাগুলো কী তা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব বাধা দূর করে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় শিল্পনীতিও বিনিয়োগবান্ধব করা হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত জাতীয় শিল্পনীতির খসড়ায় বলা হয়েছে- কোনো বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে ১০ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বা প্রায় ৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে অথবা কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে ২০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি টাকা স্থানান্তর করলে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সরকারের এ উদ্যোগকে বিদেশিরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। এ ছাড়া ভারত, চীন, জাপান ও কোরিয়ার বিনিয়োগ বাড়াতে ওই দেশগুলোর জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চল সংরক্ষণ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন। এ ছাড়া দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ৩০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। শুধু তাই নয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ জোর গতিতে এগিয়ে চলছে। এর ফলে দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে প্রায় ১ কোটি মানুষের।

বিনিয়োগ বিকাশ কর্মসূচি ছাড়াও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন শেখ হাসিনা। সেগুলো হচ্ছে- একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কমিউনিট ক্লিনিক ও শিশু বিকাশ এবং সামষ্টিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। এসবের সঙ্গে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বিনিয়োগ বিকাশ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির বাইরে পরিবেশ সুরক্ষা নামে আরও একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছায় এসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যা ‘শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ’ নামে পরিচিত। এসব কর্মসূচি গ্রহণের ফলে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে বহুলাংশে। এ ছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা (এসডিজি) আগামী ১৫ বছরের মধ্যে পূরণ করতে হলেও এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন বাজেটেও বিশেষ কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। বিদ্যমান বিনিয়োগের সক্ষমতা বাড়িয়ে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে।

দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে শেখ হাসিনার দৃঢ় অঙ্গীকার ও বিভিন্ন গণমুখী উদ্যোগের মধ্যে ১০টি ক্ষেত্রকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো হবে।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমপুঞ্জীভূত মূলধন বাড়ানো। গত ১০ বছরে মোট বিনিয়োগ বেড়ে জিডিপির ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হলেও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২১ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে সীমিত রয়েছে। এ বাস্তবতায় সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা দূর করে মধ্য মেয়াদে তা জিডিপির ২৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে। একই সময়ে সরকারি বিনিয়োগও জিডিপির ৭ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

উন্নত অর্থনীতি ও সক্ষম বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে মোটা দাগে সরকারের কৌশল হচ্ছে- উপযুক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়ন, গণদ্রব্য ও সেবার জোগান বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একীভূত হওয়া, উৎপাদন বিশেষায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা। আর এগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করা। বিনিয়োগে অগ্রাধিকার প্রদান করা। সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও প্রবৃদ্ধি সহায়ক খাতগুলো অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো খাত বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন, যোগাযোগ, বন্দর উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইসিটি খাতে অধিকতর সম্পদ সঞ্চালন করা। এ ছাড়া পরিবহন খাতে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোকে চার লেনে উন্নীতকরণের চলমান কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার পদক্ষেপ রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন রাস্তা দ্রুত সম্পন্ন করার মতো বিষয় রয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে জোর দেওয়াসহ দ্রুত সময়ের মধ্যে বৃহৎ আট প্রকল্পের কাজ শেষ করা।

বাংলাদেশে এ অঞ্চলের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে বিস্তৃত সুযোগ-সুবিধা, আকর্ষণীয় প্রণোদনা নীতি এবং ধারাবাহিক সংস্কার প্রক্রিয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে শিল্প, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২৮টি হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য তাঁর সরকারের দেওয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লুফে নিতে বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর সরকার বাংলাদেশে একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে অবকাঠামো উন্নয়নসহ সব নীতি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিনিয়োগের জন্য বিশেষ সম্ভাবনাময় ১১টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব হচ্ছে- অবকাঠামো, পুঁজিবাজার ও ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিকস উৎপাদন, চামড়া, স্বয়ংক্রিয় ও হালকা প্রকৌশল, কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ, পাট-বস্ত্র এবং ব্লু-ইকোনমি। এসব খাতে যথাযথভাবে কাজ করা গেলে বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি হবে এবং বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ আকর্ষণে সক্ষম হবে।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিন দফা নির্বাচনে জয়লাভের ফলে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দক্ষ-পরিশ্রমী জনসম্পদ সৃষ্টি, আকর্ষণীয় প্রণোদনার মাধ্যমে উদার বিনিয়োগ-নীতি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল বাজারের মধ্যবর্তী ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি আস্থার ফলে ৬০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে। শেখ হাসিনা সরকার ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’কে প্রাধান্য দিয়ে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৮টি দেশে একতরফা শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। ৩৬টি দেশের সঙ্গে দ্বৈত-করারোপণ পরিহার চুক্তি বলবৎ আছে। সরকার বিভিন্ন বাণিজ্য জোটের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে।

বাংলাদেশ বিশ্বে এখন উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিত। আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাক্সিক্ষত মান অর্জনের জন্য ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি। দেশে ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের ১২ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আহরণের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারের আইটি পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন করার জন্য জাতীয় শিল্পনীতিসহ খাতওয়ারি শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্রম (সংশোধন) আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পের প্রবৃদ্ধির জন্য বন্ড ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশন করা হচ্ছে।

শেখ হাসিনা সরকার দেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ‘বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব আইন, ২০১৫’ প্রণয়ন করেছে এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে ৭৯টি পিপিপি প্রকল্পে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৬’ প্রণয়ন এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করতে কর রেয়াত দেওয়া হচ্ছে, মূলধনী সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকার গৃহীত পদক্ষেপের ফলে দেশে ইতোমধ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। ‘২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে আসা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ছিল ২ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ (৪.৭১ বিলিয়ন) ডলারের এফডিআই এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের বছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ বেড়েছে ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ সময়ে দেশে মোট এফডিআই এসেছে ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার, আগের বছর একই সময়ে যেখানে এসেছিল ৩৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পেছনের নেপথ্য কারিগর হলো জাতির জনকের কন্যা এ দেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য একটি আদর্শ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি সব সময় এবং এরই মধ্যে সফলও হয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশমুখী বিনিয়োগের স্রোত দেখেই তা সহজভাবে অনুধাবন করা যায়। বাংলাদেশ আজ উন্নত অর্থনীতির দিকে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগের যে অভূতপূর্ব পরিবেশ দেশে তৈরি করেছে বর্তমান সরকার, এর সুফল পাচ্ছে গোটা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিনিয়োগকারীরা। সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ।

 

লেখক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

সর্বশেষ খবর