শিরোনাম
সোমবার, ১০ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিদ্ধান্ত নিতে হবে ১৭ কোটি বাংলাদেশিকে

ড. প্রশান্ত কুমার রায়

সিদ্ধান্ত নিতে হবে ১৭ কোটি বাংলাদেশিকে

ঢাকা আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। প্রায় সবকটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম ছিল এটি। খুব নিকট সময়ে আসছে ইইউ প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশে এসব পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতরা তাদের রুটিন দায়িত্ব পালনে নিশ্চয়ই অবহেলা করছেন! সে কারণে পশ্চিমা বন্ধুদের নিজস্ব রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিবৃন্দের আনাগোনা শুরু হয়েছে বেশ জোরেশোরে। দুই বছর আগে বাংলদেশের বিশেষ বাহিনীর বিরুদ্ধে স্যাংশন দিল যুক্তরাষ্ট্র। মাসখানেক আগে ঘোষণা করল ভিসানীতি। আমরা জানি বড় বড় বিশ্ব মোড়লের উৎকণ্ঠা বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ডুবে যাচ্ছে তা উদ্ধার করার নৈতিক দায়িত্ব থেকে তারা নিজেদের গুটিয়ে নিতে পারে না! যতই পরদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হোক নাক গলানোটাকে তারা বেশ যৌক্তিক মনে করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। গত ১৫ বছরে তাদের রাজনৈতিক কোনো কসরত চোখে পড়েনি। ছিল ব্যাপক অবরোধ, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদি। সঙ্গে দেশি-বিদেশি চরমপন্থি মৌলবাদী দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও তাদের দ্বারা সন্ত্রাসী কাজের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। আসলে বিএনপি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল জেনারেল জিয়ার তত্ত্বাবধানে সামরিক শক্তির ব্যানারে যেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। একটাই উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল জিয়ার অবৈধ ক্ষমতা দখলকে পাকাপোক্ত করতে একটা সাপোর্ট সংগঠন। সেই আকাক্সক্ষা ও প্র্যাকটিস থেকে বিএনপি আজও সরে আসতে পারেনি। এ কারণে গত ১৫ বছর কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা যেমন নেই তেমনি তারা কোনো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে জনবিচ্ছিন্ন ও রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। এখন তারা বিভিন্ন অজুহাত ও ছুতো খুঁজছে কীভাবে সহজে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। অন্যদিকে গত দেড় দশকে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। স্বীকৃতি পেয়েছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। সাউথ এশিয়া, এশিয়া প্যাসিফিক ও সর্বশেষ ইন্দো প্যাসিফিক কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পরাশক্তিগুলো স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্রভূমি। যার সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতের লাভ-ক্ষতির বিষয়ও জড়িত। এখানে চৈনিক ও আমেরিকান আধিপত্যকেও প্রতিবেশী ভারত তার হিসাবের খাতায় সমীকরণ কষছে। চৈনিক আধিপত্য কমাতে আমেরিকা ও ভারত একাট্টা হয়ে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানেও হিসাবের গরমিল আছে। তবে এ কথা সত্য নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে সবাই যার যার জায়গা থেকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এ চাপাচাপির মধ্যে বিশ্ব মোড়ল পৃথিবীর ত্রাণকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলো একটু পৃথকভাবে দেখার দাবি রাখে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চীনের বলয় থেকে বের করে নিজেদের কবজায় নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে- এটাই সত্য। হয়তো আমেরিকা স্যাংশন ও ভিসানীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে বাধ্য করতে না পারলে আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে পারে। এ হেন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সুকৌশলে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত অগণতান্ত্রিক দল বিএনপিকে শিখন্ডী হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে এবং সেটা ব্যবহার করে তারা আরও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। একটি কথা বলে রাখা ভালো, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি গণতান্ত্রিকভাবে সৃষ্ট না হলেও এ দেশের মানুষকে নিয়ে সৃষ্ট একটি রাজনৈতিক দল এবং দেশ ও জনগণের কল্যাণই তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। তারা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা জনগণ কি নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করে এভাবে কারও তাঁবেদারিতে কাজ করবে? একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিদেশি পরাশক্তি তাদের নিজস্ব স্বার্থে কাজ করতে আসছে- আমাদের স্বার্থে নয়। তারা চাইছে চাপ সৃষ্টি করে তাদের যার যার স্বার্থমতো একটি সরকার গঠন করতে, যার ফলে রুদ্ধ হয়ে যাবে চলমান উন্নয়ন, দেশ পড়বে মুখ থুবড়ে। বঙ্গবন্ধুকন্যা এ বিষয়টি অনুধাবন করেই অনড়, তিনি কোনো চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে নারাজ। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও কোটি কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশকে তিনি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেবেন না- এটাই দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের প্রথম ও শেষ অবস্থান।

আমেরিকা বিশ্বের ১৮০টি দেশে ২ লাখ সুশিক্ষিত ও সশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র নব্বইয়ের দশকের স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের আগে ও পরে সারা বিশ্বে অসংখ্য গণতন্ত্রকামী দেশের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকারকে বিনষ্ট এবং সাংবিধানিক সরকারকে উৎখাত করতে সামরিক ও বেসামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে। আমাদের ১৯৭১ সালের ন্যায়সংগত ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে বাদ সেধেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সহায়তা করেছিল নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালাতে, সৃষ্টি হয়েছিল এক নজিরবিহীন গণহত্যা। ষড়যন্ত্র করে জাতির পিতাকে পরিবারের প্রায় সব সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যায় সহায়তা করেছিল। সেসব আত্মস্বীকৃত খুনিদের তারা আশ্রয় দিয়েছিল এবং এখনো দন্ডাদেশপ্রাপ্ত খুনিরা তাদের আশ্রয়ে আছে। ১৯৭১ সালে ভারত ও রাশিয়াসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে আমেরিকার যে পরাজয় হয়েছিল ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন করে পাকিস্তানের একটি অঙ্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও তারা করেছিল। আশার কথা বাঙালিদের বুদ্ধিমত্তা, দেশপ্রেম, ত্যাগ ও জাতিসত্তার প্রতি যে অগাধ ভালোবাসা সেটাই বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জন ও তা রক্ষার সাহস জুগিয়েছে বারবার। আমেরিকা, চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপান- এরা সবাই থাকবে, যার যার জায়গা থেকে তাদের স্বার্থে কাজ করবে। সিদ্ধান্ত আমাদের। আমরা জন্মভূমি, দেশ ও জাতিকে রক্ষা এবং উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করব নাকি নিজেদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করতে অন্যের পদলেহন করব- এটাই দেখার বিষয়।

                লেখক : সাবেক সচিব

সর্বশেষ খবর