রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা
ইতিহাস

মানবসভ্যতার বিকাশ

অপূর্ব আজাদ

মানবসভ্যতার বিকাশ

সভ্যতার সঙ্গে অধ্যাত্ম সাধনার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিশ্বের যেখানেই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে সেখানেই অধ্যাত্ম সাধনার বিষয়টি সামনে এসেছে। বিশ্বায়নকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ এবং একবিংশ শতাব্দীর চিন্তাধারা। বৈষয়িক ক্ষেত্রে এ চিন্তাধারা এখন বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের শুরু আজ থেকে সাড়ে ৩ হাজার বছর বা তারও আগে। এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে উদ্ভাবিত দুটি প্রধান ধর্মমত সনাতন বৈদিক ধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বৈদিক ধর্ম ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ইন্দো-চীনের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধধর্ম উপমহাদেশের বাইরে মিয়ানমার, ইন্দোচীন, চীন ও জাপানে বিস্তার লাভ করে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভাবিত ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মমত এশিয়ার গ-ি ছাড়িয়ে আফ্রিকা, ইউরোপসহ সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়।

মানবসভ্যতার বিকাশ শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে। মিসর, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি স্থানেই উদ্ভব হয়েছে ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্ম। ইরানে পারসিক ধর্মের উদ্ভব ঘটে। শত শত মহাপুরুষ মানুষের আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মানুষের হৃদয়রাজ্যে তাঁদের শিক্ষা ঠাঁই করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে। ভারতবর্ষ যেমন বিশ্বসভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র, তেমনি আধ্যাত্মিক জগতেরও।

প্রাচীনকালে এ উপমহাদেশে যে দ্রাবিড় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেখানেও আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ছিল লক্ষণীয়। দ্রাবিড় সভ্যতার যেসব মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে, তা এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আনুমানিক হিসাবে সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন ঘটে। মনে করা হয় যাযাবর এ জাতির বিচরণ ছিল কাকেশীয় এলাকায়। খাদ্যের সন্ধানে অথবা অন্য কোনো কারণে তাদের একটি গ্রুপ ভারতবর্ষে, একটি গ্রুপ প্রাচীন পারস্য বা আজকের ইরানে, একটি গ্রুপ জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং ইউরোপের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। ভারতবর্ষ, পারস্য ও ইউরোপে সভ্যতার বিকাশে আর্যরা পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন সহজভাবে নেয়নি দ্রাবিড়রা। তারা বহিরাগতদের আগ্রাসন প্রতিহত করার চেষ্টাও করে। কিন্তু সে প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আর্যরা ছিল রণনিপুণ। যাযাবর জাতি হওয়ায় সংঘাতের মধ্য দিয়েই তারা বেড়ে উঠেছিল। ফলে দ্রাবিড়দের প্রতিরোধ সহজে ভেঙে পড়ে। মনে করা হয়, ভারতবর্ষে পদার্পণের আগে আর্য সমাজে যে আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটে তা যাগযজ্ঞের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ভারতবর্ষে স্থিতি লাভের পর তা বাড়াবাড়িতে রূপান্তরিত হয়। আর্য সমাজে উদ্ভব ঘটে সামন্তবাদী চেতনা। পাশাপাশি শুরু হয় দেবদেবীর অর্চনা। আর্যদের ভারতবর্ষে পদার্পণের পর তারা এ দেশের আদিবাসীদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়। তবে আধ্যাত্মিক দিক থেকে তারা বিজিতদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। এর ফলে আর্য সমাজে দেবদেবীর অর্চনা শুরু হয় বলে সমাজ গবেষকদের ধারণা। এ প্রবণতা আর্য সমাজে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। জাতিভেদ প্রথা ও রাজতন্ত্রের উদ্ভব আর্যদের একাংশ মেনে নিতে পারেনি। গৌতম বুদ্ধকে বলা যেতে পারে তাদেরই প্রতিনিধি।

গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না। ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে তিনি অস্বীকার করেন। তিনি যাগযজ্ঞ এবং দেবদেবীর পূজাকেও অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন। মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার ওপর গুরুত্ব দিতেন। বলতেন সবাইকে নিঃস্বার্থ হতে। মানুষসহ সব জীবের প্রতি ভালোবাসা ছিল বুদ্ধের অন্যতম শিক্ষা। যুদ্ধ-হানাহানিমুক্ত একটি শান্তির পৃথিবী গড়ার মহৎ উদ্দেশ্যে আবির্ভূত হন এই মহাপুরুষ। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এমনকি প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়ানোর শিক্ষা দিয়েছেন এই মহাপুরুষ। অহিংসার সক্রিয় নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।

গৌতম বুদ্ধের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল মানুষের হৃদয়। পুরুষ ও নারীর সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। মনে করা হয়, এটি ছিল প্রাচীন আর্য সমাজেরও বৈশিষ্ট্য। সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, আদি আর্য সমাজ ছিল সাম্যবাদী চেতনায় বিশ্বাসী। সেখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য ছিল না। ভারতবর্ষে আসার পর তাদের মধ্যে কালক্রমে সামন্তবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। আর্য সমাজে ওই সময় জাতিভেদের যে প্রথা গড়ে ওঠে ভগবান বুদ্ধ ছিলেন তার বিপক্ষে। জগতের সব মানুষ ও প্রাণীর মঙ্গলকে তিনি কাক্সিক্ষত বলে ভাবতেন।

ওই সময় আর্যদের মধ্যে যে পশুবলির প্রথা গড়ে ওঠে গৌতম বুদ্ধ তার কঠোর বিরোধী ছিলেন। এই মহাপুরুষ বলতেন, পশু বলি যদি কল্যাণকর হয় তবে মানুষ বলি তো আরও কল্যাণকর হওয়ার কথা।

ভগবান বুদ্ধ জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন। স্বর্গ ও নরকের ধারণা অগ্রাহ্য করলেও তিনি ছিলেন নির্বাণবাদের প্রচারক। বুদ্ধের ধারণায় দেহধারণ অর্থাৎ জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করার মাধ্যমে পার্থিব জগতের দুঃখকষ্ট যন্ত্রণা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারে। এ পরম মুক্তিকে তিনি নির্বাণ নামে অভিহিত করেছেন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর