বৃহস্পতিবার, ২০ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

আশার ছলনে ভুলি, কি ফল লভিনু

বাংলা সাহিত্যে একমাত্র সফল মহাকাব্য রচয়িতা, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর নিজের জীবনের উপমা দিয়ে ‘আত্মবিলাপ’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়, তাই ভাবি মনে?’

অসাধারণ এবং বিরল প্রতিভা এবং প্রজ্ঞার অধিকারী এই কবি নিজের জীবনে দুরাশার মরীচিকার পেছনে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে আক্ষেপ করে যা লিখেছেন, সেটি বোদ্ধা এবং নির্বোধ নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু তারপরও দেখা যায় কিছু স্বল্প প্রজ্ঞার লোক মাইকেলের বাণী মানতে নারাজ। ইদানীং দেখা গেল বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ অন্য নেতৃবৃন্দ, যাদের সীমিত প্রজ্ঞার লোক বললে ভুল হবে না, তারা এই ভ্রান্ত আশার কুহেলিকা নিয়ে এতই উ™£ান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তারা বাস্তবতা নিরীক্ষা করার প্রয়োজন মনে করেননি। তারা নির্বোধের মতোই ধরে নিয়েছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেবে। সে ভাবনা নিয়ে তাঁরা রাতের ঘুম হারাম করে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে ধরনা দিচ্ছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। তাঁদের ভ্রান্ত প্রত্যাশা বহু গুণে বেড়ে গেল যখন জানা গেল যে, উজরা জেয়া নামক এক মার্কিন প্রতিমন্ত্রী ঢাকায় আসছেন। তারা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, সেই মন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করবে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে। কিন্তু তারা এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, মার্কিন দল আসছে মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক এবং ভারত মহাসাগর মুক্ত রাখার যে কৌশল যুক্তরাষ্ট্র হাতে নিয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা পাওয়ার জন্য, কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে, অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের ভূমিকা অপরিহার্য। একই উদ্দেশ্যে মার্কিন মন্ত্রী ভারতেও গিয়েছিলেন। এটি ঠিক যে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আলাপ করাও তার এজেন্ডায় ছিল, কিন্তু সেটি ছিল আলোচ্যসূচির নিম্ন অবস্থানে।

যাই হোক, বিএনপি নেতাদের নিরাশ করে মার্কিন মন্ত্রী আলোচনার জন্য তাদের ডাকেননি, অথচ তারা নিশ্চিত ছিলেন, তাদের সঙ্গে মার্কিন মন্ত্রী আলাপ করবেন। দাওয়াত না পেয়ে তারা উন্মাদের মতো এদিক-সেদিক দৌড়ঝাঁপ দিতে থাকেন, যে কোনো মূল্যে দাওয়াত আদায় করার জন্য। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তারা সব জায়গা থেকে নেতিবাচক জবাব পেয়ে অবশেষে ঢাকার কানাডাস্থ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন, কিন্তু ফল হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা মার্কিন মন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার উল্লেখই করেননি, সোজা বলেছেন, বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, তা বাংলাদেশের মানুষই ঠিক করবেন, এটা বিদেশিদের বিবেচনার বিষয় নয়। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। মন্ত্রী আরও বলেছেন, তাঁরা দেখতে চান নির্বাচনে যেন সহিংসতা না হয়। এ কথাটি যে বিএনপিকে উদ্দেশ করেই বলা হয়েছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা, অতীতের নির্বাচনে বিএনপি তাদের জ্বালাও-পোড়াও কর্মকা-সহ বহু সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে বহু লোককে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করেছে, যে কথা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। মার্কিন ভিসানীতি থেকে বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা ভেবেছিলেন এটি ক্ষমতায় অবস্থানরত আওয়ামী জোটের বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ। সেই মনগড়া ধারণাটিও নস্যাৎ করে দিয়ে মার্কিন মন্ত্রী বরং উল্টোটাই বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্যই মার্কিন ভিসানীতি। মার্কিন মন্ত্রীর এহেন উক্তি বিএনপি-জামায়াত নেতাদের মাথায় বজ্রাঘাতসম হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তাছাড়া মার্কিন মন্ত্রী একটিবারের জন্যও বলেননি, তারা সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান। তারা শুধু সুষ্ঠু নির্বাচনের কথাই বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক শব্দটি বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্টি।

বিএনপি-জামায়াত নেতারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারস্থ হয়েও খালি হাতে ফিরে এসেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আমলেই নেয়নি।

এভাবে সব জায়গায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বিএনপি-জামায়াত নেতারা পরাজয় স্বীকার করে এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন, বিদেশিদের থেকে কোনো কিছু পাওয়া যাবে না বিধায় তাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। মার্কিন মন্ত্রীর ঢাকা আগমনের আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীর বলেছিলেন, তাঁর দল মার্কিন প্রতিনিধিদের কথা শোনার পর, তাদের হাবভাব দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। তাঁর এই কথা প্রমাণ করছে যে, তাঁরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণরূপে বিদেশিদের ওপর ছেড়ে দিতে চান, যেমনটি মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘষেটি বেগম গং করেছিলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর বাংলার ভবিষ্যতের ভার তুলে দিয়ে। ফখরুল ইসলাম আলমগীর মার্কিন মন্ত্রীকে দেখানোর জন্য ১২ জুলাই যে শোডাউন করেছিলেন, তাতেও কাজ হয়নি। এরপরও মির্জা আলমগীর যা বললেন তা আরও ভয়াবহ। তিনি বলেছেন, গায়ের এবং অস্ত্রের জোরে তারা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। তার এ কথার জন্য তিনি নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে শাস্তি পেতে পারেন। তা ছাড়া তাঁর এই বক্তব্য প্রমাণ করছে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের মোটেও কোনো আকর্ষণ বা সমর্থন নেই। তাঁর ভাষা গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাঁদের তত্ত্বাবধায়ক দাবি সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কারণে যেমন অবান্তর, তেমনি অবান্তর ঘটনাগত কারণেও। সর্বোচ্চ আদালত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী অনির্বাচিতদের দ্বারা দেশ শাসনের বিধান নেই বলে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অপ্রযোজ্য।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ব্যাপারে অনেকে সংবিধান পরিবর্তনের দাবি করছেন। কিন্তু তাদের জানা উচিত, সংবিধান পরিবর্তনেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে এই মর্মে যে, পরিবর্তনের নামে সংবিধানের কোনো মৌলিক স্তম্ভ গুঁড়িয়ে ফেলা যায় না। নির্বাচিতদের দ্বারা শাসন আমাদের সংবিধানের একটি মৌলিক স্তম্ভ হওয়ায়, তা পরিবর্তনের সুযোগ নেই।

আইনি বিষয় ছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির বিভীষিকা আমরা দেখেছি। সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে যে তান্ডব সৃষ্টি করেছিল, তার বিস্তারিত সাহাবুদ্দিন সাহেবের (বর্তমানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি) তদন্ত প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তখন প্রথমত লতিফুর রহমান গংদের নির্দেশনায় এবং প্রত্যক্ষ মদদে শত শত হিন্দু ধর্মের মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, শত শত গৃহ আগুনে পোড়া হয়েছিল, শত শত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, পুলিশকে বলা হয়েছিল মামলা গ্রহণ না করতে, হাজার হাজার হিন্দুকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। সে সময়ের নির্মমতা বিশ্ব বিবেককে প্রকম্পিত করেছিল, ঢাকা শহরেই বিশ্বের বহু বরেণ্য মানবাধিকার নেতা-কর্মী একত্রিত হয়েছিলেন লতিফুর রহমান এবং পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত মানবাধিকার দলনের প্রতিবাদ করার জন্য। ক্ষমতা পাওয়ার আগেই লতিফুর রহমান তাঁর তথাকথিত ‘হোম ওয়ার্কের’ দ্বারা বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে যে বেআইনি কাজটি করেছিলেন তা ভুলে যাওয়ার নয়। লতিফুর রহমানের এক উপদেষ্টার এক সহোদর চট্টগ্রাম থেকে বিএনপির টিকিটে নির্বাচন করার পরও সেই উপদেষ্টা পদত্যাগ করেননি। গ্রামবাংলার ভাষায় বলতে গেলে বিচারপতি লতিফুর তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছিলেন। এরপর বাকি ছিল তেরোটা বাজানোর, যা করেছেন বিএনপি নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন। তিনি আইন ভঙ্গ করে নিজেই নিজেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করেই ক্ষান্ত হননি, তিন মাসের স্থলে দুই বছর ক্ষমতায় অবস্থান করে তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত আইনকে টুঁটি চেপে হত্যা করে তিনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার তেরোটা বাজাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কয়েকজন উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তার সহায়তায়, যারা দুর্নীতির সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছিলেন এবং পরে কোটি কোটি ডলার পাচার করে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন। প্রবল জনচাপ না হলে তারা সম্ভবত আরও বহু বছর ক্ষমতা ছাড়তেন না। ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হলে যে নতুন লতিফুর রহমান বা ইয়াজউদ্দিনের উদয় হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? তাই যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবান্তর দাবি তুলছেন, তাদের বোঝা উচিত, এ ধরনের ব্যবস্থা গণতন্ত্র এবং দেশকে ধ্বংস করবে। আজ তারাই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির কথা বলছেন যারা নির্বাচনকে ভয় পান এটা জেনে যে, জনগণ তাদের সঙ্গে নেই।

শেষ করার আগে কিশোর কুমার গাওয়া একটি গানের কথা মনে পড়ল। প্রবাদপ্রতিম গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানটি হলো, ‘আশা ছিল, ভালোবাসা ছিল, আজ আশা নেই, ভালোবাসা নেই।’ আরও কথা ছিল, ‘আজ এখানে আমার আশার সমাধি, ব্যথা জানাবার ভাষা নেই।’ এ গান গাওয়া ছাড়া মির্জা ফখরুলদের আর পথ রইল না।

সেদিন কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য নামক এক সর্বজন নন্দিত বাউল দর্শনের গবেষক এবং লোকসংগীত শিল্পীর (তার আকস্মিক প্রয়াণের কিছুদিন আগে নেওয়া) এক সাক্ষাৎকার দেখলাম। গভীর প্রজ্ঞাবান এই প্রয়াত গবেষক বলেছিলেন, তিনি ২০০০ সালে প্রথম যে তিনটি আশা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তার সবকটিই পূরণ হয়েছিল, যার একটি ছিল চিরস্মরণীয় বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের (যাকে কালিকা বাবু এক মহামানব বলে আখ্যায়িত করেছেন) সাক্ষাৎ, কেননা তিনি এমন কিছু আশা করেননি, যার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কালিকা প্রসাদ বাবু এই বলে শেষ করেছিলেন যে, সব মানুষের আশা এমন হওয়া উচিত যা পূরণ করা সম্ভব। তাঁর মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো- বামন হয়ে চাঁদ ধরার আশা করা উচিত নয়। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি মির্জা ফখরুল গং তা-ই করার চেষ্টারত ছিলেন, আর সে কারণেই তাদের চেষ্টার গুড়ে বালি পড়েছে।

 

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর