শিরোনাম
সোমবার, ৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

শিক্ষার মান রক্ষায় আসল শিক্ষক চাই

খায়রুল কবির খোকন

শিক্ষার মান রক্ষায় আসল শিক্ষক চাই

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এ দেশে সমাজ নেতারা, রাজনীতিবিদরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের জাতে তুলেছেন। ধান্দাবাজি করেছেন, অর্থ-বাণিজ্যের জগতের টাউটরা স্কুল, কলেজ বা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকারি অনুদানের অর্থাংশ বিশেষ লুটেপুটে খেয়ে ফেলেন, সেগুলোর অংশবিশেষ দ্বারা ‘আধা-খেচড়া’ মার্কা বিদ্যালয় তৈরি হয়,  আবার এখানকার অনুদানের টাকা ফাঁকতালে ‘আপন-পকেটে’ ঢোকানোর অপচেষ্টা চালাতেও ছাড়েন না।

বস্তুত স্কুল বা মাদরাসা যা-ই প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলুক না কেন এর পেছনের লোকদের মাতুব্বরির একটাই লক্ষ্য, সমাজে নেতাগিরি করার সুযোগটা যাতে পাকাপোক্ত হয়, সেটা তার নামে ‘চিরস্থায়ী’ বন্দোবস্তের একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মানব সভ্যতার বিকাশের লক্ষ্যে আধুনিক মানব সমাজ নিজেদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তৎপরতা চালান শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমোন্নতির মাধ্যমে এবং সব কর্মকান্ডের আগে। কারণ, এটা তো অতি সহজবোধ্য ব্যাপার, মানুষ দুবেলা দুই মুঠো খেতে পারার সামর্থ্য অর্জনের পরই আসে তার বস্ত্রের চাহিদা মেটানোর কথা এবং তার পরই চলে আসে শিক্ষার বিষয়টি। কারণ শিক্ষা না হলে গণমানুষের উপার্জনের দুয়ারটি খোলা মুশকিল হবে, খুবই সহজ কথা। আর যত ধরনের উন্নতির কথা বলুন না কেন, শিক্ষার সম্প্রসারণ ছাড়া কোনো কিছুর উন্নতি করা সম্ভব নয়। শিল্প-কারখানা পরিচালনায় চাই শিক্ষিত জনসংখ্যা। উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন এবং উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য রপ্তানি দ্বারা রাষ্ট্রের সম্পদ বাড়ানো, সব কিছুর মূলেই থাকবে শিক্ষা আর উপযুক্ত শিক্ষক।

এখন যত দিন যাচ্ছে ততই শিক্ষার মান বাড়ানোর বিষয়টি সর্বাগ্রে গুরুত্ব পাচ্ছে। এখন এ শিক্ষার মানের জন্য এক নম্বরে জরুরি হচ্ছে, সর্বোচ্চ মানের শিক্ষক তৈরি করা, শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রথমে ‘শিক্ষার্থী’, তারপরই ‘শিক্ষক’। শিক্ষা কার্যক্রমের সাফল্যের প্রধান উপাদানই হচ্ছে শিক্ষক। শিক্ষার কাজ বাস্তবায়নে যে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিয়োগ দরকার তার প্রধান অংশই যাচ্ছে শিক্ষক ভরণপোষণ খাতে। শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন খাতে প্রথম ও সর্বোচ্চ বিনিয়োগই করতে হবে ‘শিক্ষক’ খাতে। কারণ, সবকিছুর মূলেই তো শিক্ষক, যেহেতু কাজটি হচ্ছে শিক্ষার। যিনি মূল ভূমিকাটি পালন করেন শিক্ষার কাজে, সার্বিক তৎপরতায়, তার জন্য অর্থ বিনিয়োগটা হতে হবে সর্বোচ্চ মানের। শিক্ষক কাজ করবেন, তাকে তো সবার আগে নিজে খেয়েপরে, নিজ পরিবার-পরিজনকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখে নিজের পেশাদার কাজটি টিকিয়ে রাখতে হবে।

আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক এবং প্রকৃত মেধাবী প্রতিটি মানুষই জানেন, বোঝেন, মেধাবী মানুষ তৈরি হয় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, মানুষের মাঝখান থেকে যারা অপরিসীম নিষ্ঠায় লেখাপড়া চর্চা করেন, শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে অবিরাম অনুশীলন ও গবেষণা করে যান এবং এসব জ্ঞান-সাধকের পেছনে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় হবে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ব্যবহৃত হবে। সে পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাদের রাষ্ট্রে কি আদৌ আছে? আমাদের দেশে আমলাতন্ত্র সবকিছু ধসিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন, দেশের জেলায় জেলায় শিক্ষক প্রশিক্ষণের নানা রকম কলেজ ও ইনস্টিটিউট পরিচালনার প্রবল কাজকর্ম চলে। তবে এসব মাধ্যমেই সেসবের অদক্ষ ও নিষ্ঠাহীন কর্মকান্ড শিক্ষক তৈরির সার্বিক প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিদ্যালয়গুলো অবশ্যই কাজ করবে, তবে আসল কাজটি হচ্ছে মূলধারার মেধাবী মানুষগুলোকে শিক্ষক বানানোর আদর্শ মানসিকতায় গড়ে তোলা-সেই আত্মত্যাগ, সেই দেশপ্রেম, সেই মানবপ্রেমের শিক্ষা-দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা। একদিকে শিক্ষক হওয়ার মতো মেধাবী মানুষগুলোর শিক্ষা-দীক্ষা চর্চা ও অনুশীলনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় কর্মপরিকল্পনা অবিরাম বাস্তবায়ন করে যাওয়া, পাশাপাশি আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন এমন ব্যক্তিত্ব খুঁজে খুঁজে বের করে আনা এবং তাদের শিক্ষকতার পেশায় ঢোকানো ও ধরে রাখা। শিক্ষক, মানে আদর্শ শিক্ষক কেমন হতে পারেন তার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৬৯ সালের একটা সময়, বিকালের দিকে, আনুমানিক ৪-৫টা হবে। ঢাকা কলেজের এইচএসসি (মানবিক) ক্লাসের দুই সহপাঠী-বন্ধু গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায়। হঠাৎ তারা তিনতলার কেবিন ব্লক এলাকায় সন্ধান পেলেন-৯ নম্বর প্রেসিডেন্ট কেবিনে চিকিৎসাধীন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্যার। ওরা দুই বন্ধু বললেন, স্যারকে যখন একটু দেখার সুযোগ পাচ্ছি, এ সুযোগ তো হেলায় হারানো যায় না। দুজনই কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ, কেবল এইচএসসি শিক্ষার্থী, ভয়ে বুক দুরুদুরু। তারপরও সাহস করে ৯ নম্বর কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

ভিতরে তখন শহীদুল্লাহ স্যার বিছানায় শরীরী-যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, অস্থিরভাবে তাঁর শরীর কাঁপছিল, নার্স অস্থির হয়ে পড়ছিলেন তাঁর অবস্থা দেখে। প্রধান দরজাটির কাচের ভিতর দিয়ে তা দেখা যাচ্ছিল। শহীদুল্লাহ স্যার ভিতর থেকে ইশারায় ভিতরে ডাকলেন, নার্সের সহযোগিতায়। ছাত্রদ্বয় ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভিতরে ঢুকে সালাম দিয়ে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কয়েক মিনিটের দর্শন-‘স্যার, আপনি কেমন আছেন’। তারপর শহীদুল্লাহ স্যার একটু জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর প্রায়-অস্পষ্ট, অবোধ্য, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি ইঙ্গিতে তাঁর শরীরী যন্ত্রণায় আর সময় দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তাঁকে দেখে চলে যেতে অনুরোধ করলেন ছাত্রদ্বয়কে। ছাত্রদ্বয় তো মহাখুশি, শহীদুল্লাহ স্যারকে দেখার সুযোগ পেয়ে, তবে তাঁর রোগ-ভোগের কষ্ট দেখে খানিকটা বেদনাহত। ছাত্রদ্বয়ের একজন আমার বড়-ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ-বন্ধু তাঁর কাছ থেকেই এ ঘটনাটি জেনেছি। বাংলা ভাষার একজন অসামান্য পন্ডিত-ব্যক্তিত্ব ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কী অসাধারণ মানবিক-হৃদয়ের মানুষ এবং মহানুভব শিক্ষক ছিলেন ওই ঘটনাটিই প্রমাণ দেয়।  আমরা ফিরে আসছি মূল আলোচনায়। শিক্ষক সমাজে এখন যে অশিক্ষা-কুশিক্ষার বিস্তার আর দুর্নীতি অদক্ষতা, মানবিকতাহীন অনাচার এসব থেকে মুক্ত হওয়ার লড়াই চালাতে হবে আমাদের।

আমরা আমাদের রাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে, সমাজে শিক্ষাজীবনে ভালো-মানের শিক্ষক তৈরি করব অবিরাম।

সেটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণে যেমন সম্প্রসারিত করবে, পাশাপাশি মানবিক গুণাবলির শিক্ষিত মেধাবী মানুষগুলোকে জড়ো করে অধিকতর সুযোগের পরিবেশ সৃষ্টি করে যেতে হবে।  উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের যথার্থ মেধা ও মনন চর্চা, অনুশীলন করে যেতে হবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে, আপসহীনতার সঙ্গে। কারণ, শিক্ষক হতে হলে যেসব গুণাবলির অধিকারী হওয়া দরকার তা আমাদের গড়পড়তা সাধারণ শিক্ষিত মানুষের ৯৯ শতাংশের মধ্যেই থাকে না। সেই কারণেই ভালো শিক্ষকের এত অভাব এ দেশে এবং একই সঙ্গে সারা-দুনিয়ায়।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য এবং সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক

সর্বশেষ খবর