বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ধৈর্যের পরীক্ষা নিলেন সিরাজুল আলম খান

মাহমুদুর রহমান মান্না

ধৈর্যের পরীক্ষা নিলেন সিরাজুল আলম খান

সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৭২ সালের শেষের দিকে। এখন আর সময়টা ঠিকঠাক মনে নেই। তার কিছু দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চাকসুর নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমি জিএস পদে জিতেছিলাম। সময়টা স্বাধীনতার পর পরই। ততদিনে ছাত্রলীগ ভেঙে গেছে। ডাকসুসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; এবং কোথাও ছাত্রলীগ জিততে পারেনি। মমতাজ বেগম জিতেছিলেন ডাকসুর মহিলা সদস্য হিসেবে। কিন্তু আমি জিএসসহ মোট চারটি পদে জিতেছিলাম। এটা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সিরাজুল আলম খান তখন ঢাকার ওয়ারীতে জাসদের নতুন প্রকাশিত পত্রিকা গণকণ্ঠ অফিসে বসতেন। উনি আমাকে খবর পাঠালেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করা তখন ছিল একটা বিরাট ব্যাপার। সিরাজুল আলম খান তখন জাসদ রাজনীতির প্রবাদপুরুষের মতো। আমার দুর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় অথবা দাদা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। স্বাধীনতার আগে অথবা পরেও তাঁর সঙ্গে বিশেষভাবে দেখা করার জন্য আমি কোনো চেষ্টাও করিনি। কিন্তু দাদা জাসদের রাজনীতিতে কিংবা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের কাছে ছিলেন একজন প্রবাদপুরুষের মতো। অনেক কথা শুনেছি তাঁর সম্পর্কে, মনের মধ্যে জানার এক প্রচণ্ড আকাক্সক্ষাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আমি এসব ব্যাপারে বোধহয় অনেকখানি লাজুক ছিলাম। তাই তাঁকে দেখার বা তাঁর সামনে বসে কথা বলার সুযোগ কখনো হয়নি। এখন খোদ ওনার তরফ থেকেই আদিষ্ট হওয়ায় আমি যারপরনাই খুশি হলাম।

নির্দিষ্ট দিনে (সাল-তারিখ মনে নেই) সকাল ১০টার দিকে আমি গণকণ্ঠ অফিসে হাজির হই। দাদা ছিলেন। উনি যে রুমে বসেছিলেন আমি সেই রুমে ঢুকে গেলাম। রুমে আরও লোকজন ছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে দাদা একবার তাকালেন। কিছু বললেন না। আমি একটা খালি চেয়ার দেখে বসে পড়লাম। দাদা কথা বলছিলেন অন্যদের সঙ্গে। আমি চুপ করে বসে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।

একজন একজন করে লোক কথা শেষে বেরিয়ে যেতে লাগল এবং এক সময় রুমটা খালি হয়ে গেল। আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। দাদা এখন কথা বলবেন নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে। কিন্তু দাদা সেরকম কিছু করলেন না। আমার দিকে খুব তাকালেনও না। আমি অগত্যা বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার যতদূর মনে আছে দেড়টা থেকে ২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরও যখন দাদা আমার সঙ্গে কথা বললেন না, তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আমি কি থাকব নাকি চলে যাব’। দাদা আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘কাল এসো’।

পরদিন আবার গেলাম। কিন্তু সেদিনও আগের দিনের পুনরাবৃত্তি হলো। পুরোটা সময় দাদা আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমি যখন বিদায় চাইলাম তখন আগের দিনের মতোই বললেন, কালকে এসো। এরকম করে বোধহয় সাত দিন গেলাম। সেদিনও দাদা আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আমি উঠে আসার সময় তাঁকে বললাম, দাদা আমার তো ভার্সিটি খুলে গেছে। আমাকে আজ রাতে যেতে হবে। তখন তিনি আমার দিকে নজর দিলেন। বললেন, তুমি তো একাই জিতেছ। ভার্সিটিতে তোমার সংগঠন জেতেনি। ওখানে সংগঠনের অবস্থা কী? আমি বললাম, আসলে সংগঠন তেমন নেই। আমি জিতেছি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রছাত্রীরা আমাকে পছন্দ করে তাই। দাদা বললেন এটাই কথা। তার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। এই একটা জিনিস আমি পরবর্তী সময়েও দেখেছি, দাদা যখনই মনে করতেন তিনি একটা পয়েন্ট পেয়ে গেছেন তখনই তাঁর চেহারা জ্বলে উঠত। তিনি প্রগলভ হয়ে উঠতেন এবং খুবই জোর দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি আমাকে বললেন, এই যে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী তোমাকে পছন্দ করে, কেন? পছন্দ করবার তো কারণ থাকতে হবে। তুমি কী তা জান? আমি চুপচাপ তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কথা শুনছিলাম। তিনি আবার বললেন, তোমার ব্যক্তিগত বন্ধু-বান্ধব আছে? আমি বললাম, অনেক। তিনি তখন বললেন, তুমি তাদের সঙ্গে কথা বল। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি আবার বললেন, জিজ্ঞেস কর আমাকে ভোট দিলেন কেন? তারা হয়তো বলবে, তোমাকে ভালো লাগে। কারণ বলবে। কেন ভালো লাগে বলবে। এবং সেই কারণগুলো প্রধানত রাজনৈতিক হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভোট কেবল ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে হয় না। ওয়ান টু ওয়ান তাদের সঙ্গে কথা বলবে, বেশি সময় নিয়ে কথা বলবে। যত বেশি সম্ভব ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলবে। দেখবে, অনেককে পাবে, রাজনৈতিকভাবে। তাদের নিয়ে আস্তে আস্তে বিশ্ববিদ্যালয় এবং হলগুলোর কমিটি বানাবে।

দাদা থামলেন। তখন আমি নিচু স্বরে বললাম, জি দাদা। উনি হাসলেন। বললেন, ঠিক আছে তুমি যাও। কাজ শুরু কর। আমাকে জানাবে কী হলো রেজাল্ট। আমি আবারও বললাম, জি দাদা। এবং ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। রাতেই আমি চট্টগ্রাম ফিরে এসেছিলাম।

সেই থেকে অনেক দিন আমার মধ্যে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে এই সামান্য কটা কথা বলবার জন্য দাদা আমাকে এতদিন বসিয়ে রাখলেন। কেন? আমার বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহকর্মী প্রয়াত জনাব মাঈনুদ্দিন খান বদল আমাকে বলেছিলেন, বুঝলেন না? দাদা আপনার টেস্ট নিলেন। ধৈর্যের পরীক্ষা। বলে একগাল হাসলেন। তারপর আবার বললেন, এরকম পরীক্ষা আমাদেরও দিতে হয়েছে। তাই কী? আমি জানি না। মাঈনুদ্দিন বাদল একজন ভালো বক্তা ছিলেন এবং বেশ রং রস মিশিয়ে কথা বলতেন। তবে একটা কথা স্বীকার করতে হবে, দাদার কথা আমি মেনেছিলাম এবং সেইভাবে কাজ করে অল্প দিনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈজ্ঞানিক ছাত্রলীগের শক্তিশালী কমিটি গঠন করতে পেরেছিলাম। সংগঠন এত ভালো হয়েছিল যে, পরবর্তী নির্বাচনে আমরা বিপুল ভোটে চাকসুতে এবং দুটি হলেই প্রায় পুরো প্যানেল পাস করেছিলাম।

এ কথা সবাই জানেন স্বাধীনতার পর আমাদের ছাত্রলীগই সারা বাংলাদেশে একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠন হয়ে ওঠে। আমরা সেই সময় প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে জিতেছিলাম। জাসদ এই সময় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অল্প দিনেই বিশাল পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কোনো সন্দেহ নেই সংগঠনের এই ব্যাপক বিকাশে ও গঠনে জনাব সিরাজুল আলম খানের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। আর একটা কথা এখানে বললে হয়তো তেমন বিতর্ক হবে না যে, স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠনে বিশেষ করে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করার পেছনে সিরাজুল আলম খানের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। বিতর্কের কথা এই জন্য বললাম যে, শামসুদ্দিন পেয়ারা ‘আমি সিরাজুল আলম খান বলছি’ বইয়ে যখন লিখেছেন যে দাদা ’৬২ সাল থেকে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গড়ে তুলেছিলেন তখন সরকার সেই বই বাজার থেকে গায়েব করে দিয়েছিল।

যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বড় সংকীর্ণ। স্বাধীনতার ইতিহাসকে তারা ঘরের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলতে চায়। সেখানে কাউকে ভাগ দিতে রাজি হয় না। এমনিতেই ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি বাইরের কাউকে কোনো কৃতিত্ব দিতে রাজি হয় না। যেন সবকিছু কেবল তারাই করেছে। এ জন্যই সিরাজুল আলম খান মারা যাওয়ার পর তাঁর জন্য কোনো মন্ত্রী কোনো বিবৃতি দেননি। অবশ্য জনাব সিরাজুল আলম খান এসবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। মৃত্যুর আগেই তিনি তাঁর পরিবারের লোকজনের কাছে বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকে শহীদ মিনারে নেওয়া না হয়, তাঁর জন্য যেন কোনো শোকসভার আয়োজন করা না হয়। বলেছিলেন, মায়ের একটা শাড়ি দিয়ে যেন তাঁর দাফন করা হয়। তাঁর আত্মীয়রা তাই করেছিলেন।

সিরাজুল আলম খানের এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালে এ ধরনের নজির আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। স্বাধীনতার পর থেকেই দেখছি সবার মধ্যে এক্সিবিশনইজম, যেভাবেই হোক নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা। সিরাজুল আলম খান এ থেকে নিজেকে আলাদা করতে পেরেছিলেন। কেমন করে, তা বলতে পারব না। আমি আসলে দাদাকে তত ভালো চিনতাম না। উনি যখন ঢাকায় ছাত্রদের সংগঠিত করছেন স্বাধীনতার পক্ষে তখন আমি চট্টগ্রামে থাকতাম। সেখান থেকেই তাঁর চিন্তার অনুসারী হই আমি। কখনো তাঁর খুব কাছাকাছি আসতে পারিনি। আমি একটু সাঁই প্রকৃতির ছিলাম। গায়ে পড়ে আলাপ করা, গরজ করে খাতির জমানো আমার চরিত্রের মধ্যে ছিল না। দাদার অনেক গল্প শুনতাম- কীভাবে সারা দিন শুধু মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিতেন, ভাত খেতেন না, এগুলো শুনতাম। উনি যখন হলে থাকতেন তখন আমি ঢাকায় তেমন আসতাম না। আর আসলেও উনাকে খুঁজতাম না। সে জন্য তাঁর গড়ে ওঠা সম্পর্কে আমি তেমন কিছু বলতে পারব না।

১৯৬৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন নিশ্চয়ই অনেক সভায় বক্তৃতা করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি নিজেই বলতেন যেদিন দায়িত্বটা শেষ হয়েছে সেদিন থেকে কেউ আর আমাকে কোনো পাবলিক ফাংশনে দেখেনি। কেন এই ইচ্ছাকৃত আড়াল? কেউ জানে না। আমি তাঁকে কোনো দিন এ প্রশ্ন করিনি আর কেউ তাঁকে করেছেন বলেও শুনিনি। অন্য নেতারা নিজেরাই অনেক সময় তাঁর ব্যাপারে একটা কাল্পনিক জাল তুলতে চেষ্টা করেছেন। যেহেতু স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে সেহেতু সেই লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিটি পাবলিক ফিগার হতে পারবেন না-কী অদ্ভুত না! এত বড় সোভিয়েত বিপ্লবের নেতা লেনিন একজন পরিচিত মুখ ছিলেন। তাঁকেও অনেক সময় আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। কিন্তু তাঁকে একজন আন্ডারগ্রাউন্ড নেতা বলা হয় না কখনো।

জনাব সিরাজুল আলম খানের ওপর লেখার জন্য যখন অনুরোধ পেলাম তখন ভালোই লেগেছিল। কিন্তু এখন লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে কত কঠিন কাজে স্বীকারোক্তি দিয়েছি। একজন মানুষের, আর সে মানুষও যদি হন একজন ইতিহাসের আশ্রিত সন্তান তবে তাঁকে নিয়ে লেখা বড় কঠিন কাজ। তাঁর সম্পর্কে খুব ঘনিষ্ঠভাবে আন্তরিকভাবে জানা থাকা চাই আর এ জন্য তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতে পারা এবং তাঁর সম্পর্কে যতদূর বেশি সম্ভব জানা থাকা চাই। কিন্তু লিখতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি সিরাজুল আলম খান দাদা সম্পর্কে তত বেশি জানি না।

