মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

পবিত্র হজের ইতিহাস

এম এ মান্নান

পবিত্র হজের ইতিহাস

হজ বলতে বোঝায় মিল্লাতে ইব্রাহিম বা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাবাকেন্দ্রিক বিশেষ ধরনের ইবাদতকে। কাবা শব্দের অর্থ বর্গাকার ইবাদতগার। ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে কাবা হলো দুনিয়ার প্রথম ঘর। প্রথম মসজিদও এটি। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ সৃষ্টির আগে ফেরেশতারা এ মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রথম হজ পালনও করেন তারা। দুনিয়ার প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) এ ঘরটি সংস্কার করেন। পরবর্তীতে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আমলে তা পুনর্নির্মিত হয়। হজ হলো বিশ্ব মুসলিমের মিলনমেলা। আরবিতে হজ বলতে বোঝায় পরিদর্শনের জন্য সংকল্পবদ্ধ হওয়া। আরব জাতির আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে অনুসারীদের আহ্বান করেন কাবাঘর পরিদর্শন ও পরিভ্রমণের জন্য। তার পর থেকে হাজার হাজার বছর ধরে পালিত হচ্ছে এই প্রথা।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের বাবা হন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম নেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)। হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে শিশু সন্তান ইসমাইলসহ হাজেরাকে নির্বাসনে দেন। হাজেরা ছিলেন মিসরীয় বংশোদ্ভূত। তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয় আজকের মক্কার মরুময় বিরান প্রান্তরে। সেখানে একপর্যায়ে সঙ্গে আনা খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে যায়। শিশু ইসমাইল ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কান্নাকাটি শুরু করেন। সেই বিরান প্রান্তরে শিশুকে এক জায়গায় রেখে পানির জন্য ছোটাছুটি করেন আরব জাতির আদি জননী বিবি হাজেরা (আ.)। পরিশেষে ক্লান্ত হয়ে শিশু ইসমাইলের কাছে এসে দেখেন তখনো কাঁদছে অবোধ শিশু। কান্নার সময় তার পায়ের আঘাতে সৃষ্টি হয়েছে পানির ফোয়ারা। সাড়ে চার হাজার বছর ধরে এ পানির ফোয়ারা জমজম কূপ হিসেবে পরিচিত। হাজার হাজার মানুষ এ কূপ থেকে পানি গ্রহণ করলেও মরু প্রান্তরের এ জলাধার এখনো সমানভাবে তার অস্তিত্বের ঘোষণা দিয়েই চলেছে। ইসমাইল (আ.) যখন কিশোর তখন হজরত ইব্রাহিম (আ.) স্বপ্ন দেখেন আল্লাহ তাঁকে তাঁর প্রিয় বস্তু কোরবানির নির্দেশ দিচ্ছেন। স্বপ্ন দেখে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ১০০ গবাদি পশু কোরবানি দেন।

দ্বিতীয় দিনও তিনি দেখেন অভিন্ন স্বপ্ন। এবারও তিনি ১০০ গবাদি পশু কোরবানি দেন। তৃতীয় রাতেও তাঁকে বলা হয় প্রিয় বস্তু কোরবানি দেওয়ার জন্য। হজরত ইব্রাহিম (আ.) উপলব্ধি করেন ইসমাইল (আ.) হলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। আল্লাহ তাঁকেই কোরবানির নির্দেশ দিয়েছেন স্বপ্নে। সে নির্দেশ পালিত হয়নি বলেই বারবার একই স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। এ স্বপ্ন গভীর পরীক্ষার মুখে ঠেলে দিল আল্লাহর নবীকে। তবে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অটল। সিদ্ধান্ত নিলেন যত কষ্টকর হোক তিনি আল্লাহর হুকুমই পালন করবেন। তিনি ছুটে যান হাজেরার কাছে। তাঁর কাছ থেকে নিয়ে আসেন ইসমাইলকে। মিনা ময়দানে পুত্রকে কোরবানি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মাঝপথে পুত্রকে জানান স্বপ্নে প্রদত্ত আল্লাহর আদেশের কথা। পুত্র ইসমাইল বলেন, আল্লাহর রাহে কোরবানি হওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। মিনা ময়দানে পুত্রকে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হন আল্লাহর নবী। অপত্যস্নেহ আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবে তিনি পুত্রকে কোরবানির আগে নিজের চোখ বেঁধে নেন। তারপর তাঁর গলায় চালান ধারালো ছুরি। কোরবানি শেষ হতে চোখ খুলেই দেখেন পাশে দাঁড়িয়ে পুত্র ইসমাইল। তাঁর বদলে একটি মেষ জবাই হয়ে আছে। ফেরেশতা এসে নবীকে জানান আল্লাহ তাঁর উৎসর্গিত মনোভাবে খুশি হয়েছেন। তিনি তাঁর কোরবানি গ্রহণ করেছেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন। কাবাঘর প্রদক্ষিণের নিয়মও প্রবর্তন করেন তাঁরা। হজ উপলক্ষে হজব্রত পালনকারীরা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি অনুসরণে কোরবানি দেন। এ নিয়মও চলে আসছে সাড়ে চার হাজার বছর ধরে। কাবাঘর স্থাপিত হয়েছিল একেশ্বরবাদী চেতনাকে উদ্ভাসিত করার জন্য। কালক্রমে এ পবিত্র ঘর বিপথগামী পুরোহিতদের আখড়ায় পরিণত হয়। মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন যে নবী সেই ইব্রাহিম (আ.)-এর শিক্ষা ভুলে তাঁর অনুসারীরা সেখানে অসংখ্য মূর্তি স্থাপন করে। এমনকি হজরত ইব্রাহিম (আ.), হজরত ইসমাইল (আ.)-এর মূর্তি তৈরি করে পূজা শুরু হয়। কাবাঘরে স্থাপিত হয় হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর উত্তরপুরুষ লাত, মানাত, নসর, হুবাল, উজ্জা, নায়েলাসহ আরও অনেকের মূর্তি। আরবরা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর শিক্ষা ভুলে গেলেও কাবাঘরের মর্যাদার ব্যাপারে ছিল আপসহীন। যত হানাহানি হোক কাবার পবিত্র চত্বরে কেউ কখনো প্রতিহিংসায় মেতে ওঠেনি। হজ উপলক্ষে অখন্ড শান্তি বিরাজ করেছে পবিত্র মক্কা নগরীতে। তবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা জয়ের আগের কয়েক শ বছর ধরে হজ পালন, কাবা প্রদক্ষিণ এবং কোরবানির নামে যা হতো তার সঙ্গে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর শিক্ষার কোনো সম্পর্ক ছিল না। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা বিজয়ের পর ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত বা ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনেন। যে নির্বোধরা কোরবানির মাংস আল্লাহর ভোগের জন্য কাবার দ্বারে ফেলে রাখত, তাদের উদ্দেশে কোরআনে বলা হয়, কোরবানির মাংস বা রক্ত নয়, কেবল আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বা তাকওয়াই তাঁর কাছে পৌঁছায়।

 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট পাঁচগাতিয়া, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর