শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাশিয়ার ভয়ংকর ওয়াগনার বাহিনীর কথা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

রাশিয়ার ভয়ংকর ওয়াগনার বাহিনীর কথা

ইংল্যান্ডের লেখক, নাট্যকার, সংসদ সদস্য ও লবিস্ট জন লিলি (১৫৫৩-১৬০৬) বলেছিলেন, যুদ্ধ ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনো কিছুই দোষের নয়। হয়তো এমন ধারণা থেকেই ২০১৪ সালে রাশিয়ায় মাত্র ২৫০ সদস্য নিয়ে ওয়াগনার গ্রুপ নামে আধা-সামরিক বাহিনীর আদলে একটি বেসরকারি সৈন্য দলের গোড়াপত্তন ঘটে। এ সৈন্য দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। একসময় কিছু স্বেচ্ছাসেবক এবং চাকরিচ্যুত ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ এবং সেনা সদস্য নিয়ে এ সৈন্য দল গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে কিছু সেনা অফিসারও যুক্ত হন তাদের সঙ্গে। ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে তাদের সদস্য সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আরও ধারণা করা হয়, মূলত সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এ বাহিনীতে। প্রায় এক দশকের পথ চলায় তারা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সহযোগিতা ও সমর্থন লাভ করছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন মূলত একজন দাগি আসামি ছিলেন। ১৮ বছর বয়সে চুরির দায়ে তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত হতে হয়। দুই বছর পর ১৯৮১ সালে কিশোর গ্যাং নিয়ে ডাকাতি ও ধোঁকাবাজির দায়ে তার ১২ বছরের জেল হয়। ৯ বছরের কারাজীবন শেষে তিনি ক্ষমা পান এবং জেল থেকে মুক্ত হয়ে একটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন। নদীপাড়ের এ রেস্টুরেন্টেই তার পরিচয় হয় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে। পুতিনের সুবাদে তার রেস্টুরেন্টে আগমন ঘটে দেশ-বিদেশের বহু নেতা-নেত্রী ও বিভিন্ন অঙ্গনের তারকাদের। এক পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করে তিনি ‘পুতিনের শেফ’ নামেও পরিচিতি পান। পাশাপাশি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চেইন, ক্যাসিনো, ঠিকাদারি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে দ্রুতই ভাগ্য খুলে যায় প্রিগোজিনের।

নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাঝেও ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের নজর ছিল তার গড়া ওয়াগনার গ্রুপের ওপর। সরকারি সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও অন্যান্য সরকারি সামরিক প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের সহায়তা নিয়ে তিনি ক্রমেই প্রশিক্ষিত করে তোলেন তার বাহিনীকে। এরপর সরকারি পরিকল্পনা বিশেষত পুতিনের আগ্রহে তার সেনারা ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসেবে বিভিন্ন গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়। এই গ্রুপের মাধ্যমেই রাশিয়ার গোয়েন্দারা ভেনেজুয়েলা, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কা, সুদান, ইউক্রেন, চেচনিয়া, বেলারুশ ও স্বয়ং রাশিয়ার জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন এমনকি আমেরিকার নির্বাচনেও বিতর্কিত ভূমিকা রাখে। এ ছাড়াও বুরকিনা ফাসো, চাদ, মালে, মালদোভা, সার্বিয়াসহ আরও কিছু দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন, সেনা বিদ্রোহ ও বিরোধী দল দমনে ওয়াগনার গ্রুপ প্রকাশ্যে বা গোপনে ভূমিকা রাখে। আর এভাবেই পুতিনের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে ভয়ংকর ওয়াগনার গ্রুপ।

২০১৪ সালে ওয়াগনার বাহিনীর নাম ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে আসে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে। এই সময় পূর্ব ইউক্রেনে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন উসকে দিতে রাশিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়াগনার সৈন্যরা ব্যাপক ভূমিকা রাখে এবং ইউক্রেনের তৎকালীন পেট্রো পরশিন সরকারকে ব্যাপক চাপের মধ্যে রাখে। রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া আক্রমণের সময়ও ওয়াগনার বাহিনীকে কাজে লাগায়। সাম্প্রতিক ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় সামগ্রিকভাবে ওয়াগনার বাহিনীকে অতিমাত্রায় তৎপর দেখা যায়। রাশিয়ায় বেসরকারি কোনো সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা আইনত নিষিদ্ধ। তবে ২০২২ সালে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি হিসেবে ওয়াগনার গ্রুপ সরকারি নিবন্ধন লাভ করে। এরপর থেকে ইউক্রেনে গুরুত্বপূর্ণ শহর বাখমুত দখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়াগনার বাহিনী। রাশিয়ার সৈন্যদের বরাতে বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পরিকল্পনায় খোলা প্রান্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে ওয়াগনার বাহিনী এবং এই যুদ্ধে বহু ওয়াগনার সৈন্য প্রাণ হারায়। অথচ প্রথমদিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই যুদ্ধে ওয়াগনার বাহিনীর অংশগ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করে। যার ফলে রাশিয়ার সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা করেন ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। বাখমুত শহরে দখল বজায় রাখার সময় ওয়াগনার কমান্ডার রাশিয়ার সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন যে, ওয়াগনার সেনারা জীবন-মরণ লড়াই করলেও তাদের প্রতিশ্রুত ও প্রাপ্য সামরিক সরঞ্জাম বিশেষত আত্মরক্ষা ও যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যকীয় গোলাবারুদ সরবরাহ করা হচ্ছে না। এ অভিযোগ তুলে তিনি বাখমুত শহর থেকে তার সেনাদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

যে কোনো বৈধ সামরিক বাহিনী বা আধা-সামরিক বাহিনীকে একটি নির্দিষ্ট পোশাক বা ইউনিফর্ম পরতে হয় এবং দেশের প্রচলিত আইন ও সামরিক আইন মেনে চলতে হয়। আন্তর্জাতিক আইন বিশেষত জেনেভা কনভেনশন মেনে চলাও প্রচলিত সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনীর জন্য আবশ্যক। তবে ভাড়াটিয়া বাহিনী এসবের ধার ধারে না। ফলে সরকার বা কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তাদের দিয়ে অপকর্ম করালেও সেই দায় কাঁধে নেয় না এসব সরকার বা মহল। এভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেও তারা দেশ ও বিশ্ববাসীর চোখে ধুলো দেয়। ওয়াগনার সৈন্যদের মাঝে আদতে ভাড়াটিয়া বাহিনীর সব মন্দ দিক বিরাজমান ছিল। এক পর্যায়ে তাদের বাড়াবাড়ি রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর তথা পুতিনের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে। তারই রাশ টেনে ধরতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগ ওয়াগনার বাহিনীকে দেশের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনার পদক্ষেপ নেন, যা মানতে রাজি ছিলেন না ওয়াগনার ও তার বাহিনী। এখানেই তিক্ততার পারদ ওপরে উঠে যায়। এর মধ্যে ২৩ জুন ২০২৩ তারিখে ইয়েভগেনি প্রিগোজিন অভিযোগ করেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগ ইউক্রেনে অবস্থান করা তার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছে। এর পরদিন এই বাহিনী রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ‘রস্তভ অন ডন’ শহর দখল করে এবং রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে শায়েস্তা করতে মস্কোর দিকে যাত্রা করে। পথিমধ্যে অনেক নাটকীয়তার পর পুতিনের বিশ্বস্ত বলে পরিচিত বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার গ্রিগোরিভিচ লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় ওয়াগনার বাহিনী থেমে যায়। পরবর্তীতে আলোচনার ভিত্তিতে ওয়াগনার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনকে সসম্মানে বেলারুশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং তার অনুগত বাহিনীর সদস্যদেরও পুতিন বেলারুশে গমন অথবা রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পথ খুলে দেন। আর এভাবে এক নাটকীয় সংকটের আপাতত সমাধান হয়।

বাইবেলসহ বহু ধর্মীয় গ্রন্থে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে ভাড়াটিয়া বাহিনীর বহু কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। আজ থেকে ২৪৮৩ বছর আগে অর্থাৎ ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৎকালীন গ্রিক ও কারথেইজ (বর্তমান তিউনিসিয়া) সৈন্যদের মধ্যে ভূমধ্যসাগরের সিসিলি দ্বীপ নিয়ে যুদ্ধ হয়। এই কারথেইজ সেনাদের মধ্যে তৎকালীন স্পেনসহ অন্যান্য দেশের ভাড়াটিয়া সৈন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২৩৫৭ বছর আগে অর্থাৎ ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যখন এশিয়া অভিযানে আসে, তখন তার বহরে নিজ রাজ্য মেসিডোনিয়ার (গ্রিক) সৈন্য ছাড়াও ৫ হাজার ভাড়াটিয়া সৈন্য ছিল। একই ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও বিভিন্ন দেশে ভাড়াটিয়া বাহিনী রয়েছে, তবে তাদের ধরন, কর্মপরিধি ও আইনগত ভিত্তির মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে মিল, আবার বহু ক্ষেত্রে অমিল দেখা যায়। ২০০৭ সালে আমেরিকার ভাড়াটিয়া বাহিনী ‘ব্ল্যাক ওয়াটার’ ইরাকে মার্কিন অভিযান চলাকালে বাগদাদের নিসুর স্কয়ার গণহত্যার জন্য ব্যাপকভাবে কুখ্যাতি লাভ করে। এ সময় ‘ব্ল্যাক ওয়াটার’ বাহিনীর একটি দল ১৭ ইরাকি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে এবং ২০ জনকে আহত করে। খোদ রাশিয়াতে ওয়াগনার গ্রুপ ছাড়াও আরও কিছু ভাড়াটিয়া বাহিনী রয়েছে, যার একটির মালিক সেদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু স্বয়ং।

ওয়াগনার বাহিনীর সাম্প্রতিক ভীমরতি বা বিদ্রোহের আলোকে দেশে দেশে থাকা ভাড়াটিয়া বাহিনী নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে নীতিনির্ধারকদের। ভাড়াটিয়া বাহিনী যে ‘দুধকলা দিয়ে পোষা সাপ’, এ যেন নতুন করে দেখিয়ে দিল ওয়াগনার বাহিনী। চাহিদামতো নিজেদের সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় এই বাহিনী মস্কোর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ভাড়াটিয়া বাহিনীর আদলে বর্তমানে কোনো কোনো দেশে বিশেষায়িত বাহিনী বা পেটুয়া বাহিনীর দাপটও লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন গড়ে তুলেছিলেন স্পেশাল রিপাবলিকান গার্ড, যাদের বেতন ও ভাতা অন্যান্য বাহিনীর চেয়ে বেশি ছিল। তার বিরুদ্ধে যে কোনো সেনা বিদ্রোহ ঠেকানো ও বিরোধী দলের টুঁটি চেপে ধরাই ছিল ভাড়াটিয়া বাহিনীর আদলে গড়া এই বাহিনীর মূল কাজ। তবে শেষ বিচারে সাদ্দামকে রক্ষা করতে পারেনি এই বাহিনী। সুদানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধরত আধা-সামরিক বাহিনী ‘র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ও একসময় সরকার সৃষ্ট পেটুয়া বাহিনী ছিল। তারা ৯ জুন ২০১৯ তারিখে এক দিনেই সরকারবিরোধী শতাধিক নাগরিককে হত্যা করে ও সহস্রাধিক নাগরিককে আহত বা গুম করে। আজ তারাই সেনাবাহিনী তথা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। লিবিয়ায় ছিল স্বৈরশাসক গাদ্দাফির একান্ত অনুগত বাহিনী খামিজ ব্রিগেড। গাদ্দাফির ছোট ছেলে খামেজ গাদ্দাফি ছিলেন এই বাহিনীর প্রধান। বিশেষ সরকারি সুবিধা পাওয়া এই বাহিনীর আচরণও ছিল ভাড়াটিয়া বাহিনীর মতো। কিন্তু গাদ্দাফির পতন ঠেকাতে পারেনি এ বাহিনী। তাই গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার সমুন্নত রেখে অপরাধ রোধ ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী পরিচালিত হবে, এটাই কাম্য। মনে রাখতে হবে ১৯০৭ সালের ১৮ অক্টোবর প্রণীত হেগ কনভেনশনের (হেগ চুক্তি) ৪ নম্বর ধারা, ১৯৪৫ সালের জাতিসংঘ চুক্তির ২ নম্বর ধারা এবং ১৯৪৯ সালের জেনেভা চুক্তির ৩ নম্বর ধারাসহ বহু আন্তর্জাতিক চুক্তি, আইন ও সমঝোতায় ভাড়াটিয়া বাহিনী নিষিদ্ধ রয়েছে। নানা রকম ছলচাতুরী করে স্বৈরশাসকদের গড়া ভাড়াটিয়া বাহিনীর তাণ্ডব এবং ভাড়াটিয়া বাহিনীর আদলে গড়া পেটুয়া বাহিনীর আস্ফালন ও নীরব সন্ত্রাস বন্ধের এখনই সময়।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email: [email protected]

সর্বশেষ খবর