মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

পুরনো স্মৃতি ও অবাধ নির্বাচন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

পুরনো স্মৃতি ও অবাধ নির্বাচন

আজকের লেখাটা তেমন ভালো হলো না। কারণ বেশ কিছুুদিন কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ত ছিলাম। গতকাল যখন লেখা পাঠিয়েছি তখনো সখিপুর আর কালিহাতীর কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ছিল। ১৬ মে গিয়েছিলাম নির্বাচন কমিশনে। তারা কথা দিয়েছিলেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ২১ জুন বাসাইল পৌরসভা নির্বাচনে ভোট যে সুষ্ঠু হয়েছে তার প্রমাণ পেয়েছি এবং সেখানে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গামছা বিজয়ী হয়েছে। সখিপুর-কালিহাতীতে গতকাল সোমবার কয়েকটা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ছিল। লেখাটা অনেক আগেই পাঠাতে হয় বলে ফলাফল বলতে পারলাম না। কিন্তু উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে তাতে জোর-জুলুম হবে না এটা চেয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি ভোটে কোনো কারচুপি চান না। সখিপুর-কালিহাতী নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে বিপুল ভোটার উপস্থিত হয়েছেন। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি। মন ভরে গেছে। সব কয়টি ভোট কেন্দ্রে দেখেছি একই রকম অবস্থা। এ যেন ঈদ উৎসব। জয়-পরাজয় যারই হোক অত্যন্ত সুন্দর ভোট হয়েছে। প্রশাসন খুবই তৎপর। র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট সর্বত্র ছোটাছুটি করেছে। নির্বিঘ্নে ভোটার ভোট দিতে পারলে যেই জিতুক আমরা খুশি। প্রশাসনসহ নির্বাচন কমিশনকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। সেই সঙ্গে ভোটার এবং জনগণকে শুভ কামনা জানাচ্ছি।

সেই ’৬০-৬২ সালের কথা, হাতে-পায়ে বড়সড় হলেও জ্ঞানবুদ্ধি ছিল না কিছুই। ’৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসেন। তার আগে রাষ্ট্রপতি ছিলেন ইস্কান্দার মির্জা। তিনি ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। তার ২০ দিন পর ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে এক রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের চাকরি দিয়ে লন্ডন পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে ’৬৯ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত আইয়ুব খান ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। একজন দুর্দান্ত প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট। যদিও ’৬২ সালে রাজনৈতিক বিধিনিষেধ অনেকটাই তুলে নিয়েছিলেন। ’৬২ সালের আগে তখন কিছু বুঝতাম বলে বলা যায় না। তখন আমার ১৫ বছর বয়স। কিন্তু লেখাপড়া জ্ঞানবুদ্ধি তেমন কিছুই অর্জন করতে পারিনি। সহজভাবে ভাবলে তখন আমি ছিলাম পরিবারের বোঝা। আর আল্লাহরও কী কেরামতি, কোনো কাজ আমি ভালোভাবে করতে পারতাম না। সব কাজেই ত্রুটি হতো, সব কাজেই পুরোপুরি অসফল ছিলাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটা ওটা ভুল হতেই থাকত। একেবারে সাধারণভাবে দেখলেও হয়তো চায়ের কাপ তুলেছি, তার হ্যান্ডেল ভেঙে গেল। এক কাপ চা নিয়ে বাইর বাড়ি কাউকে দিতে গেছি হোঁচট লেগে কাপ পড়ে গেল। কেউ হয়তো কোনো কাপড় তাদের ওপর শুকাতে দিতে আমাকে দিয়েছে। ধোয়া কাপড় তারের ওপর দিতে গিয়েই পড়ে গিয়ে মাটিতে একাকার। বই-পুস্তক, সিলেট-পেনসিল নিয়ে পড়তে বসেছি। সিলেট-পেনসিল হাতে নিতেই দেখা গেল ৩-৪ ইঞ্চি পেনসিল ভেঙে গেল। পেনসিল ভাঙা তেমন কোনো দোষের ছিল না। এটা অনেকের হাতেই ভাঙে। কিন্তু সিলেট তেমন কারও কাছে ভাঙত না, আমার কাছে ভাঙত। অনেকেই হয়তো সিলেট বুঝতে পারছেন না। এ সিলেট সিলেট জেলা নয়। এ সিলেট ১২ বাই ৮ ইঞ্চি এক টুকরো কালো রঙের পাথর। আসলে প্রাকৃতিক পাথর নয়। কোনোভাবে জমানো কাচের মতো পেনসিল দিয়ে লিখলে তাতে দাগ পড়ত, লেখা হতো। সব স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ব্ল্যাকবোর্ড, সিলেট তারই বিকল্প। এখন বাচ্চারা খাতাপত্রেই লেখালেখি করে বেশি। আমরা আগে সিলেটে লিখতাম। আবার মুছে ফেলে নতুন কিছু করতাম। ছোট্ট ছোট্ট সিলেটের চারপাশ দিয়ে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো থাকত। খুব সহজে ভাঙত না। কিন্তু আমার হাতে তখন অযথাই ভাঙত। এসবের কোনো কারণ বুঝতাম না। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী কলেজে পড়ার সময় ধোপাবাড়ি থেকে কাপড় আনতে পাঠালে ১৫-২০ মিনিটের পথ ২-৩ ঘণ্টাতেও শেষ হতো না। আমি ছুটেছি ধোপাবাড়ি থেকে কাপড় আনতে। হয়তো রাস্তায় কোনো মেকানিক গাড়ি মেরামত করছে। আটকে গেলাম সেখানে। গাড়ি মেরামত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার কোনো মুক্তি নেই। দেখছি তো দেখছি। গাড়ি তাড়াতাড়ি ঠিক হলে আমারও তাড়াতাড়ি ছুটি। আর না হলে মিস্ত্রির গাড়ি মেরামত দেখার যেন শেষ নেই। কাউকে কোনো কাজ করতে দেখলে সেটা ভালো লাগলে কোথা দিয়ে সময় কেটে যেত কিছুই মনে থাকত না। যেখানে আধ ঘণ্টায় ফিরব সেখানে ৩ ঘণ্টায় ফেরার পর কপালে যা জোটার তাই জুটত। বড় ভাই হয়তো পুরনো কাপড় পরেই কলেজে চলে গেছেন। রাতে বাড়ি ফিরে দেরি হলো কেন তার জন্য শাস্তি। এমনই ছিল আমার ছেলেবেলার জীবন। কারও কাছে তেমন আদর ভালোবাসা পেতাম না একমাত্র মা আর মাউই সাহেব ছাড়া। সংসারে তখন মার তেমন কর্তৃত্ব ছিল না। কিন্তু আমার মাউই সাহেবের কর্তৃত্ব ছিল সর্বব্যাপী। আমার বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকীকে আড়াই-তিন বছর বয়সে রেখে আমার দাদি মারা যান। আমার দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকী পরে আবার বিয়ে করেন। দাদার মা করিমন নেছা সিদ্দিকী বাবাকে যেমন লালন পালন করে বড় করেছিলেন, ঠিক তেমনি আমাকেও খুব ভালোবাসতেন। আমার একমাত্র আশ্রয় ছিলেন আমার মাউই মা। বাবা তাকে ভীষণ সম্মান করতেন, ভয়ও করতেন। তাই এত কষ্টের মধ্যেও মাউই সাহেব ছিলেন আমার সব থেকে বড় আশ্রয়স্থল। তিনি কাছে থাকলে আমার কোনো ভয় ছিল না। কারোর কোনো ক্ষমতা ছিল না গায়ে একটা টোকা দেয়। কিন্তু মাউই সাহেব যখন গ্রামের বাড়ি থাকতেন আমি শহরে এলে আমার কোনো আশ্রয় থাকত না। জীবন এক না একভাবে চলেই যায়। জীবন কখনো বদ্ধ পানির মতো থেমে থাকে না। আমার জীবনও থেমে থাকেনি। গত পরশু সখিপুরের কয়েক জায়গায় গামছার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার করতে গিয়েছিলাম। আমার পাশে বসেছিল আমাদের পরিবারের সব থেকে ছোট ভাই আজাদ সিদ্দিকী। ও কেন যেন এখন সুন্দর করে পোশাক-আশাকও পরে না। জামা পরে বোতাম ছাড়া। স্বাস্থ্যটাও অত সুন্দর নয়। হঠাৎই কেন যেন মনে হলো আজাদও তো অনেক বড় হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওর বয়স ছিল চার সাড়ে চার বছর। কাকড়াজান ইউনিয়নের শুরীরচালায় আমাদের প্রাক্তন বিচারপতি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর খামারবাড়িতে কিছুদিন আমার মা-বাবা ছিলেন। সেখানে আজাদ, মুরাদ কলাগাছের ডাইগা দিয়ে এলএমজি বানাত। সেটা রাস্তার দিকে মুখ করে সারা দিন খেলাধুলা করত। সে আজাদেরও এখন ৫৭-৫৮ বছর। আর যুদ্ধের সময় আমি যাদের ৫০ বছরের দেখেছি তাদের বৃদ্ধ মনে হতো। কিন্তু এখন ৭০ বছরে অনেককেই বৃদ্ধ মনে হয় না। দূরে কোথাও যাব কেন, ফরিদ আমার কাছে গিয়েছিল ’৮৩ সালে। ’৬২ সালে জন্ম। এখন তার ৬১ বছর বয়স। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হয় এই তো সেদিন মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ছোট্ট একটা ছেলে বর্ধমানে ৪৬ সদরঘাট রোডে হাজির। কী করে যে দিন চলে যায় কিছুই বোঝা যায় না। আমি জন্মের ২০-৩০ মিনিট পর ছোট বোন শাহানার মেয়ে ইয়ামণিকে দেখেছিলাম। ইয়া জন্মের পরপর মা তাকে কোলে নিয়েছিলেন। মা-ই এনে আমার কোলে দিয়েছিলেন। আমি ওর থেকে ছোট কোনো বাচ্চা আর কখনো কোলে নিতে পারিনি। দীপকে কোলে নিয়েছিলাম কলকাতার নেতাজি সুভাষ বোস দমদম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। তখন দীপের বয়স ছিল ৪০ দিন। মা কুঁড়িমণিকে প্রথম কোলে নিয়েছিলাম ৫০-৫৫ দিন বয়সে। পা ধুয়ে পানি খেয়েছিলাম দেশে ফিরে ১১ মাস পর।

আসলে একসময় আমাকে নিয়ে আমার পরিবার বড় বেশি দুশ্চিন্তায় ছিল। ’৬৬ সালে কোনো একদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের ধুমঘাটে আমাদের ব্যাটালিয়ন সিক্স বেঙ্গল রেজিমেন্টের শীতকালীন মহড়া ছিল। সে রকম সময় বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি তখন বাংলার দ্বিতীয় আলীগড় নামে খ্যাত করটিয়া সা’দত কলেজের ভিপি। তিনি বলেছিলেন, ‘বজ্র, বাড়ি থেকে রাগ করে সেনাবাহিনীতে এসেছিস। আমরা এতে কোনো বাধা দেব না। কিন্তু এখন থেকে ১০-১৫ বছর পর তোকে নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে। তোরও খারাপ লাগবে। রহিমা, শুশু, শাহানা, বেলাল, বাবুল, আজাদ, মুরাদ ওরা যদি বড় হয়ে কোনো বড় কাজ করে তোকে পরিচয় দিতে কষ্ট হবে। কেউ যদি চাকরি-বাকরি করে সরকারি অফিসার হয় তখন তোর পদমর্যাদা হবে অনেক নিচে। তোরও খারাপ লাগবে, আমাদেরও খারাপ লাগবে। তাই বাড়িতে ফিরে লেখাপড়া কর। লেখাপড়া করে সেনাবাহিনীতে যেতে ইচ্ছে করে নিশ্চয়ই যাবি। কিন্তু এই সিপাহি পদে না করে কমিশন্ড নিয়ে সেনাবাহিনীতে থাকলে তোর অনেক অগ্রগতি হবে।’ এখন বুঝি জ্ঞানী লোকের জ্ঞানের মর্যাদা কতখানি। আমি আমার বড় ভাইকে যা ইচ্ছে তাই গালাগাল করতে পারি না। খুবই খারাপ লাগে। উনি আমাকে অনেক গালাগাল করেছেন, এখনো করেন। কিন্তু কাছে বসলে মা-বাবার মতো আদরযত্ন করতে কখনো ভুল করেন না। আমার বাবা ছিলেন সত্যিই একজন সাহসী মানুষ। নাটক করা সাহসী নয়, প্রকৃত সাহসী মানুষ। আমি যখন কুমিল্লা ময়নামতী ক্যাম্পে পাঞ্জাব লাইনে থাকতাম তখন বাবা গিয়েছিলেন সেখানে। তিনি আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল হামিদ হোসেন সিক্রির সঙ্গে দেখা করে আমাকে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ’৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমি সেনাবাহিনী থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম। তখন কীভাবে কীভাবে যেন সব মিলিয়ে ৭শ কয়েক টাকা পেয়েছিলাম। ৫০-৬০ টাকা বাদে সবই মাকে দিয়েছিলাম। তখনকার ওই সময় ৫-৭শ টাকা ছোটখাটো অ্যামাউন্ট না। বেশ ভালো অ্যামাউন্ট। ও দিয়ে অনেক কিছু করা যেত। তখন আমাদের পরিবারের বেশ কষ্ট। টাঙ্গাইলের এসডিও জি এম কাদরীর কারণে বাবার মোক্তারি লাইসেন্স জব্দ হয়েছিল। এক সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান যেমন গর্ব করে বলতেন, আমি থাকতে শেখ মুজিবকে সূর্যের মুখ দেখতে দিব না। তিনি সে নিয়ে চরম চেষ্টাও করেছেন। ’৬৯-এ দুর্বার গণ আন্দোলন না হলে, আইয়ুব খানকে আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করতে না হলে সত্যিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়তো সূর্যের মুখ দেখতেন না। ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা মামলার অন্যসব বন্দিও মুক্তি পান। শুধু মুক্তি পাননি অ্যাডভোকেট আমিনুল হকের ছোট ভাই সার্জেন্ট জহুরুল হক। ১৪ বা ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাতে ’৬৯-এর আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠে এবং তার এক সপ্তাহের মধ্যেই আগরতলা মামলা তুলে নিয়ে সবাইকে মুক্তি দিতে হয়। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ’৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে আমি সামরিক বাহিনী থেকে ফিরে আসার পরপরই দেশরক্ষা আইনে তাকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ জেলে রাখা হয়। ’৬৯ সালে আমাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেখানে আমি ছিলাম, আবু আহমেদ আনোয়ার বক্স ছিলেন, কবি আল মুজাহিদীর ছোট ভাই শামীম আল মামুন ও তখনকার করটিয়া কলেজের ভিপি খন্দকার আবদুল বাতেন ছিলেন। আইয়ুব খান ১ ফেব্রুয়ারি ’৬৯-এ জাতির উদ্দেশে এক আবেগময়ী বেতার এবং টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে ছাত্র ও যুবসমাজকে আইয়ুব খানের চোখের মণি ও মাথার তাজ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তারপরও বেপরোয়াভাবে আমাদের অনেককে গ্রেফতার করেছেন। কিন্তু তার এই গ্রেফতারি পর্ব খুব একটা বেশি দিন টিকেনি। দেশ আরও উত্তাল হয়ে উঠলে আমাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। ’৬৭ সালে জেলে গিয়ে লতিফ ভাই, কিশোরগঞ্জের নগেন সরকার, অষ্টগ্রামের আবদুল বারী, মুক্তাগাছার শহিদুল্লাহ মালেক এরকম কয়েকজন সে পর্বে অনেক দিন জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধু ২২ ফেব্রুয়ারি ’৬৯ মুক্তি পেলেও ময়মনসিংহ জেলখানায় যখন রাজবন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার কথা হয় তারা কেউ রাজি হয়নি। তাই ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ জেলের রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। আমরা টাঙ্গাইল থেকে সাঈদ দারোগার গাড়ি নিয়ে ময়মনসিংহ গিয়ে লতিফ ভাইকে নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন ময়মনসিংহ টাউন হলের সামনে কারামুক্তদের এক অসাধারণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। আমরা সবসময়ই ছিলাম বিপদে। ’৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে গিয়ে ’৬৭ সালে ফিরে এসেছিলাম। দুই বছর কয়েক মাস ছিল আমার সেনাবাহিনীতে অবস্থানের মেয়াদ। ’৬৫-তে সবাইকে এক আত্মা এক প্রাণ দেখে গিয়েছিলাম। ’৬৭ সালে এসেই দেখলাম টাঙ্গাইলের ছাত্রদের দুই গ্রুপ হয়ে গেছে। একটা শাজাহান সিরাজ সমর্থিত, অন্যটা আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ’৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলনে শাজাহান সিরাজকে দেখিনি। শাজাহান সিরাজকে একজন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা হিসেবে ’৬৭ সালে প্রথম দেখেছি। অথচ আমাদের টাঙ্গাইলের বাড়ির বাইরের ঘরে বড় ভাই প্রতিদিন শাজাহান সিরাজকে তালিম দিতেন, বক্তৃতা শেখাতেন। তিনি তখন অনেক বড় নেতা। আমার মনে হয় শাজাহান সিরাজ আর লতিফ সিদ্দিকীর ভাগাভাগির কোনো মানে ছিল না। সৎপথে স্বীকার করলে নেতা হিসেবে নেতৃত্ব হিসেবে লতিফ সিদ্দিকীর কাছে তখনো শাজাহান সিরাজ ছিলেন অতি সাধারণ শিশুর মতো। যা হোক আমার দলাদলি করতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু তবু দলাদলিতে পড়তাম। দলাদলির চাপ আসত আঘাত আসত। আমাদের অনেক সময় অনেক সভা-সমিতির কথা জানানো হতো না। তবু গিয়ে হাজির হতাম উল্কার মতো। সাধারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত। স্বাভাবিক মিছিল-মিটিংয়ে আমাদের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারত না শাজাহান সিরাজের দল। যেটা মুক্তিযুদ্ধে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের পরে দেখা গেছে। জাসদ গঠিত হলে পুরো শাজাহান সিরাজের দলসহ সবাই ছিল জাসদে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুকে অসফল করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করেনি। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলে যত মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী মারা গেছে সব মেরেছে জাসদের গণবাহিনী আর সিরাজ সিকদারের দল সর্বহারা পার্টি। এখন আওয়ামী লীগে কোনো বাছবিচার নেই। বরং যারা বঙ্গবন্ধুকে রাতদিন জ¦ালিয়েছে, তাঁকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে তারাই যেন এখন প্রধান আওয়ামী লীগ। এ জন্য অনেক অসুবিধা হয়েছে। আওয়ামী লীগে অনেক দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। যারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব করেন তাদের অনেকে একসময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিলেন না। তবে এটা সত্য, স্বাধীনতার পর তেমন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে প্রথম মোশতাক এসেছিলেন ক্ষমতায়। তার ৩-৪ মাসের মধ্যেই জিয়াউর রহমান আসেন রাজনৈতিক পাদপ্রদীপের নিচে। জিয়াউর রহমান এসে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যেখানে যাকে পান তাকেই নিয়ে চলা শুরু করেন। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, কোনো রাজনৈতিক সংগঠন না থাকলে যে কেউ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য যাকে যেখানে দরকার তাকেই সেখানে ব্যবহার করেন। আর মেরুদন্ডসম্পন্ন মানুষ হলে এসব করে তিনি অনেকটাই সফলতা অর্জন করেন। জিয়াউর রহমানও তাই করেছেন। এখন জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি আগের অবস্থানে নেই। একসময় শুনতাম জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর ভাঙা সুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি পাওয়া গিয়েছিল। এটাই যদি সত্য হয় তাহলে জিয়াউর রহমান তেমন দুর্নীতিপরায়ণ ছিলেন না। কিন্তু এখন বিএনপি হলেই কোটি কোটি শত কোটি। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের বাইরে সবাই নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু অনেকের কাছে শুনেছি, মনোনয়ন বিক্রি করে তারেক রহমানের নাকি ৩-৪ হাজার কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। আমার বিশ্বাস আমি আমার সারা জীবনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় যা বুঝতে পেরেছি তাতে সম্মান এবং অর্থবিত্ত একসঙ্গে চলে না। কিন্তু এখন অনেকের ক্ষেত্রেই অন্যরকম দেখতে পাচ্ছি। যারা রাজনীতি করেন, তারা আবার বিত্তবৈভবও গড়ে তোলেন। যা মোটেই ঠিক না।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর