বুধবার, ৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ওবামার অভিযোগে মোদি নিশ্চুপ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ওবামার অভিযোগে মোদি নিশ্চুপ

চার দিনের আমেরিকা সফর শেষ করে ২৬ জুন দেশে ফেরেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর এ চার দিনের সফরে আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চুক্তি করে এসেছেন। এর আগে ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা গিয়ে এত বড় বাণিজ্যিক চুক্তি করেননি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও শিল্পপতিরা এ চুক্তিতে খুশি। কিন্তু খুশি নন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা। ২২ জুন হোয়াইট হাউসে নৈশভোজে মোদি যাওয়ার আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা সিএনএন ইন্টারন্যাশনালে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে মোদিকে সরাসরি আক্রমণ করেন। তাঁর প্রতিটি শব্দই ছিল বিস্ফোরক। ওবামা বলেছেন, ভারতে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়। বিজেপি, মোদি সরকারের মন্ত্রীরা এবং স্বয়ং মোদি কথায় কথায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলেন, তা ওবামার ভাষায় আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মেনে নিতে পারে না। সিএনএন সাক্ষাৎকারে ওবামার বক্তব্য ছিল, মোদির মন্ত্রীরা মুসলমানদের গুলি করে মারার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ কার্যকরের জন্য আরএসএস এমন সব তত্ত্ব প্রচার করছে, যাতে ভারতকে আর গণতান্ত্রিক দেশ বলে মনে হয় না।

যে কথা সাড়ে নয় বছর ধরে ভারতবাসী বলে আসছে, সেই একই কণ্ঠস্বর হার্ভার্ডের কৃতী ছাত্র ও দুবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার গলায়ও। আমেরিকার সিনেটে ৭৫ জন সদস্য মোদি পৌঁছানোর আগেই এক চিঠি দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বলেছেন, আপনি মোদির সঙ্গে কথা বলুন ভারতের মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে। ভারতে মানবাধিকার বিষয়টাই তুলে দিয়েছে মোদি সরকার। গোড়া থেকে এই ৭৫ জন মোদির মার্কিন সফর বিরোধিতা করে এসেছেন, সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন রশিদা তৈয়ব ও ইলহান ওমর। তাঁরা পরে মোদি ও বাইডেনের যৌথ কংগ্রেস অধিবেশনও বয়কট করেন। স্বাক্ষরকারীরা বাইডেনকে বলেন, আপনি মোদির সঙ্গে আলোচনার সময় মানবাধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বন্ধুত্ববাদ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব তুলে ধরুন। মার্কিন বিদেশনীতির মূল স্তম্ভই হচ্ছে মানবাধিকার। ফলে নরেন্দ্র মোদির মতো একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে আমেরিকার উদ্বেগের কথা তুলে ধরতেই হবে। উল্লেখ্য, এর আগে ভারতের গণমাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করে গেছেন, বারাক ওবামা তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দেখা হলেই বারাক নাকি তাঁর স্বাস্থ্যের কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু বারাক ওবামা মার্কিন সাংবাদিকদের বলেছেন, মোদিকে সহিষ্ণুতা নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত বাইডেনের। আমি মোদিকে ভালো করে চিনি। আমি হলে এবার মোদিকে দু-একটা প্রশ্ন করতাম। আমি বলতাম, মোদিজি, আপনি যদি আপনার দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ভালোমন্দ না দেখেন, তাহলে তো আপনাদের দেশে অভ্যন্তরীণ সংঘাত শুরু হয়ে যাবে। গোটা বিশ্বে এমন উদাহরণ আমরা খুব সম্প্রতি দেখেছি। তাতে যেমন ভারতের মুসলিমদের সমস্যা হবে, তেমন সংখ্যাগুরু হিন্দুদেরও হবে। আমার মনে হয়, মোদির সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে মমতার কথা বলা দরকার। অন্যদিকে হোয়াইট হাউসে গিয়ে মোদি বলেছেন, ভারতে কোনো ধরনের ধর্মীয় বৈষম্য নেই। এরই মাঝে সাংবাদিক রোহিনি সিং একটি টুইট করে বক্রোক্তি করেন, গুয়াহাটি হাই কোর্টে কি বারাক ওবামার বিরুদ্ধে একটা এফআইআর দায়ের করা হবে? মোদির বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করার জন্য কি এবার গুয়াহাটির পুলিশ এসে ওয়াশিংটন থেকে ওবামাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে? রোহিনি সিং আরও বলেছেন, বারাক ওবামার মন্তব্যের জন্য ভারতের অঙ্গরাজ্য আসামের মুখ্যমন্ত্রী ওবামাকে আখ্যায়িত করেছেন একজন মুসলিম অপরাধী হিসেবে। তিনি টুইট করে জানতে চান ভারতের বিদেশ মন্ত্রকও কি একই মনোভাব পোষণ করে?

ভারতের সাংবাদিক সিদ্ধার্থ বরদারাজন বলেছেন, ওয়াশিংটনে গিয়ে ভারতে বৈষম্য নেই বলে মোদি যে দাবি করেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা। আসামের মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যেই তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদে মুখর হয়েছে সমাজমাধ্যমগুলোও। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরাসরি বলেছেন, ভারতেও অনেক ‘হোসেন ওবামা’ রয়েছেন। তাদের প্রতি ‘যথাযথ’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্ষুব্ধ জনতার প্রশ্ন, এ মন্তব্য তো সরাসরি ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি। একজন প্রধানমন্ত্রীর সফর কেন্দ্র করে একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের বিপুল সংখ্যালঘু নাগরিককে হুমকি দিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী।

গত সাড়ে নয় বছরে নরেন্দ্র মোদি ভারতে কোথাও কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি। তিনি সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভকে বিশ্বাসই করেন না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে তাঁকে সংবাদ সম্মেলন করতে হয়েছে। গুজরাটি ব্যবসায়ী গৌতম আদানিকে এবার মোদি সঙ্গে করে নিয়ে যাননি। কারণ মাত্র কয়েক মাস আগেই একটি মার্কিন সংস্থা এই আদানির পাহাড়প্রমাণ আর্থিক দুর্নীতি ফাঁস করে দিয়েছিল। ওই ঘটনার পর আদানিদের শেয়ারমূল্যে ব্যাপক ধস নামে। সামগ্রিকভাবে মোদির আমেরিকা সফর সফল কি ব্যর্থ, তার বিচার হবে ভবিষ্যতে। আমেরিকা থেকে ফিরে এসেই মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মোদি বলেছেন, অবিজেপি সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতাদের তিনি গ্রেফতার করবেন। কারণ তারা সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা কে কত টাকা দুর্নীতি করেছেন তা-ও তিনি একটা হিসাব দিয়ে টিভির পর্দায় বলেছেন।

তবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা যে গুরুতর প্রশ্নটি সে দেশে তুলেছেন, তার কোনো জবাব ভারতের প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটনে দেননি। দেশে ফিরেও তিনি সে ব্যাপারে নীরবই আছেন।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর