শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুক্তিযোদ্ধা হয়রানির তদন্ত হোক

কালাম আজাদ

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নানের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৩ সালে। আওয়ামী লীগের হরতালের সময় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে পিকেটিং করছিলেন সে দলের নেতা-কর্মীরা। এক বন্ধুর সঙ্গে আমি যাচ্ছিলাম পিকেটিংয়ের কাছ দিয়ে। হঠাৎ দেখি সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। তিনি হাতের ইশারায় ডাকতেই পাঁচ-সাত মিনিট নানা কথা হলো তার সঙ্গে। পিকেটার হিসেবে সৈয়দ সাহেবের পাশেই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামই পরিচয় করিয়ে দেন ইঞ্জিনিয়ার মান্নানের সঙ্গে। বললেন, মান্নান ভাই বাবার প্রিয়ভাজন কর্মীদের একজন। মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। এখন দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর অন্যতম নেতা। তারপর থেকে প্রায় দুই দশক। লেখালেখির সূত্রেই ইঞ্জিনিয়ার মান্নানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। পরোপকারী মানুষ হিসেবে তার সুনাম শুনেছি কটিয়াদীর পরিচিত জনদের কাছে। গত বছর সিলেটের বন্যার সময় হঠাৎ এক দিন ফোন পেলাম ইঞ্জিনিয়ার মান্নানের। বললেন, তিনি সিলেটের বন্যাদুর্গতদের জন্য কিছু ত্রাণসামগ্রী দিতে চান। স্ত্রী ও সন্তানদের রাজি করিয়ে ১০ লাখ টাকা জোগাড়ও করেছেন। তাকে পরামর্শ দিলাম ত্রাণসামগ্রী কিনে নিজে উপস্থিত থেকে বিতরণ করতে। বললাম প্রয়োজনে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিলেট ব্যুরোর সহায়তাও নিতে পারেন। এলাকায় অজাতশত্রু হিসেবে পরিচিতি রয়েছে ইঞ্জিনিয়ার মান্নানের। নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়ানোকে তিনি অবসর জীবনে কর্তব্য বলে বেছে নিয়েছেন। গড়েছেন একটি ক্যাডেট মাদরাসা ও একটি মহিলা দাখিল মাদরাসা। যেটি পরিচালিত হচ্ছে তার আর্থিক সহায়তায়। গড়েছেন একটি সুবৃহৎ জামে মসজিদ। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের এ প্রবীণ ব্যক্তিকে সম্প্রতি জেলহাজতের ঘানি টানতে হয়েছে ১১ দিন ধরে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর এই প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবীর বিরুদ্ধে বানিয়াগ্রাম সাপ্তাহিক হাটবাজার প্রতিষ্ঠা কমিটির কথিত অফিস ভাঙার অভিযোগ এনে কিশোরগঞ্জ দ্রুত বিচার আইন আদালতে একটি মামলা করেছেন কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট নবী হোসেন। মামলায় আরও ১০ জনকে আসামি করা হয়। ওই ভাঙচুর মামলায় ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান হাই কোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন নেন। এম এ মান্নানের অভিযোগ, জামিনের শর্ত অনুযায়ী কিশোরগঞ্জের দ্রুত বিচার আদালতে জামিন নিতে গেলে অ্যাডভোকেট নবী হোসেনের প্ররোচনায় কোনো আইনজীবী তার পক্ষে ওকালতি করতে রাজি হননি। কটিয়াদী থানার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নানের নাম না থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ও অন্য ১০ জনকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। হাই কোর্টে জামিন নেওয়া সত্ত্বেও বিচারিক আদালতে জামিনের জন্য উপস্থিত হওয়ার পরও কেন জামিন পাননি সে বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান। আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর এক আবেদনপত্রে তিনি তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাকে ষড়যন্ত্র ও হয়রানিমূলক বলে অভিহিত করেছেন। আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়, ১৯৯৯ সালে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর বানিয়াগ্রাম বাজারে ৫২ সদস্যের সমন্বয়ে বানিয়াগ্রাম সাপ্তাহিক হাটবাজার প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সভাপতি করা হয় অ্যাডভোকেট মো. নবী হোসেনকে, ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নানকে করা হয় সিনিয়র সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয় আবদুল গফুরকে। ৫২ সদস্যের এ কমিটি স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে হাটবাজার বসানোর জন্য প্রায় ১০ বিঘা জমি কেনেন। সিদ্ধান্ত হয় প্রতি ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে শেয়ারহোল্ডাররা একটি করে দোকানের ভিটি পাবে। সে অনুযায়ী ইঞ্জিনিয়ার মান্নান এবং তার ছোট ভাই দুটি ভিটির অধিকারী হন। পরবর্তীতে কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা লেনদেন সত্ত্বেও কমিটিকে কোনো রেজিস্ট্রিভুক্ত না করাসহ নানা অভিযোগ ওঠে। হাটবাজার কমিটির শেয়ারহোল্ডারদের দাবির মুখে ২৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে সভাপতি নবী হোসেন ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান ফাউন্ডেশনে সভা আহ্বান করেন। ওই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে দুর্নীতির অভিযোগগুলো যথাযথভাবে তদন্তের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সিনিয়র সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নানের কাছে দুর্নীতিসংক্রান্ত অভিযোগ দাখিল করা হবে এবং পরবর্তী সভায় এ বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করা হবে। ইতোমধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তোলা শুরু করেন। নবী হোসেন সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকের বিরুদ্ধে ২০ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগ সিনিয়র সহসভাপতির কাছে জমা দেন। ইঞ্জিনিয়ার মান্নান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বাজারের নকশা, খাতাপত্র, ক্যাশ বুক ইত্যাদি তার কাছে দাখিল করার নোটিস দিলে দুর্নীতি ফাঁসের ভয়ে তারা তাতে সাড়া দেননি। বাধ্য হয়ে ইঞ্জিনিয়ার মান্নান দুর্নীতির বিষয়টি তদন্তের জন্য গত ৯ ফেব্রুয়ারি কটিয়াদীর ইউএনওর কাছে প্রেরণ করেন। ইউএনও ২২ ফেব্রুয়ারি তার কার্যালয়ে উপস্থিত থাকার নোটিস জারি করলে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কোনো নথিপত্র দেখাতে পারেননি। ইউএনওর কাছে হাটবাজার কমিটির দুর্নীতির তদন্ত দাবি করায় এম এ মান্নান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের আক্রোশের শিকারে পরিণত হন। সভাপতি রাতের আঁধারে ইঞ্জিনিয়ার মান্নান ও তার ভাইয়ের নামে বরাদ্দ দুটি ওয়াল করা ভিটায় কয়েকটি খুঁটি ও টিন দ্বারা ঘর তুলে ওই দুই ভিটা মালিকের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জ দ্রুত বিচার আইন আদালতে মামলা করেন। নিজেদের ভিটাকে তারা ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান ফাউন্ডেশনের অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানে হাটবাজার কমিটির অফিস কখনো ছিল না। ইঞ্জিনিয়ার মান্নানের বিরুদ্ধে আনীত ভুয়া মামলার সাক্ষীরাও কথিত হামলায় তিনি উপস্থিত ছিলেন সে কথা বলেননি। তারপরও ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নানকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে কিশোরগঞ্জ আইনজীবী সমিতিতে ২ লাখ টাকা জমা দিয়ে এবং অন্যান্যভাবে ২ লাখ টাকা খরচ করে জামিন পান তিনি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিষয়টি তদন্ত ও প্রতিকারের দাবি রাখে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর