সোমবার, ৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

মানুষ বলিদান প্রথা

সুদীপ্ত সুজন

মানুষ বলিদান প্রথা

ষোল শতক পর্যন্ত এশিয়ার সবচেয়ে সভ্য দেশ জাপানে দুর্গ, সেতু ইত্যাদি বড় নির্মাণকাজের আগে মানুষ বলিদান করা হতো দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য। অসহায় গরিব মানুষকে ধরে ভিত ও স্তম্ভের ভিতরে জীবন্ত সমাহিত করা হতো। এ প্রথাটি জাপানি ভাষায় ‘হিটোবাশিরা’ নামে পরিচিত ছিল। ৩০০ বছর আগেও জাপানিদের বিশ্বাস ছিল বড় আকারের দুর্গ, সেতু নির্মাণের সময় পৃথিবীর নড়াচড়ায় ভূমির দেবতা ‘ফেংশুই’ বিরক্ত হন, পরিণতিতে স্থাপনা নির্মাণের সময় এবং পরে দুর্ঘটনা ঘটে। তাই দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য মানব বলিদান প্রয়োজন বলে তারা মনে করত। তারা বিশ্বাস করত যে, এর ফলে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা শত্রুর আক্রমণে ভবন বা সেতু ধ্বংসের বিপদ ঘটবে না। জাপানি তথ্যপঞ্জি ‘নিহন শোকি’র তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে ‘হিটোবাশিরা’ শুরু হয়েছিল। সে সময় জাপানে ‘কিতাকাওয়া’ ও ‘মামুতা’ নামে দুটি নদী ছিল। নদী দুটির কারণে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হতো। এর ফলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতো। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটত। সম্রাট নিন্টোকু ওই দুই নদী নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভুগতেন। কীভাবে বন্যা রোধ করা যায় তা নিয়ে তিনি ভাবতেন। একদিন সম্রাট এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে সম্রাটকে বলা হয়েছিল কোওয়াকুবি নামে একজন ব্যক্তি মুসাশি প্রদেশে এবং কোরোমোনো-কো নামে আরেকজন ব্যক্তি কাওয়াচি প্রদেশে বসবাস করেন। এই দুই ব্যক্তিকে যথাক্রমে ‘কিতাকাওয়া’ ও ‘মামুতা’ নদী দুটিতে যদি দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া যায়, তাহলে বন্যা যেমন হবে না তেমন হবে না ফসলহানি ও প্রাণহানি।

এরপরই শুরু হয় কোওয়াকুবি ও কোরোমোনো-কোকে খোঁজা। তাদের খুঁজে পেয়ে বন্দি করা হয়। সহজ-সরল কোওয়াকুবি ছিলেন হতদরিদ্র। তাকে কিতাকাওয়া নদীর স্রোতে নিক্ষেপ করে নদীর দেবতাকে সন্তুষ্ট করা হয়েছিল।

কোরোমোনো-কো ছিলেন চালাক প্রকৃতির। বলিদানের দিন কোরোমোনো-কো দুটি লাউ সঙ্গে আনেন। এরপর নদীর দেবতাকে উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি আপনার কাছে আমার জীবন উৎসর্গ করতে। কারণ আপনি এই অঞ্চলের মানুষের ওপর দুর্যোগ ডেকে আনছেন। যদি আপনি আন্তরিকভাবে আমার জীবন চান, তাহলে এই লাউ দুটি ডুবিয়ে দেন; তাহলে আমি আপনাকে এই নদীর প্রকৃত দেবতা বলে জানব এবং আপনার কাছে আমার দেহ নিবেদন করব। কিন্তু আপনি যদি এগুলো ডুবাতে না পারেন, তাহলে আমি মনে করব আপনি প্রকৃত দেবতা নন এবং আমার জীবন নিবেদন করা বৃথা হবে।’ এ কথাগুলো বলার পর কোরোমোনো-কো নদীতে লাউ দুটি নিক্ষেপ করেন। স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো নদীর পানিতে ডুবেনি এবং কোরোমোনো- কোও বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পান।