আমি তাঁকে জেনেছি স্বাধীনতার পরে ’৭৩ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঢাকায় আসার পর। ’৭২ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে আ ফ ম মাহবুবুল হকের সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে একটি শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছিল। পুস্তিকাটির শুরু হয়েছিল Red flag to oppose Red flag এই বাক্য দিয়ে। নিশ্চিতভাবেই এটি বলা হয়েছিল দেশে বিরাজিত অপরাপর বামপন্থি দলগুলো সম্পর্কে। ফলে তাদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলাম আমরা। চরিত্রগতভাবে ছাত্ররা কোন শ্রেণিতে পড়বে? সবাই এক বাক্যে বলেছেন মধ্যবিত্ত বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণিতে। এদের দিয়ে কি বিপ্লবী পার্টি করা যাবে? আপনি ছাত্রদের আহ্বান জানাচ্ছেন শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার জন্য। তাই কি হয়?

সেই থেকে আজ বহু বছর পার হয়ে গেছে। আমি আর মার্কসবাদ লেনিনবাদের রাজনীতি দর্শনের চর্চা করি না। এ বিতর্কের জবাব আজ আর আমার প্রয়োজন নেই। তবে এ পর্যন্ত লব্ধ জ্ঞানের আলোকে বুঝি সেটা হয় না, হওয়ার নয়। ছাত্রদের দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলা যায় না। আমরা তো চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। অবশ্য এ কথা আমি বলব যে, ঘোষণাটা ওরকম দেওয়া হলেও একটা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া ছাত্রলীগের ভিতর থেকে শুরু হয়নি। প্রক্রিয়া বলতে যা বোঝায় সেটা হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকে এমনকি জাসদ গড়ারও আগে থেকে এবং সেখানে জাসদ শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ এবং অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতারাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন জাগে- তাহলে ছাত্রলীগকে দিয়ে এই ডাকটা দেওয়া হলো কেন?

এই প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। কেউ কি জিজ্ঞেস করেছিলেন? করেছিলেন নিশ্চয়ই। জবাবটা এরকম ছিল; একটা ভালো কাজের আহ্বান যে কোনো জায়গা থেকেই দেওয়া যেতে পারে। দেখতে হবে কাজটা ঠিকমতো করা হচ্ছে কিনা। এই জবাব নিয়েও প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু আমি তার মধ্যে আর যাচ্ছি না। আমি আগেই বলেছি, স্বাধীনতার আগের কথা বিবেচনা করলে সিরাজুল আলম খান একজন অসাধারণ সংগঠক ছিলেন। আমি এও বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনে আমার বিবেচনায় তাঁর অবদান ছিল অনেক অনেক বেশি। স্বাধীনতার পরে জাসদ গঠনেও তিনি ছিলেন মূল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এ কথা আমার বলাই উচিত যে, অতঃপর জাসদের গঠনে, তার বিকাশে আমরা তাঁকে সেই সফল সংগঠক নেতা হিসেবে পাই না।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এ কথা মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা স্বাধীনতার লড়াই করেছিল সেই স্বপ্ন উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে। অল্প দিনের মধ্যেই তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতার বিষয় খুবই পরিষ্কার হয়ে যায় দেশের মানুষের কাছে। সে সময় যেসব দল প্রতিষ্ঠিত ছিল তারা কেউ বিরোধিতা করতে আসেনি। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ সেই ভূমিকায় নেমেছিল এবং সফলতার সঙ্গে তাদের ভূমিকা পালন করছিল। প্রধানত ছাত্রলীগের মধ্য থেকেই গড়ে উঠেছিল দেশের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ।

গঠনের সময় থেকেই কী যে অভূতপূর্ব এক আবেগ সৃষ্টি করেছিল দলটি! দেশের সব তরুণ বিশেষত ছাত্রদের একাট্টা করে ফেলেছিল সংগঠনটি। শ্রেণিসংগ্রামকে তীব্রতর করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে তারা সমাজে এক গভীর আলোড়ন তৈরি করেছিল। ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘এই লড়াই গণতন্ত্রের, এ লড়াইয়ে জিততে হবে’, ‘এ লড়াই দিন বদলের, এ লড়াইয়ে জিততে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান কেবল যে চমক সৃষ্টি করেছিল, তাই নয়, এ দেশের তরুণদের মধ্যে এক নির্ভয় আন্দোলনে নিজেদের উৎসর্গ করার মানসিকতাও তৈরি করেছিল। তিয়াত্তর সালের ডাকসু নির্বাচনে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র-পন্থি ছাত্রলীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল। সেই পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ডাকসুর ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই প্রথম ব্যালট বাক্স হাইজ্যাকের ঘটনা। জাসদ তখন এত শক্তিশালী ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে যে, তিয়াত্তরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা তাদের ভয় করতে শুরু করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে যথেচ্ছ রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে। বেশ কয়েকটি আসনে ফলাফল জোর করে আওয়ামী লীগের পক্ষে আনা হয়। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা খন্দকার মোশতাক দাউদকান্দি আসনে জাসদের রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। সেখানে ভোট গণনা হয় এবং তা ঘোষণা করা হয়। তখন খন্দকার মোশতাককে জিতিয়ে আনার জন্য সরকার দাউদকান্দি থেকে সব ব্যালট বাক্স উড়িয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং ঢাকায় গণনা করে মোশতাককে জয়যুক্ত ঘোষণা করে।

বিশাল বিশাল জনসভা হতো জাসদের। মেজর জলিল এবং আ স ম আবদুর রবকে দেখতে, তাদের কথা শুনতে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হাজার হাজার লোক সমবেত হতে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে অনেকেই এরকম বলতে শুরু করেন যে, পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসবে জাসদ। তাই কী? এরকম করে বলা যায় না। রাজনীতি নিয়ে মানুষ জল্পনা-কল্পনা করে, আশা করে। কিন্তু মানুষের সব আশাই তো পূরণ হয় না। যেমন জাসদের ক্ষেত্রে ইতিহাস ভিন্ন রকম হলো। জাসদ ক্ষমতায় আসল না, বরং এক এক করে ভেঙে খানখান হয়ে গেল। বর্তমানে জাসদ বহুধা বিভক্ত। কেন? অথচ এরকম কল্পনা করতে ভালো লাগে যে, দেশে প্রধান দুটি দল আছে; আওয়ামী লীগ এবং জাসদ। তারাই পালাক্রমে ক্ষমতায় আসছে। ক্ষমতায় এবং বিরোধী দলে উভয় জায়গায় থাকত মুক্তিযুদ্ধের দুটি দল। কিন্তু সেটি হয়নি। কেন? তার দায় প্রধানত আমি বলব আওয়ামী লীগের। কারণ আওয়ামী লীগ সেই তখন থেকেই এক অনুদার নীতিতে দেশ শাসন করতে থাকে, যেখানে বিরোধী দলের জায়গা ছিল না।

তারপরে জাসদের কথাও আসবে। জাসদ টিকে থাকতে পারল না কেন? এই যে বর্তমানে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এবং প্রথমবারের চেয়ে আরও কঠিনভাবে দেশ চালাচ্ছে। তারপরও তো বিএনপি টিকে আছে এবং আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবার চেষ্টা চালাচ্ছে। জাসদ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল কেন?

সে কথা বলতে গেলে এই লেখা আরও লম্বা হয়ে যাবে, যার পরিসর এখানে নাই। এই ইতিহাসের মূল্যায়নে মূল নায়ক সিরাজুল আলম খান যিনি মাত্র গত হয়েছেন, তিনি প্রাসঙ্গিক। কারণ তিনি ছিলেন জাসদের রূপকার। জাসদের ভাঙনের ওপর লিখতে গেলে তিনিও আসবেন। এই লেখার প্রতিপাদ্য তা নয়। তাই সে চেষ্টা করছি না।

লেখার পরিসমাপ্তি টানছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মেধাবী, বীর সংগঠক স্বাধীনতা-উত্তরকালের লড়াইয়ের যাত্রা শুরু করার সারথি জনাব সিরাজুল আলম খানকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে।

লেখক : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

সর্বশেষ খবর