বুধবার, ৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সম্প্রীতির বন্ধনে ছয় দিন

অধ্যাপক মালেকা আক্তার চৌধুরী

সম্প্রীতির বন্ধনে ছয় দিন

চিরায়ত প্রকৃতি এক নিয়মের রাজ্য। লজিকে পড়েছি, পড়িয়েছিও বিস্তর। আবারও চট্টগ্রামে এসে বিষয়টি দারুণভাবে মনে পড়ল। পুত্রতুল্য সরোজ বড়ুয়া ছোট পুত্রের বন্ধু। নটর ডেম কলেজে পড়াকালীন অর্ণবের সঙ্গে বন্ধুত্ব। অসম্ভব ভদ্র-বিনয়ী। নানান ব্যস্ততার জন্য ওর এনগেজমেন্টে যেতে পারিনি তাই কথা দিয়েছিলাম বিয়েতে আমরা থাকব। সেভাবেই ঈদের আগে সপরিবারে চিটাগাংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলাম ২২ জুন ২০২৩।

টানা ছয় দিন কাটিয়েছি সরোজের পরিবারের সঙ্গে। সরোজ বড়ুয়ার নবপরিণীতার নাম অনুশ্রী বড়ুয়া। ওরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনুসারী। দর্শনের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ইন্ডিয়ান ফিলসফিতে গৌতম বুদ্ধকে পড়েছি। আগ্রহ নিয়ে বুদ্ধের অহিংসা, আর্যসত্য, নির্বাণ, অষ্টমার্গ; জরাব্যাধি, মৃত্যু, দুঃখ এসবই আত্মস্থ করেছি। কিন্তু খুব কাছে থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে অনুষ্ঠান দেখা হয়নি। তাই উচ্ছ্বাস নিয়ে একটু একটু জানার চেষ্টা করেছি অনুষ্ঠানগুলোতে অবস্থান করে।

মোটামুটি চার পর্বে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। প্রথম পর্বে এনগেজমেন্ট; মানে কনে দেখা ও পাকা কথা দেওয়া। দ্বিতীয় পর্বে আনুষ্ঠানিক গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদের রাতে আমরাই ছিলাম সর্বশেষ আমন্ত্রিত অতিথি। বৌমার বাসায় পৌঁছেই পড়িমরি করে নিজেদের খানিকটা গুছিয়ে চট্টগ্রাম ‘জিন্নুরাইন’ ক্লাবে পৌঁছেছি। সরোজের বাবা সমরজিৎ বড়ুয়া এবং মাসহ অর্ণবের বন্ধুরা সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিল। অনুশ্রীকে দেখে মনে হয়েছে কত দিনের চেনা। মেয়েটা খুব মিষ্টি-আদুরে।

তৃতীয় পর্বে পরদিন বৌভাত। এম কে কনভেনশন, বহদ্দারহাট। এর খানিক পূর্বে চট্টগ্রাম বৌদ্ধবিহারে বিবাহ সম্পন্ন হয় একদল বৌদ্ধ ভিক্ষুর সামনে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে। বড় পুত্র অনিকের ফোন পেয়ে আমি আগেই রেডি হয়ে ওখানে চলে যাই। ততক্ষণে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। দোতলায় উঠতে উঠতে মাইকে শুনছিলাম বর কনের পারিবারিক পরিচয় দিয়ে নবদম্পতির কল্যাণ কামনা করা হচ্ছে। বিহারের বিশাল মিলনায়তনের একপাশে বর-কনে সাদা সুতায় পরিবেষ্টিত হয়ে হাত জোড় করে অবনত মস্তকে বসে আছে। সামনে গেরুয়া-খয়েরি রঙের কাপড় জড়িয়ে দুবারে দুজন অল্প বয়সী ভিক্ষু মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। প্রার্থনায় গৌতম বুদ্ধের নীতি-আদর্শের বাণীর প্রতি নবদম্পতির মনোযোগ আকর্ষণ করে সবশেষে সাধু সাধু উচ্চারণে প্রার্থনা শেষ করে পূর্বে উল্লিখিত পরিবেষ্টিত সাদা সুতায় বর-কনের হাতে মঙ্গলসূত্র পরিয়ে দেন। মন্ত্র পাঠ শেষে আমি ভিক্ষুদের সঙ্গে কথা বলেছি, জিজ্ঞাসার জবাবও পেয়েছি। বিহারের অধ্যক্ষ শাসন শোভন ভদন্ত ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির সংঘরাজ অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং তিনি অসুস্থও বটে।

বিয়েতে দুটো বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি খুব মনোযোগসহকারে। প্রথমটি, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিনিয়র সিটিজেনের উপস্থিতি এবং সিনিয়রদের প্রতি জুনিয়রদের বিনয় প্রকাশের ধরনে। টুপটুপ করে বয়সভেদে জুনিয়ররা তাদের সিনিয়রদের পা ছুঁয়ে সালাম করেই চলেছে। যা অন্য কোনো কর্মসূচিতে সচরাচর চোখে পড়ে না। রাতের ডিনারের মাঝামাঝি সময়ে বিয়ের মঞ্চে বর-কনের সামনে আবারও সাউন্ডসিস্টেম সহযোগে মন্ত্রপাঠক মন্ত্র পাঠপূর্বক কনের পিতা কর্তৃক কনেকে বরের হাতে সম্প্রদান করান এবং একটা আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। সেদিনও রাত প্রায় দেড়টা পর্যন্ত কনভেনশন হলেই কাটিয়েছি।

এবার চতুর্থ এবং সবশেষ পর্ব। মাঝে একদিনের বিরতি। বরের গ্রামের বাড়ি সীতাকুণ্ডে অনুষ্ঠানাদি। তারিখ ২৫ জুন। চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে সকাল ১১টায় সীতাকুণ্ডের পথে রওনা দিয়েছি সবাই মিলে। যদিও আমি নিজেই সেদিন অনেকটা অসুস্থ। কিন্তু পাহাড় আর প্রকৃতির হাতছানিকে উপেক্ষা করা দায়। সবুজের ফাঁকে ফাঁকে রোদের ঝিলিক যেন সদ্য ধোয়া পাতায় পাতায় হাসির ফোয়ারা তৈরি করে দিয়েছে। ঘণ্টা দেড়েকের মাথায় কমরহাট বাজারে পৌঁছে গেলাম। বাজারের পাশেই সরোজদের সুন্দর ভিলা। রাস্তার পাড় ঘেঁষে দুই পাশ জুড়ে বিশাল শামিয়ানা টাঙানো। গ্রামের লোকজন এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা আপ্যায়িত হচ্ছেন। এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ। আমাদের পথ দেখিয়ে গাড়ি এগিয়ে নিতে বর নিজেই ভাই-বন্ধুদের নিয়ে বাজারে হাজির। বিনয়ের বাড়াবাড়ি এতটাই যে, শরবত-মিষ্টি হাতেও সরোজসহ সবাই। একটু অস্বস্তি লাগলেও সরোজ ও তাঁর পরিবারকে আগে থেকেই জানতাম বলে খুব বেশি বেশি মনে হয়নি। উঠলাম, পাশেই সরোজের কাজিনের বাসায়। গ্রামের মাঝে চমৎকার নান্দনিক আবহে তৈরি একটা ডুপ্লেক্স বাগানবাড়ি। যদিও বোঝাই যাচ্ছিল গৃহকর্তা বাড়িতে নিয়মিত নন। তদুপরি পুকুরসমেত বাগিচা বাড়িটার ওভালশেপের প্রবেশ-মুখজুড়ে রয়েছে বড় বড় গোলাপি-লাল জবার বিরুৎ আকৃতির লম্বা লিকলিকে সবুজ পাতায় মোড়ানো চকচকে গাছটি। পাশেই একটা রঙ্গন কিছু অর্ধফোটা কুঁড়িসমেত। পুকুরের ওপর নুইয়ে পড়া বাঁশবাগান যেন ছোট বেলা মনে করিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে খেয়েদেয়ে ছবি নিতে নিতে দুপুর প্রায় গড়িয়ে চলল। অতিথি আপ্যায়নে আর খোঁজখবরে স্বাগতিকদের জুড়ি নেই। অনুশ্রী এরই মাঝে এসে বসেছে আমাদের সঙ্গে, গল্প করেছে। সরোজের বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা গিয়েছি ভাটিয়ারি বিএমএ ছুঁয়ে হিলভিউ পার্ক-ক্যাফে ২৪-এ। পাহাড় কেটে রাস্তা এঁকেবেঁকে শুধু নয়, ডিগবাজি দেওয়া রাস্তা যেন দোলনায় দোল খাওয়ার অনুভব জাগিয়ে তোলে। পাহাড়ের বুকচিরে বেরিয়ে আসা শীতল ধবল ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অনুভব করেছি পাথরের উষ্ণতা। সানসেট পয়েন্টে না থেমে হাটহাজারীর পথ ধরে সোজা গিয়েছি পতেঙ্গা বিচে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি তখনো ঝিরিঝিরি হাওয়ায় উড়ে চলেছে। একে তো বরষার মৌসুম তার ওপর সামান্য নিম্নচাপে মেঘ-বাদলের প্রকৃতিতে অশান্ত সাগরপাড়। বঙ্গবন্ধু টানেল হওয়ায় এখানকার চিত্রপটই বদলে গেছে। দেখেছি ধূসর মেঘলা আকাশে ধূসর প্রকৃতিতে ধূসর রঙা ঢেউয়ের উদ্দাম নৃত্যের তালে তালে আছড়ে পড়া ঢেউ। সর্বগ্রাসী ঢেউয়ের গর্জনে উছলে পড়া উর্মিমালা আছড়ে পড়ে পাথরের বুকে খান খান হয়ে ভেঙে দুগ্ধ ধবল ফেনিল জলরাশি সরাৎ সরাৎ কলরোলে সমুদ্রে নেমে যাওয়া যেন মহাসমুদ্রের মহান সৃষ্টির অপূর্ব এক চিরায়ত লীলাপর্ব। দিগন্তের কোনো বাস্তব সীমারেখা আঁকা নেই। রাশি রাশি ফরেন শিপের রাশি রাশি আলোর বিন্দু যেন সম্মুখপানে দুই হাত বাড়ায়, তীরে ফেরার আকাক্সক্ষায়।

সন্ধে নেমেছে সাগরপাড়ের বালুকাবেলাতে। মন সরছিল না ফিরে যেতে। মুগ্ধ নয়নে উতাল হাওয়ায় ঢেউয়ের নৃত্য উপভোগ করছিলাম বিভোর হয়ে। ভাবছিলাম খেয়ালি প্রকৃতির একই অঙ্গে এত রূপ!

লেখক : দর্শন বিভাগ ও সম্পাদক, শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সর্বশেষ খবর