জাপানে ১৫ শতকের ইয়াসুতোমি-কি নামক একটি ডায়েরি থেকে জানা যায়, নাগারা নদীতে একটি বড় সেতু তৈরি করার সময় মানব বলিদান করা হয়েছিল। কিংবদন্তি অনুসারে, মাতসু ওহাশি সেতুটি নির্মাণের সময় ঘটেছিল মানব বলি দেওয়ার ঘটনা। সেনাপতি হোরিও ইয়োশিহারু এই নদীতে সেতু তৈরির উদ্যোগ নেন, সেতুর স্তম্ভগুলোর জন্য নিচে কোনো শক্ত ভিত পাওয়া যাচ্ছিল না। লাখ লাখ পাথর দিয়ে নির্মিত অংশ রাতে ভেসে যেত। অনেক কষ্ট করে সেতু নির্মাণ করা হলেও কাজ পুরো শেষ হতে না হতেই পিলারগুলো ডুবে যেতে থাকে। এরপর ভয়াবহ এক বন্যা সেতুটির অর্ধেক ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

এরপর বারবার সেতুটি মেরামত করা হলেও প্রতিবারই এটি ভেঙে পড়ে। তারপর বন্যা থেকে মুক্তি পেতে নদীতে একটি মানব বলি দেওয়া হয়। এরপর সেতুটি ৩০০ বছর ধরে টিকে থাকে। প্রচলিত এ কিংবদন্তিটি এত গভীরভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ১৯ শতকের শেষের দিকে যখন সেখানে নতুন একটি সেতু তৈরি করা হচ্ছিল তখন ওই অঞ্চলের হাজারো লোক শহরে আসতে ভয় পেত। কারণ গুজব উঠেছিল যে, নতুন সেতু নির্মাণের আগে একজনকে বলি দেওয়া হবে।

সাগর পারাপারের ক্ষেত্রেও ‘হিটোবাশিরা’ প্রথার উল্লেখ রয়েছে নিহন শোকিতে। জাপানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জিম্মু পূর্ব দিকে অভিযানে যাওয়ার পথে টাইফুন শুরু হয়। তার জাহাজ ঢেউয়ের ওপর ভেসে যেতে শুরু করে। এমন সময় ইনা-ইহি-নো-মিকোতো সমুদ্রের দেবতার কাছে নিজের দেহ উৎসর্গ করেন, যাতে সম্রাট নির্বিঘ্নে এগিয়ে যেতে পারেন।

মারুওকা দুর্গ হলো জাপানে টিকে থাকা প্রাচীনতম দুর্গগুলোর মধ্যে একটি, যা ‘হিটোবাশিরা’ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে কল্পকাহিনি প্রচলিত। মারুওকাতে এ দুর্গটি তৈরির সময় প্রতিবার দুর্গের পাথরের দেয়াল ভেঙে পড়তে থাকে। সে সময় একজন সাধু ‘হিটোবাশিরা’ দেওয়ার পরামর্শ দেন। ও-শিজু নামের এক মহিলা ছিলেন একচোখা। তার দুটি সন্তান ছিল। এই গরিব মানুষটিকে ‘হিটোবাশিরা’ দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। ও-শিজু মৃত্যুর আগে দাবি করেন যে, তার একটি সন্তানকে ‘হিটোবাশিরা’ দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে সামুরাই বানানো হবে। ও-শিজুকে ক্যাসল কিপের কেন্দ্রীয় স্তম্ভের নিচে সমাহিত করা হয়েছিল। এরপরে দুর্গের নির্মাণকাজ নাকি যথারীতি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। ‘হিতোবাশিরা’র এই রহস্যময় রীতি আরও কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল। সভ্যতার ক্রমবিকাশে এ প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।            

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর