মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

হজ ও কোরবানির অর্থনীতি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

হজ ও কোরবানির অর্থনীতি

ঈদ উৎসবে উৎসর্গের সব আয়োজন আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সামাজিক সমতা-সখ্য বৃদ্ধি এবং সম্পদ, সুযোগ ও সৌভাগ্যকে বণ্টন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা, ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। আত্মশুদ্ধির জন্য উৎসর্গ বা সংহার প্রকৃত প্রস্তাবে খোদাভীতি ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে জীবে প্রেম বা দয়া ও সেবার প্রেরণা।

ঈদুল আজহা উদযাপনে পশু উৎসর্গের মধ্যে রয়েছে বিশেষ আর্থসামাজিক তাৎপর্য। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর উদ্দেশে উৎসর্গ করার ইচ্ছা প্রকাশের মহান স্মৃতি স্মরণ করে ইতিহাসের ধারাবাহিতায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে নিজের পাশব প্রবৃত্তি, অসৎ উদ্দেশ্য ও হীনমন্যতাকেই কোরবানি করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই বিশেষ ঈদ উৎসবে নিজের চরিত্র ও কুপ্রবৃত্তিকে সংশোধন করার সুযোগ আসে। জীবজন্তু উৎসর্গ করাকে নিছক জীবের জীবন সংহার হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি আত্মশুদ্ধি ও নিজের পাশব প্রবৃত্তিকে অবদমন প্রয়াস-প্রচেষ্টারই প্রতীকী প্রকাশ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিবেচনায় ‘আজ আল্লাহর নামে জান-কোরবানে ঈদের মতো পূত বোধন/ওরে হত্যা নয় আজ সত্য-গ্রহ শক্তির উদ্বোধন’ সামাজিক কল্যাণ সাধনে সংশোধিত মানবচরিত্র বলের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোরবানির মাংস গরিব আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান, তার মধ্যে নিহিত রয়েছে সামাজিক সমতার মহান আদর্শ।

এ উৎসবকে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘বক্রি ঈদ’ এবং ব্যবহারিক অর্থে ‘কোরবানির ঈদ’ও বলা হয়। বক্রি ঈদ বলার কারণ এ ঈদে খাসি কোরবানি করা হয়, আবার ‘বাকারা’ বা গরু কোরবানির ঈদ হিসেবেও ভাবা হয়। আরবি পরিভাষায় এ ঈদকে বলা হয় ‘ঈদুল আজহা’ বা আত্মত্যাগ বা উৎসর্গের উৎসব। সুতরাং ঈদুল আজহার তাৎপর্যগত বৈশিষ্ট্য বিচারে এ উৎসব পালনে গরু বা পালিত পশু খোদার সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ বা কোরবানি করা। আর এ কোরবানির আগে পবিত্র হজ পালনের প্রসঙ্গটিও স্বতঃসিদ্ধভাবে এ উৎসবের সঙ্গে এসে সংযুক্ত হয়। ঈদুল আজহার এ উৎসব হজ পালন ও পশু কোরবানিসূত্রে সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যবাহী প্রভাব ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

হজ পালন ঈদুল আজহা উৎসবের একটি বিশেষ অংশ। পবিত্র হজ অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের মুসলমানরা সমবেত হন এক মহাসম্মিলনে। ভাষা ও বর্ণগত, দেশ ও আর্থিক অবস্থানগত সব ভেদাভেদ ভুলে সবার অভিন্ন মিলনক্ষেত্র কাবা শরিফে একই পোশাকে, একই ভাষায় একই রীতি-রেওয়াজের মাধ্যমে যে ঐকতান ধ্বনিত হয় তার চাইতে বড় ধরনের কোনো সাম্য-মৈত্রীর সম্মেলন বিশ্বের কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না। হজ পালনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রং ও গোত্রের মানুষের মধ্যে এক অনির্বচনীয় সখ্য সংস্থাপিত হয়। বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের যা অনুপম আদর্শ বলে বিবেচিত হয়।

ঈদুল আজহা উদযাপনে অর্থনীতিতে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ, শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রসার ঘটে। এ উৎসবে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনসহ বহুমুখী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় যা গোটা অর্থনীতি তথা দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় শনাক্তযোগ্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

হজ পালন উপলক্ষে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুলসংখ্যক অর্থ লেনদেন হয়। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রীদের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। হাজিদের যাতায়াতসহ সেখানকার ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রায়ই নির্বাহ হয়। এর সঙ্গে এ হজের ব্যবস্থাপনাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা ব্যয়ের সংশ্লেষ থাকে, ব্যাংকিং সেক্টরে এ উপলক্ষে লেনদেন ও সেবাসূত্রে ব্যয় বাড়ে। গোটা সৌদি আরবের অর্থনীতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই হজ মৌসুমের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে বা অবলম্বন করে আবর্তিত হয়ে আসছে।

ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক আর্থিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৯ সালে ঈদুল আজহার অর্থনীতি ছিল (পিআরআইয়ের তথ্যমতে) ৪৫ হাজার কোটি টাকা; সেবার ১.০৫ কোটি গবাদি পশু জবাই হয়েছিল, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মতে, গবাদি পশু বিক্রি হয়েছিল ২৮ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার; বাকি ১৫-১৬ হাজার কোটি টাকা ছিল পরিবহন, পর্যটন ও পণ্যাদি বিক্রি থেকে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবমতে, ২০২০ সালে কোরবানির জন্য তৈরি প্রাণীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ।

কোরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমার ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় চাঁদা, টোল, বকশিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাসিল, পশুর হাট ইজারা, চাদিয়া, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও কসাইয়ের খরচ এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতবদল হয়। অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফরমাল-ইনফরমাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়।

কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকাশিল্পে, পোশাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ চামড়া সংগ্রহ-সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি বছর প্রায় ৮০০ কোটি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো ১০০-১২০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে। চামড়া ব্যবসাকে উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনে প্রকাশ, প্রতিবেশী দেশ থেকে বাকিতে গরু সরবরাহ করা হতো কম দামে কাঁচা চামড়া পাচারের প্রত্যাশায়। সেই চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করে বেশি দামে বিদেশে রপ্তানির মুনাফা অর্জন হতো তাদের। এবার এ খাতে সে সুযোগ বাংলাদেশকে কাজে লাগাতে হবে। দেশে নিজেদের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং উপযুক্ত মূল্যে তা রপ্তানির প্রণোদনা সৃষ্টি করেই এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি লাভ ঘটতে পারে। লবণ চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান। সরকারকে সাধারণত প্রায় ৪০ হাজার টন লবণ শুল্কমুক্ত আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়; যাতে সিন্ডিকেট করে লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরি না হয়।

কোরবানির পশুর মাংস আমিষ-জাতীয় খাদ্যের উপাদান এবং এ মাংসের বিলি-বণ্টন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আর্থসামাজিক তাৎপর্য। ধনীদরিদ্রনির্বিশেষে বছরের একটি সময়ে সবাই আমিষপ্রধান এ খাদ্যের সন্ধান/সরবরাহ লাভ করে থাকে। মাংস রান্নার কাজে ব্যবহৃত মসলা বাবদ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় এ সময়ে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সব লেনদেনে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বাড়ত, তারল্য সংকটে পড়ে যেত আর্থিক খাত, কল মানি মার্কেট থেকে চড়া সুদে ধারকর্জে নামত ব্যাংকগুলো। চামড়া ঋণ থেকে শুরু করে ঈদের বোনাস বাবদ বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যেত। এ সময়ে অবধারিতভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়। ঈদ উপলক্ষে পরিবহনব্যবস্থায় বা ব্যবসায় ব্যাপক কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। শহরের মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে ছোটে। এক মাস আগে থেকে ট্রেন-বাস-লঞ্চের টিকিট বিক্রির তোড়জোড় দেখে বোঝা যায়, এর প্রসার ও প্রকৃতি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পরিবহন খাতে সাকল্যে ২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি ব্যবসা বা লেনদেন হয়। এও অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।

এটা ঠিক অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ, মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকান্ডের প্রসারই অর্থনীতির জন্য আয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মুদ্রা সরবরাহ গতিশীলতা আনয়ন। ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে যে কোনো ব্যয় অর্থনীতির জন্য আয়। দেশজ উৎপাদনে এর থাকে অনিবার্য অবদান। যে কোনো উৎসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতিশীলতা আনয়ন করে, মানুষ জেগে ওঠে নানান কর্মকান্ডে, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থায় একটা স্বতঃপ্রণোদিত আবহ সৃষ্টি হয়। এ আবহকে স্বতঃস্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়ায় কঠোরভাবে দেখভাল করতে পারলে অর্থাৎ সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও পারঙ্গমতা দেখাতে পারলে এ কর্মকান্ড, এ মুদ্রা সরবরাহ, ব্যাংকের এ তারল্য তারতম্য, পরিবহন খাতের এ ব্যয়প্রবাহ একে স্বাভাবিক গতিতে ধরে রাখতে পারলে অর্থনীতির জন্য তা পুষ্টিকর প্রতিভাত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারত।

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর