বুধবার, ১৯ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

পৃথিবীতে ইসলামই নারীদের অধিকার সত্যিকারভাবে নিশ্চিত করেছে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পূর্ণতা দানকারী আখেরি নবী বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ব পর্যন্ত নারীকে তুচ্ছ মনে করা হতো। এমনকি নারীদের আত্মা আছে কি না তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করা হতো। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবিত স্ত্রীকেও স্বামীর সঙ্গে চিতায় আত্মাহুতিতে বাধ্য করা হতো। মাসিক চলাকালীন বিশেষ সময়ে নারীকে অপবিত্র মনে করে পরিবার থেকে আলাদা করে তাকে নির্জন বাসে আবদ্ধ করা হতো। বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের সমাজে কোনো ঠাঁই ঠিকানা ছিল না। কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। পৃথিবীতে আজকের সভ্য সমাজেও নারীকে পণ্য ও উপভোগের সামগ্রীতে পরিণত করা হয়েছে। সর্বত্রই নারীর দেহ ও সৌন্দর্যের প্রদর্শনী, উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনার ছড়াছড়িতে ব্যাপক মহামারি দেখা দিয়েছে। ফলে যুবসমাজের চরিত্র ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। নারী স্বাধীনতার নামে উচ্চাভিলাষী নারীদের তাদের ঘর থেকে বের করে নারীদেহ ভোগ-লুটপাটের মহাআয়োজন চলছে। পুরুষের দৃষ্টিতে নারী এখন সস্তা মালে পরিণত হয়েছে। হোটেল রেস্তরাঁ ও পার্কসহ সভ্য সমাজেও এখন বহুমুখী পতিতালয় গড়ে উঠেছে। পাশ্চাত্য সভ্যতায় গড়ে ওঠা উচ্চাভিলাষী নারীরা নিজের ইজ্জত-সম্ভ্রম বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। এখনো কোনো কোনো সমাজে নারীর উত্তরাধিকারিত্বের স্বীকৃতি নেই। বর্তমান অসভ্য পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থা ও জাহেলি যুগের সমাজ চিত্র অবলোকন করলে, ইসলামী সমাজ ও অনৈসলামী সমাজের নারীর অধিকার সম্পর্কিত পার্থক্য ধরা পড়ে। কন্যাশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবরে ওদের মন-মানসিকতা হয়ে যেত ভারাক্রান্ত, চেহারা হয়ে পড়ত বিবর্ণ। আল কোরআনে সেই চিত্রের বর্ণনা রয়েছে এভাবে। ‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ দেওয়া হতো, তখন তার চেহারা হয়ে যেত কালো, আর সে হয়ে পড়ত ক্লিষ্ট মানসিকতাসম্পন্ন।’ (সুরা নাহাল, আয়াত- ৫৮) কন্যা সন্তান জন্মকে অশুভ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, অথচ ইসলাম একটি বা দুটি কন্যা সন্তান জন্মদান করে পরম মায়া মমতায় সযত্নে লালন-পালনকারী পিতা-মাতাকে জান্নাতি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম কন্যা সন্তান জন্ম, পরিবারের রহমত ও বরকত লাভের কারণ বলা হয়েছে। কন্যা সন্তানের বাঁচার অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, এমনকি সার্বিক মানবিক অধিকার ইসলামই প্রতিষ্ঠিত করেছে। একটি কন্যা সন্তানের বিবাহ-পূর্ব পর্যন্ত তার যাবতীয় ভরণপোষণ, পর্দা পুশিদা, সুশিক্ষা ও আমল আখলাকের দায়িত্ব পিতা-মাতার ওপর ন্যস্ত থাকে। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দায়িত্ব অর্পিত হয় স্বামীর ওপর। অধিকন্তু মোহরানা স্বরূপ প্রাপ্ত সম্পদের তো প্রথম দিনেই সে মালিক হয়ে যায়। এ সম্পদে স্বামী বা অন্য কারও মালিকানা নেই। আবার স্ত্রীর আয় উপার্জনের সমস্ত অর্থ তার নিজের, তাতে স্বামীর মালিকানা থাকবে না। অন্যদিকে নারীরা ওয়ারিশ সূত্রে পিতা-মাতা, স্বামী, ভাই সবার সম্পত্তির অংশ পেয়ে থাকে। এভাবে ইসলাম নারীর অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নারীর সার্বিক অধিকার সম্পর্কে আল কোরআনের নির্দেশ হলো, ‘নারীদেরও তেমনই অধিকার আছে, যেমন তোমাদের আছে তাদের ওপর’ (সুরা বাকারা আয়াত-২২৮) অধিকার ও মর্যাদার ব্যাপারে ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছে। অবশ্য সৃষ্টিগত পার্থক্যের কারণে উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্যে রয়েছে তারতম্য। এ তারতম্য নিরূপিত হয়েছে মহাজ্ঞানী আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল ও দুনিয়ার জীবনের সুশৃঙ্খলা ও ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে। কর্তৃত্বের এতটুকু তারতম্য না থাকলে, বিশ্ব শান্তি ব্যাহত হতো, আর দুনিয়ার শৃঙ্খলা হয়ে পড়ত লন্ডভন্ড। আল কোরআনে সেই তারতম্যের কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে এভাবে। ‘আর পুরুষদের জন্য রয়েছে নারীদের ওপর মর্যাদা।’ (সুরা বাকারা ২২৮) এ হচ্ছে কর্তৃত্বের পার্থক্য বা সার্বিক কর্ম পরিচালনার তারতম্য ভিত্তিক মর্যাদা। তারপরও কতিপয় বিশেষ পর্যায়ে ইসলামী শরিয়ত নারীদের মর্যাদার ঘোষণা করেছে। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে উত্তম তারা যারা নিজেদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম। (তিরমিজি) স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচার ও উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়ে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে জীবনযাপন করবে, (সুরা নিসা আয়াত-১৯) তাদের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা ও নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত কর। তাদের ইজ্জত সম্ভ্রম রক্ষা কর। পৃথিবীর সব মায়া মমতা, ভালোবাসা, অগ্রযাত্রা ও প্রেরণার প্রধান উৎস এই নারী। প্রিয় নবীজি বলেন, আমার বংশধারা কিয়ামত পর্যন্ত আমার কন্যার মাধ্যমেই অব্যাহত থাকবে। একটি হাদিসে প্রিয় নবীজি মায়ের সম্মানের কথা তিনবার বলেছেন ও বাবার কথা একবার বলেছেন। পৃথিবীতে কোনো নারী নবী ও রসুল হননি, কিন্তু তারা নবী ও রসুলগণের জন্মদাত্রী ও লালন-পালনকারী হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

লেখক : ইমাম ও খতিব : কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর