রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনার গণতন্ত্রের লড়াই ও কারাবরণ

ওয়ালিউর রহমান

শেখ হাসিনার গণতন্ত্রের লড়াই ও কারাবরণ

১৬ জুলাই, ২০০৭। ঠিক ১৬ বছর আগে এই দিনে ধানমন্ডির সুধা সদনের বাসভবন থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেআইনিভাবে অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলকারী তদানীন্তন সেনা সমর্থিত সরকারের নির্দেশে বর্বরোচিতভাবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

গণতন্ত্রকামী জনগণের পক্ষে কথা বলার অপরাধে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে গৃহে অন্তরিন, গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হয়ে ৩৩১ দিন শেরেবাংলা নগর সাব জেলে বন্দি থাকেন তিনি। বন্দিদশার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য ছিল বিভীষিকাময়। দেশকে বিরাজনীতিকরণের হীন উদ্দেশ্যেই সেদিন শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল।

গ্রেফতার-পূর্ব মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠির মাধ্যমে দেশের জনগণ এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গণতন্ত্র রক্ষায় মনোবল না হারিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় পিতার ন্যায় আপসহীন মনোভাব নিয়েই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে নেতৃত্বহীন করা হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন সমগ্র জাতিকে নিয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত, তখনই স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী চক্র তাঁকে পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ হত্যা করে।

গ্রিক ফিলোসফার প্লেটো বললেন, ‘যে মানুষ গুহার ভিতর বাস করে, গুহা থেকে যখন বাইরের পৃথিবীর আলো দেখে, সেই আলো দেখে সে ভয় পায়।’ বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই আলো। তাঁর আলোকে ষড়যন্ত্রকারীরা ভয় করত। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ওরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল।

বঙ্গবন্ধু কোনো ভুল করেননি। তবে বোধহয়, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি একটি ভুল করেছিলেন, তিনি বাঙালিকে বেশি ভালোবাসতেন, বেশি বিশ্বাস করতেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, কোনো বাঙালি আমাকে মারবে না। ডেভিড ফ্রস্টকে তিনি এ কথাই বললেন যে, ‘আই লাভ মাই পিপল অ্যান্ড মাই পিপল লাভ মি’।

বিরোধী চক্র ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। তারা বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করার অপপ্রয়াস চালায়। ঘাতকদের উদ্দেশ্যই ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করা। জেনারেল জিয়ার শাসনামলেই দেশকে অরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের নিয়ে সরকার গঠন করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দিয়ে, নাগরিকত্ব দিয়ে, রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করে। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে জাতির পিতার হত্যার বিচারের পথকে বন্ধ করে দেয়। জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে, সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। পরবর্তী অবৈধ সামরিক সরকার এবং বিএনপি-জামায়াত সরকারও একই পথ অনুসরণ করে। পঁচাত্তর থেকে পঁচানব্বই দীর্ঘ ২১ বছর পর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৩ জুন ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। জিয়া-এরশাদ পদ্ধতির স্বৈরশাসনের কবল থেকে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার প্রত্যয় নিয়ে জননেত্রী কাজ করে চললেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করেন।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল। বাংলাদেশের জন্য এক বিভীষিকাময় সময়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে ভোট কারচুপি করে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের আগেই বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের মদদে প্রায় ৩ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা করে। মিথ্যা অজুহাতে গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে। সংখ্যালঘু ভোটারসহ নারী ভোটাররা যাতে ভোট কেন্দ্রে না আসে তার জন্য ভয়ভীতি দেখায় বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা। নির্বাচনের পরপরই শুরু হয় দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সমর্থক আর সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, নির্যাতন। নির্বিশেষে হামলা চালায় অসহায় সহজ সরল মানুষের ওপর। হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনে আত্মহারা হয়ে যায় সমগ্র জাতি। এ প্রেক্ষিতে তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশের প্রতিবাদী গোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ২০০১ সালে নভেম্বর মাসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আইনবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবীরা এখানে এসে জমায়েত হয়েছিল এবং এর প্রতিবাদ করেছিল। সেই প্রতিবেদন এখনো প্রতিটি লাইব্রেরিতে শোভা পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী আমরা জানিয়েছিলাম যে বিএনপির তিন-চার মাসের শাসনের নৃশংসতার ভয়াবহ চিত্র। বাংলাদেশের শত্রু যারা বাংলাদেশকে চায়নি, পাকিস্তানের কলোনি হয়ে থাকতে চেয়েছে, তারা উনিশবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। শেষবার হলো ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে। ওরা চেয়েছিল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করতে। কিন্তু সেটা তারা পারেনি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ নেত্রীকে রক্ষা করেছেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া জীবন নিয়ে আবার নির্যাতিত জনগণের জন্য রাত-দিনে পরিশ্রম করেন কিন্তু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর সময় হঠাৎ করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি হলেন; শুরু হলো আরেক জীবন। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর চরম আঘাত আসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের ঘটনায়।

‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ শেখ হাসিনার কারাগারে বসে লেখা প্রবন্ধের গ্রন্থে তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন কারান্তরালে যাপিত জীবনযাপন করার মুহূর্ত। তিনি ওই গ্রন্থে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের চুলচেরা ব্যবচ্ছেদ করেছেন। সামরিক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চাপে চাঁদাবাজির মামলাগুলো কীভাবে করা হয়েছিল তাও তিনি জানতেন। গণতন্ত্র সুসংহত করা এবং জনগণের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টাকে চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল যারা, তারা গোপনে ষড়যন্ত্র করে মানুষকে সামরিক শাসন উপহার দিতে চেয়েছিল। নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভাষায়- ‘আন্দোলন করে দাবি পূরণ করলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করলাম। যেই দ্রুত নির্বাচনের কথা বললাম, সেই আমি চাঁদাবাজ হয়ে গেলাম, দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম। আমার স্থান হলো কারাগারে। পাঁচটি বছর চারদলীয় জোট তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আমার ও আমার পরিবারের দুর্নীতির কোনো কিছু পায় কি না, পায় নাই। পেয়েছে ফখরুদ্দীন সরকার।’ এই গ্রেফতারের মাস তিনেক আগে তাঁকে লন্ডনে নির্বাসিত রাখার একটি অপচেষ্টাও হয়েছিল। কানের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেবেছিল বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে নির্বাসনের দারুণ সুযোগ মিলেছে। ২৩ এপ্রিল তিনি লন্ডন থেকে বাংলাদেশ ফেরার উদ্যোগ নেন। তাঁকে বাংলাদেশগামী বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি ঢাকা থেকে যাওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে। কিন্তু তিনি ছিলেন অদম্য। লন্ডনে থেকে তিনি বিশ্বব্যাপী প্রচার চালান, মূল বিষয়- রাজনৈতিক হয়রানি, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণ। সরকার বাধ্য হয়ে তাঁকে দেশে ফেরার পথের বাধা প্রত্যাহার করে নেয়।

জননেত্রীকে সরানোর জন্য এভাবে বিভিন্ন মহল থেকে একটার পর একটা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা কখনোই সফল হতে পারেনি। কারণ নেত্রীর লড়াই ছিল দেশের জন্য, জাতির জন্য, নিজের জন্য নয়, যেমনটি করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি তো তাঁরই কন্যা।

আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠন ও গণতন্ত্রপ্রত্যাশী দেশবাসীর ক্রমাগত প্রতিরোধ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুকন্যার আপসহীন ও দৃঢ় মনোভাব এবং দেশবাসীর অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ১১ জুন দীর্ঘ ১১ মাস কারাভোগ ও নানামুখী ষড়যন্ত্রের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেখ হাসিনার মুক্তির মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরায় ফিরে আসে। বিকাশ ঘটে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের।

বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের আপামর দুঃখী জনসাধারণের নেতা, তাঁর পরিবারকে সমূলে উৎপাটনের ষড়যন্ত্র আজকের নয়, দীর্ঘ কয়েক যুগ থেকেই চলছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ষড়যন্ত্রকারী চক্র দীর্ঘদিন থেকেই এ ঘৃণ্য কাজে সক্রিয়। সেই চক্রই চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। কিন্তু জনগণের ভালোবাসায় চক্রটি সফল হতে পারেনি। আর জনগণের ভালোবাসা ছিল বলেই ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিনবার জনগণের সমর্থনে সরকার পরিচালনা করে দেশকে নিয়ে গেছেন উন্নয়নের মহাসড়কে। বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অতীতের জেল-জুলুম, হত্যার প্রচেষ্টা এবং হুমকি আর বর্তমানের অপপ্রচারের মধ্যেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাই আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়; বিশ্ব দরবারেও স্বমহিমায় উজ্জ্বল জননেত্রী শেখ হাসিনা।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ খবর