রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা
 রৌদ্র ছায়া

কাজী আরেফ ও রাজু ভাই ছিলেন আমাদের নেতা

মাকিদ হায়দার

কাজী আরেফ ও রাজু ভাই ছিলেন আমাদের নেতা

দীর্ঘদিন পর মনে পড়ল কলেজ জীবনের পুরনো কথা। উচ্চমাধ্যমিকে পড়তাম জগন্নাথ কলেজে (শিক্ষা বছর ১৯৬৬-৬৭)। তখনকার দিনে কলেজে ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের বেশ প্রভাব ছিল। কলেজে ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন রাজিউদ্দীন আহমদ রাজু এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন মতিউর রহমান।  যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে কলেজের ‘অবকাশ’ ক্যান্টিনে রাজুভাই, মতি ভাইসহ লীগ এবং ইউনিয়ন সমর্থক ছেলে এবং মেয়েরা উপস্থিত ছিলাম। যথারীতি তারিখ নির্ধারিত হলো জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ছাত্র সংসদের।

ছাত্রলীগের সভ্য হয়েছিলাম কলেজে যেদিন প্রথম যাই সেই দিন। কলেজ গেটের সামনেই আমাদের মতো নতুন ছাত্রদের হাত ধরলেন, ছাত্রলীগের নেতা গোছের দুজন। একজন বললেন, দুই আনা পয়সা দাও, দিলাম। তিনি একটি রসিদ হাতে ধরিয়ে বললেন, আজ থেকে তুমি ছাত্রলীগের সভ্য। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম কাজী আরেফ। অপর পাশে ছিলেন আরেকজন। তিনি আমার এক সহপাঠীকে ধরে তার নিকট দুই আনা নিয়ে জানালেন, তুমি আজ থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সভ্য। বললেন, আমার নাম জাহিদুল ইসলাম। আমি আর কাজী স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ছায়দুর রহমান। বাংলার শিক্ষক অজিত গুহ, শওকত আলী, ইংরেজি শিক্ষক আবদুল মতিন আরও জনাকয়েক ইংরেজি বাংলা ভালোভাবেই পাঠ দিতেন আমাদের। আমাদের ক্লাসের মেয়েরা শিক্ষকদের পেছনে পেছনে এসে যোগ দিতেন ক্লাসে। শাঁখারীবাজার এবং গেন্ডারিয়া ও সাধনা ঔষধালয়ের যেসব হিন্দু কর্মকর্তা চাকরি করতেন তাদের মেয়েরা এবং কিছু মুসলিম মেয়েও পড়ত আমাদের সঙ্গে। আমাদের ক্লাসের ছাত্রলীগের নেতা ছিল বুড়িগঙ্গার ওপারের জিঞ্জিরার জহির উদ্দিন বাবর। ওদের কয়েক পুরুষের কাপড়ের ব্যবসা। প্রায় প্রতিদিনই কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধু-বান্ধবদের চা, শিঙ্গাড়া খাওয়াত। বাবর একদিন আমাদের সবাইকে চা-শিঙ্গাড়া খাওয়া শেষে জানাল রাজুভাই বলেছেন, কলেজ ছাত্র সংসদের ইলেকশন হবে আগামী জুন মাসে। আমার সহপাঠী জহির উদ্দিন বাবর আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাজুভাইকে জানালেন আগামী ছাত্র সংসদের নির্বাচনে, মাকিদ সাহিত্য সম্পাদক পদে দাঁড়াতে চায়। দৈনিক আজাদ এবং দৈনিক সংবাদে মাকিদের কবিতা, গল্প এবং দৈনিক ইত্তেফাকে ওর ছড়া ছাপা হয়। রাজুভাই কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন, আমি তো বিএ ক্লাসের আজিজকে কথা দিয়েছি ও সাহিত্য সম্পাদক পদে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাঁড়াবে। আমি আর বাবর ফিরে এলাম অবকাশ ক্যান্টিনে। এসে শুনলাম ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অভিনয় কুমার দাস সাহিত্য সম্পাদক পদে দাঁড়াবে। যথারীতি জুন মাসে ছাত্র সংসদের ভোট হলো। ছাত্রলীগের সেই আজিজ সাহিত্য সম্পাদক পদে। অভিনয় কুমার দাসের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়ায় আমি এবং বাবর খুবই খুশি হয়েছিলাম। তবে ছাত্র সংসদের সভাপতি পদে জিতেছিলেন রাজু ভাই। হেরে গিয়েছিলেন মতি ভাই। পৃথিবীর সব দেশেই ভোটাভুটিতে হার-জিত আছে। আমাদের পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন। গত শতকের ৩০ দশকের প্রথম দিকে পাবনা শহরের বেশ কয়েক মাইল পুবের দিকে দেওগাছি ইউনিয়নে আমাদের বাড়ি। সে বছর ইউনিয়নের ভোটাভুটিতে পিতা প্রভূত ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আমি পরে শুনেছি- পিতার অর্থ এবং সহায়-সম্পদের মধ্যে কয়েকটি ইটভাটা ছিল এবং পরবর্তীতে আমাদের পড়ালেখার সুবিধার্থে পাবনা শহরের জিলাপাড়ায় একটি দোতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন এবং ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চল্লিশের দশকেই দোহারপাড়া গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছিলেন জিলাপাড়ার বাড়িতে। আমাদের অগ্রজ জিয়া হায়দারকে চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি পাবনা জিলা স্কুল এবং আমাদের তৃতীয় বোন সেলিনা হায়দারকে (ঝর্ণা) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভর্তি করিয়েছিলেন পাবনা গার্লস হাইস্কুলে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের বেশ কয়েক বছর পরে সম্ভবত ১৯৫৩ অথবা ’৫৪ সালে পিতা পাবনা মিউনিসিপালটির মেম্বার পদে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতেই জিলাপাড়ার বাড়ির সামনে মাঠের ভিতরে গরু-ছাগল, রুই, ইলিশ বেশ কয়েক দিন ধরে প্রচুর লোকজন খেয়ে শেষ দিন জানাল হাকিম ভাই, আপনি অবশ্যই জিতবেন কেষ্টপুরের খবির উদ্দিনকে হারিয়ে দিতে পারবেন। পিতা চাটুকারদের কথা শুনে খুশি হয়েছিলেন। যথারীতি মিউনিসিপালটির মেম্বার (কাউন্সিলর) পদে হেরে গিয়ে বেশ কয়েক দিন মন খারাপ থাকলেও সাংবাদিক তৌফিক আজিজ খানের পিতা শহরের নামকরা উকিল আবদুল আজিজ খান তার বন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, মন খারাপের কিছু নেই; তবে ভবিষ্যতে আর কোনো দিন ওই অপকর্মে যাসনে। বন্ধুর কথা রেখেছিলেন আমাদের পিতা। আমার আবছা আবছা মনে আছে, কথাগুলো আজিজ চাচা আমাদের বাড়িতেই এসে বলেছিলেন তখন আমার বয়স ছয় অথবা সাত বছর। গত মে মাসের ২৮ তারিখ রবিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক জনাব নঈম নিজামের লেখা, ‘আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, গাজীপুরে পরাজয় আওয়ামী লীগ কোথায়’ লেখাটি পাঠ শেষে জানতে পারলাম আওয়ামী লীগের ভিতরের হাজার কথা। নঈম লিখেছেন, রাজনৈতিক দলের ক্ষতিটা কে করে জানেন? গাজীপুরের ফলাফল ও বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি দেখে অনেক প্রশ্ন চারদিকে উত্থাপন হচ্ছে। গত সপ্তাহ পুরোটাই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে উত্তাল হাওয়া বয়েছে।

আমেরিকার কঠিন ভিসানীতি ঘাবড়ে দিয়েছে অনেককে। বাড়তি যোগ হয়েছে গাজীপুর নির্বাচনের ফলাফল। জটিল সব রাজনীতি অতি উৎসাহীরা তৈরি করে। সর্বনাশা পরিবেশ তারাই তৈরি করে। জেনেশুনে রাজনৈতিক দলগুলো সর্বনাশাদের কবলে পড়ে। কঠিন খেসারত দিয়ে সবকিছুর সংশোধন করে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি কোনো প্রার্থী দেয়নি। সরকার পরিবারের একজন দাঁড়িয়েছিলেন। ভোটের বাক্সে তেমন সাড়া মেলেনি। লড়াই হয়েছে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানের। টেবিলঘড়ি মার্কার কাছে নৌকা হেরেছে। জাহাঙ্গীরের বিপক্ষে ছিল পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র। নেতারা আজমত উল্লার পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান দেখিয়েছেন। ঢাকা ও আশপাশ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট চেয়েছেন নৌকায়। কেউ করেছেন সেলফিবাজি। কেউ জাহাঙ্গীরকে গালাগালি। তারা কামিয়াব হতে পারেননি। জায়েদা খাতুনের ঘরে জয় গেছে। এ নিয়ে তৃতীয় পক্ষের উল্লাসের কিছু নেই। জায়েদা খাতুনও আওয়ামী লীগ পরিবারের। তাঁর ছেলে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার মনোনয়ন পাননি। মাকে নিয়ে মাঠে নেমে জয় নিয়েছেন ঘরে। জায়েদা খাতুনকে আমার সশ্রদ্ধা। তিনি এবং জাহাঙ্গীরকে অনেক বাজে মন্তব্য শুনতে হলেও, মা এবং ছেলের প্রতি ভোটদাতাদের যে গভীর শ্রদ্ধা, দীর্ঘদিন পরে তা দেখে অনেকেই আপ্লুত হয়েছেন। এমনকি আমি নিজেও। নঈম নিজাম তাঁর লেখায় শেষ প্যারায় লিখেছেন, ‘আজমত উল্লার জন্য খারাপ লাগে এ বয়সে এসে এভাবে বেইজ্জতি হবেন ভাবেননি। নৌকা হেরেছে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের কাছে, দলের ব্যর্থ কৌশল ও প্রচারের কাছে। পরাজয়ের দায় শুধু আজমত উল্লার  একার নয়, গাজীপুরের সব আওয়ামী লীগ নেতাকেই নিতে হবে।

আগামী ভোটের আগে অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নেত্রীর নির্দেশ মানবেন না, কেন্দ্রকে পাত্তা দেবেন না, তাদের আওয়ামী লীগে রাখা কি জরুরি? আমি জনাব নঈমের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করি।

গত ১৩/০৬/২০২৩ তারিখে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম তাঁর লেখা ‘বাসাইল পৌর নির্বাচন’ ওই শিরোনামের কলামটিতে তিনি চমৎকার কিছু উদাহরণ দিয়েছেন, বিএনপি নেতা এনামুল কবীর অটল জনাব আহমদ আজমের লোক। খুবই সোজা সরল। কেউ বলেছে অত্র এলাকার এমপি জোয়াহেরুল ইসলাম তাকে দাঁড় করিয়েছেন।  তা যাই হোক, সেদিন বিএনপি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বহিষ্কারপত্রে এটুকু লেখা থাকলেই চলত যে, আপনি দলীয় সিদ্ধান্ত মানেননি সে জন্য আপনাকে বহিষ্কার করা হলো। কিন্তু বেইমান, মীরজাফর বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তার বহিষ্কার পুরোটাই এখানে তুলে দিচ্ছি। সূত্র নং-বিএন/সাধারণ/৭৭/১৮৪, ২০২৩ তারিখ ৯ জুন প্রতি এনামুল কবীর অটল, সভাপতি বাসাইল উপজেলা বিএনপি টাঙ্গাইল। জনাব, আগামী ২১ জুন ২০২৩ অনুষ্ঠিতব্য বাসাইল পৌরসভার প্রহসনের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে... যা গুরুতর অসদাচরণ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, আপনার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন।                

লেখক : কবি

সর্বশেষ খবর