বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

অন্যরকম এক রাজপুত্র

অন্যরকম এক রাজপুত্র

বাস্তবে তিনি কোনো রাজপুত্র নন। রাজবংশেরও কেউ নন। কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ দেশে তো বটেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সেও রাজকীয় সম্মান ভোগ করতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এবং সমকালীন এ-দেশীয় শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনযাপন ছিল রাজকীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ। তিনি প্রিন্স হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর পরিবারের যে ব্যক্তিটি প্রথমবারের মতো খুলনার পিঠাভোগের পৈতৃকবাড়ি পরিত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় আসেন এবং ইউরোপীয় কোম্পানিতে বানিয়া হিসেবে যোগ দেন তাঁর নাম পঞ্চানন ঠাকুর। সতেরো শতকের শেষ দিকে তিনি ফরাসি কোম্পানিতে কাজ করেন, পরে ইংরেজদের সঙ্গে। সে যুগের নবজাগরণে ঠাকুর পরিবার উদ্যোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সমাজে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়। এ পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটেই কর্মযোগী দ্বারকানাথ ঠাকুরের আবির্ভাব। কয়েক পুরুষ ধরে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের সঙ্গে শ্লথ সম্পর্ক এবং জ্ঞাতিকলহের কারণে মানসিকভাবে আহত দ্বারকানাথ ঠাকুর নিজের উদ্ভাবনাশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত হন। বর্ণগত বৈষম্যের কারণে ঠাকুর পরিবারের কোনো সদস্য এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত কোনো কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেননি।

রবার্ট গুটলার ফারগুসন নামক একজন ব্রিটিশ আইনজীবীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে দ্বারকানাথ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত আইন এবং কলকাতা সুপ্রিম কোর্ট, সদর ও জেলা আদালতের যাবতীয় আইন ও কার্যপ্রণালি অধ্যয়ন করেন। ১৮১৫ সালে তিনি সফলভাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। অচিরেই তিনি পিতা রামলোচনের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারির সীমানা প্রসারে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৮৩০ সালে দ্বারকানাথ রাজশাহী জেলার কালীগ্রামের জমিদারি এবং ১৮৩৪ সালে পাবনার শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে কেনেন। তাঁর জমিদারিতে বেশ কিছু অংশীদার ও সহ-অংশীদার ছিলেন। কিন্তু তিনি বহরমপুর, পান্ডুয়া, কালীগ্রাম ও শাহজাদপুরে চারটি বড় জমিদারির একক মালিক ছিলেন। ১৮৪০ সালে সেগুলো তিনি তাঁর সন্তান ও তাদের উত্তরাধিকারীদের ট্রাস্ট করে দেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের জমিদারি পরিচালনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি এটিকে সামন্ততন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মূলধনের সৃষ্টিশীল প্রসার হিসেবে বিবেচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সমকালীন জমিদারদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন। জমিদারি পরিচালনার জন্য তিনি কয়েকজন ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেন। দ্বারকানাথের জীবনে সৌভাগ্যের অগ্রযাত্রা শুরু হয় ১৮২৮ সালে তাঁর সেরেস্তাদারের চাকরি লাভের মধ্য দিয়ে। পরবর্তী সময়ে লবণ ও আফিমের আবগারি বোর্ডে দেওয়ানের পদ লাভ করে তাঁর ভাগ্য আরও উন্নত হয়। দেওয়ান হিসেবে তিনি ১২ বছর চাকরি করেন। চাকরির পাশাপাশি লবণ প্রস্তুতকারক ও অন্যদের মধ্যে অর্থ লগ্নি করে মহাজনি ব্যবসায় যোগ দেন। তাঁর সহকর্মী ও সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গ এ কাজটিকে প্রকারান্তরে উৎকোচ গ্রহণের শামিল বলে মনে করতেন। ঘটনাক্রমে একবার দ্বারকানাথকে এ জন্য অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু যথাযথ প্রমাণের অভাবে তিনি কোর্ট থেকে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করেন। মহাজনি ব্যবসা ছাড়াও তিনি বিখ্যাত ম্যাকিনটশ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে রপ্তানি-বাণিজ্যে মূলধন বিনিয়োগ করেন। ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাংকেরও তিনি অংশীদার ছিলেন। জমিদারি পরিচালনাসহ দ্বারকানাথের এসব কর্মকাণ্ড কোম্পানির অধীনে চাকরি করার পাশাপাশি চলতে থাকে।

১৮৩৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে দ্বারকানাথকে সম্মানসূচক ‘জাস্টিস অব দ্য পিস’ পদ প্রদান করা হয়। তখনই এ পদটি প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের জন্য চালু হয়। ১৮৪০ সালের মধ্যে দ্বারকানাথ তাঁর মূলধনি কারবারের সাফল্যের শিখরে উপনীত হন। তিনি জাহাজ ব্যবসা, রপ্তানি বাণিজ্য, বীমা, ব্যাংকিং, কয়লা খনি, নীলচাষ, শহরের গৃহায়ণ প্রকল্প এবং জমিদারি তালুকে অর্থ বিনিয়োগ করেন। তাঁর ব্যবসার তদারকি করার জন্য তিনি কয়েকজন ইউরোপীয় ম্যানেজার নিযুক্ত করেন।

ইউরোপীয় ও স্বদেশি বন্ধুদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর বন্ধু ও দার্শনিক রাজা রামমোহন রায়ের মতো ব্রিটেন যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৪২ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি নিজস্ব বাষ্পচালিত জাহাজ ‘দি ইন্ডিয়া’যোগে সুয়েজের পথে যাত্রা করেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসক ডা. ম্যাকগাওয়ান, তাঁর ভাগনে চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জি, ব্যক্তিগত সহকারী পরমানন্দ মৈত্র, তিনজন হিন্দু ভৃত্য ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। বিলেতে তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পিল, বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট লর্ড ফিটজার‌্যাল্ড, প্রিন্স অ্যালবার্ট, কেন্টের রাজকুমারী ও রানি ভিক্টোরিয়া। ২৩ জুন তিনি রানির সঙ্গে রাজকীয় সৈন্যবাহিনী পরিদর্শন করে অতিবাহিত করেন। ৮ জুলাই রানি তাঁকে নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন। দ্বারকানাথ সম্পর্কে রানি তাঁর ডায়রিতে লেখেন, ‘ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক বেশ ভালো ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চমৎকার মানুষ।’ (কুইন ভিক্টোরিয়াস জার্নাল, জুলাই ৮, ১৮৪২)

১৫ অক্টোবর দ্বারকানাথ ইংল্যান্ড থেকে প্যারিসে যান। ২৮ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাঁকে সেন্ট ক্লাউডে এক লালগালিচায় সংবর্ধনা দেন। ১৮৪২-এর ডিসেম্বরে তিনি কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন।

অপূর্ব আজাদ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর