বুধবার, ৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফিরে দেখা : রোহিঙ্গা জীবন

হোসেন আবদুল মান্নান

ফিরে দেখা : রোহিঙ্গা জীবন

বিগত ডিসেম্বর ২০১৯ সালের পরে গতকাল হঠাৎ করে কক্সবাজারে আসি। এক বন্ধুর আমন্ত্রণে খুব অল্প সময়ের জন্য এ আসা। মনে পড়ে, সাড়ে তিন বছর আগে শেষবার এখানে এসেছিলাম। কক্সবাজারে দুপুরের পর থেকে মেঘলা আকাশ। বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। দিনের তাপমাত্রা হ্রাস পেয়ে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পরিণত হয়েছে। ভাবছিলাম, সমুদ্রসৈকতের হিমেল হাওয়ায় অন্যমনস্ক হয়ে গা ভাসিয়ে থাকার চেয়ে আষাঢ়ের পড়ন্ত বিকালটায় পুরনো সেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো দেখে আসি। তাই তাৎক্ষণিক উখিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেখানকার মোট ২৬টি ক্যাম্পের ভূপ্রকৃতি আমার প্রায় জানা। এ আকস্মিক সফরে আমাকে চমৎকার একটু অখণ্ড সময় দিলেন উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সালেহ আহমেদ। তিনি মাঠ প্রশাসনের একজন তরুণ কর্মকর্তা। অগ্রজ হিসেবে আমার পূর্বপরিচয় পেয়ে তার মধ্যেও একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দবোধ কাজ করছিল। তাকে নিয়ে প্রথমেই দেখতে যাই সে সময়ে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মাঝখানে নির্মাণ করা রোহিঙ্গা কো-অডিশন অফিস, যা আমার নিজের তত্ত্বাবধানে তৎকালীন জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। এটা ঐতিহাসিক এক সময়ের সাক্ষী। শুনেছি এখন সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের একটা কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তারপর একে একে ক্যাম্পগুলোর পাশ দিয়ে ঘুরে আসি। সত্যিই বলছি, আমার কাছে মনে হয়েছিল কক্সবাজার এসে রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ অবস্থা স্বচক্ষে না দেখে ফিরে গেলে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করতাম।

২. সুস্পষ্টভাবে মনে আছে, ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে স্বদেশ ছেড়ে টেকনাফে আসতে শুরু করে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধন ও নিপীড়নের কারণেই তারা জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেপ্টেম্বর থেকেই এসব বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার আগমন, অবস্থান ও এদের আশ্রয় কার্যক্রমের সঙ্গে আমি জড়িয়ে যাই। আমি তখন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার। সে অর্থে কক্সবাজার আমার দায়িত্বের অধিক্ষেত্র। কাজেই দাফতরিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাকে প্রায়ই উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত ক্যাম্পগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করতে হয়েছিল। তখন প্রতিদিন হাজার হাজার অন্নহীন, আশ্রয়হীন, ছিন্নমূল মানুষের অন্তহীন মিছিল দেখেছি। বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ পিতা-মাতার মানবেতর ও করুণ আকুতি আজও আমার হৃদয়ে শিহরণ জাগায়। সে সময় পৃথিবীজুড়ে মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে। অন্যদিকে অভূতপূর্ব এক মানবিক ও সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নিল বাংলাদেশ সরকার। বলপূর্বক উচ্ছেদকৃত এ মানুষগুলোর আশ্রয় এবং বাঁচার অবলম্বন হয়ে দাঁড়াল বাংলাদেশ। তখন বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘসহ দুনিয়ার অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও জাতির ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায় বাংলাদেশ নামক ছোট্ট একটা উন্নয়নগামী দেশ। এমনকি ত্রাণ সহযোগিতাসহ তাৎক্ষণিক পাশে এসে হাত বাড়িয়ে দেয় পৃথিবীর অনেক দেশ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে যা ছিল সত্যিকার অর্থেই এক নজিরবিহীন ঘটনা।

৩. ২০১৮ সালেই জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টসহ পৃথিবীর নানা দেশের সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করেন। এদের আগমন, প্রটোকল, নিরাপত্তার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বও পালন করি। তখন পর্যন্ত ক্যাম্পগুলো সুবিন্যস্ত আকারে সাজানো হয়ে ওঠেনি। তখনো স্থান নিয়ে কৃষি ও বন বিভাগের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। অন্যদিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বিদেশি এনজিও, দাতা সংস্থা এবং অতিথিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ চাচ্ছিলেন। তারা চাপ প্রয়োগ করছিলেন। যদিও এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি আরোপিত ছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন ও নিরাপত্তাবিধান সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল।

রোহিঙ্গাদের মুখের ভাষা টেকনাফ, উখিয়ার স্থানীয় ভাষার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল থাকায় আমরা চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আলোচনা করে তাদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিই। আরেকটি স্পর্শকাতর বিষয় আমার দৃষ্টিতে আসে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশের সময় এদের নিজেদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ বা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয় মূলত মত-পথ ও নেতৃত্বের কারণে। গত কয়েক বছরের হিসাবে এদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে বেশ কয়েকজন নেতার অকালমৃত্যু হয়েছে; যা সরকারের জন্যও বিব্রতকর ও দুর্ভাগ্যজনক।

৪. জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা নাগরিকদের অবস্থান... বাংলাদেশ সরকার ও UNHCR-এর তথ্যমতে, বর্তমানে উখিয়ায় ২৬, টেকনাফে ৭ ও ভাসানচরে ১ মোট ৩৪টি ক্যাম্প রয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফের মোট জনসংখ্যা ৯ লাখ ৬১ হাজার ১৭৫ জন। ভাসানচরের সংখ্যা ৩২ হাজার ৮৪২, পরিবার ৮ হাজার ৩৫৮টি। এদের মধ্যে নারী ৫২%, পুরুষ ৪৮% ও শিশু ৫২%।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা কর্তৃক গৃহীত প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত ভাসানচরে দ্রুত স্থানান্তরের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যদিও জাতীয় আন্তর্জাতিক কিছু অদৃশ্য জটিলতায় কাজটি ত্বরান্বিত হচ্ছে না।

কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি, এনজিও এবং সাংবাদিকদের সমন্বয়ে ভাসানচর পরিদর্শন করে এসে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এদের আরও কিছু অংশ ভাসানচরে পুনর্বাসিত হলে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলো অধিকতর বাসযোগ্য হবে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জীবনযাপনের জন্য সুবিধাজনক ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের দ্রুত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ খুঁজতে সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে। এজন্য মিয়ানমার সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে হবে।

লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর