বুধবার, ৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

চলুন ঘুরে আসি জৈন্তাপুর

আফতাব চৌধুরী

চলুন ঘুরে আসি জৈন্তাপুর

সিলেট মহানগরী থেকে পর্যটন স্পট জৈন্তাপুর যেতে এখন আর তেমন বেগ পেতে হয় না। শিবগঞ্জ থেকে বাসে মাত্র ৮০-৯০ টাকা ভাড়ায় জৈন্তায় যাওয়া যায়। এর প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হয়ে সারা বছর ধরেই এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। জৈন্তার আশেপাশেই পাহাড়, রাজবাড়ী, শ্রীপুর, তামাবিল, জাফলং প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান দেখার সুয়োগ রয়েছে। এ সুযোগের অনেকেই সদ্বব্যবহার করে থাকেন। সিলেট ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জৈন্তা, জাফলেংর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই এসে ভিড় করেন প্রায় প্রতিদিনই। ২৫৮ পয়েন্ট ৬৯ বর্গমাইলের জৈন্তাপুর উপজেলাটি জেলা সদর থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাঁচটি ইউনিয়নের ১৭৮টি গ্রামে লক্ষাধিক লোক বসবাস করেন। এসব অধিবাসীর বেশির ভাগই কৃষি, নানাবিধ শাক-সবজি এবং পাথর ভাঙা ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ১৭ হাজার ২০০টি পরিবারের মধ্যে ১৪০টি পরিবার উপজাতীয়। এলাকাজুড়ে বেশ কটি পিকনিক স্পট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান এমনকি বিদেশের পর্যটকরাও এখানে আসেন, নানা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হয় তাদের জ্ঞানের ভান্ডার। বিশেষ করে জৈন্তাপুরের রাজবাড়ী, তামাবিল চেকপোস্ট, বিছনাকান্দি, শ্রীপুর, জাফলং, কোয়ারির পাথর আহরণ পর্যটকদের মুগ্ধ করে।

জৈন্তাপুর রাজবাড়ীটি থানা সদরে অবস্থিত। কবিগুরু রবীদ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে সিলেটে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছিলেন। ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে বাংলার প্রান্তসীমা হতে নির্বাসিতা তুমি, সুন্দরী শ্রীভুমি।’ জৈন্তাপুরের বেলায়ও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। বিরাট নয়, ছোট ছোট টিলা ও বৃক্ষরাজিসমৃদ্ধ জৈন্তা ১৮৩৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যরা দখল করে নেয়। তখন জৈন্তা রাজা ছিলেন ইন্দ্রসিংহ। এটি একটি অতি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীন ভারতের অন্যান্য স্থানের মতো জৈন্তার প্রাথমিক ইতিহাস তমশাচ্ছন্ন। জানা যায়, কাশ্মীরের রাজা জয়াপীড় ত্রয়োদশ শতকের প্রথম পাদে দিগি¦জয়ের পূর্বদেশীয় রাজা ভীমকে পরাজিত করে নেপাল রাজ্যে প্রবেশ করেন এবং বিশাল স্ত্রী রাজ্য জয় করেন। স্ত্রীরাজ্য বলতে সে যুগে জৈন্তাকেই বুঝাত। সে যুগের জৈন্তা বা নারী রাজ্যের সঠিক বিস্তার জানা যায়নি। তবে জৈন্তা পাহাড়কে কেন্দ্র করেই নারী রাজ্যের অবস্থান ছিল। ষোড়শ শতক অর্থাৎ খাসিয়া রাজবংশের সময় থেকে জৈন্তা রাজ্যের অন্তর্গত বার পুঞ্জী সম্বলিত জৈন্তা পাহাড়, সিলেটের উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমি, নওগাঁ জেলার নোভা ও ডিমারুয়া অঞ্চলসহ রাজ্যের উত্তর সীমায় আহম (কামরুপা), পূর্বে কাছাড়, দক্ষিণে ত্রিপুরা ও গৌড় রাজ্য এবং পশ্চিমে লাউড় ও কামতা রাজ্য সীমানা নিয়ে জৈন্তা রাজ্য অবস্থিত ছিল। জৈন্তাতেই ছিল তার সদর। এখানে রাজাদের রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এটি বর্তমানে দেখভাল ও সংরক্ষণ করছে। যেসব রাজন্যবর্গ জৈন্তায় স্মরণাতীতকাল থেকে অধিষ্ঠিত ছিলেন তার বিবরণ হট্টনাথের পাঁচালী হতে জানা যায়, কামরুপ রাজ কামসিন্দু রাণী উর্মি, (খণ্ড কামরুপ/ জৈন্তারাজ্য) রাজকন্যা উর্বরা কৃষক (তিব্বতের যুবরাজ)। কৃষক রাজবংশ রাজা হাটক জৈমিনি, মহাভারত, মন্ত্রচুড়ামনি, কন্দ্র চূড়ামনি, কামাখাতন্ত্র প্রভৃতি পৌরাণিক সাহিত্যে জৈন্তা রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। হিন্দুদের প্রাচীন গ্রন্থাদিতেও সিলেটের গৌড় ও লাউড় রাজ্যের উল্লেখ না থাকলেও প্রতিটি গ্রন্থে জৈন্তিয়া বা জয়ান্তার উল্লেখ রয়েছে। কিংবদন্তি রয়েছে কাশ্মীরের রাজা জয়াপীড় ত্রয়োদশ শতকের প্রথম পাদে দিগি¦জয়ে পূর্বদেশীয় রাজা ভীমকে পরাজিত করে নেপাল রাজ্যে প্রবেশ করেন এবং বিশাল স্ত্রী রাজ্য জয় করেন। স্ত্রীরাজ্য বলতে সে যুগে জৈন্তাকেই বুঝাত।

১৮৩৫ সালে জৈন্তারাজ্য ব্রিটিশ অধিকারে সিলেটভুক্ত হয়। ব্রিটিশ অধিকারের আগে পর্যন্ত রাজ্যের লোকেরা অত্যন্ত সুখেই এ অঞ্চলে দিন গুজরান করতেন। রাজারা অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। প্রজার কল্যাণে তারা বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করে গেছেন। শিক্ষা বিস্তারে তারা অগ্রগামী ছিলেন জৈন্তাপুর থানায় বহু পাতকুয়া রয়েছে। দীঘি ও পুকুর খনন ছিল রাজাদের অন্যতম কীর্তি। বর্তমানে জৈন্তাপুর উপজেলায় সর্বমোট ২৭টি বিল, ২টি দীঘি ও ১০৭৪টি পুকুর রয়েছে। জৈন্দা রাজবাড়ীর চতুর্দিকে বহু উপজাতীয় লোকজন ও হাসপাতাল, স্কুল-মাদরাসা রয়েছে। জাফলং-তামাবিল ঘেঁষেই ভারতের ডাউকী থানা ও খাড়া খাসিয়া পাহাড়। প্রতিদিন ভারত থেকে অসংখ্য ট্রাকে কয়লা আসে তামাবিল চেকপোস্ট গলিয়ে। জৈন্তায় সর্বমোট তিনটি সীমান্ত ফাঁড়ি রয়েছে। একটি পিকনিক স্পটসহ ১টি সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রসহ ৬৫৬৪ একরের পাঁচটি চাবাগান ও দুটি তৈল ও গ্যাসক্ষেত্র সমৃদ্ধ জৈন্তা উপজেলায় একদিন ঘুরতে ঘুরতে প্রকৃতির অপার ভালোবাসায় স্নিগ্ধ জৈন্তাপুরের সহজ সরল মানুষের মুখচ্ছবি বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলার মানুষের মমতায় সিক্ত এক এবং অভিন্ন। অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবৎসল জৈন্তাপুরের মানুষজনের ভালোবাসা যে কোনো মানুষের মনে রাখার মতো। জৈন্তাপুরবাসী চিরদিন ইতিহাসের অমূল্য উপাদান। বিশাল বাংলায় তারা যেমন ছিলেন কীর্তিমান তেমনি বহমান নদীর মতো, পটে আঁকা ছবির মতো বাংলার মানুষের মনে হিল্লোলিত হবে, সন্দেহ নেই।

লেখক : পরিবেশবিদ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর