শনিবার, ২২ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

অনলাইনে আম, রপ্তানিতে আম

শাইখ সিরাজ

অনলাইনে আম, রপ্তানিতে আম

বাঙালির কাছে রসের ফল মানেই আম। শুধু বাংলায় নয়, রসালো আমের মিষ্টতার গল্প আর ঘ্রাণ লেগে আছে ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরতে পরতে। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে সিন্ধু উপত্যকায় এসে আলেকজান্ডারের চোখে পড়ে আমের বাগান। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ আমের স্বাদ ও সুগন্ধের মজা পেয়ে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এর ফলে আমের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। মুঘল সম্রাট আকবর ভারতের শাহবাগের দাঁড়ভাঙায় ১ লাখ আমের চারা রোপণ করে সৃষ্টি করেন উন্নত জাতের আমবাগান। আমের ইতিহাস কিংবা ইতিহাসে আম- বলে শেষ করা যাবে না। আমে এসে অভিজন আর আমজনতা মিলেমিশে একাকার। সবারই প্রিয় ফল আম। সংস্কৃত ভাষায় আমকে বলা হয় আম্র, যার আভিধানিক অর্থ ‘সুখে ভোগ করা’। আম ভোগের ‘সুখ’ ভোক্তা মাত্রই জানেন। মৌসুমে আমের ব্যাপক চাহিদা। চাহিদার বিপরীতে দিন দিন উৎপাদনও বাড়ছে। বিশ্বে আম উৎপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম স্থানে উঠে এসেছে। সারা দেশে আমের বাজার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু আমের রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে একেবারে তলানিতে আছে। বিশ্বে কোটি কোটি টাকার আমের বাজার। কয়েকদিন আগেও ধারণা করা হচ্ছিল ২০২৯ সালে বৈশ্বিক আমের বাজার হবে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি ইউএস ডলারের।

বছর দশেক আগেও এদেশে প্রতিটি ফলের দোকান ভরে থাকত ভারতীয় আমে। বাংলাদেশে প্রধানত ভালো জাতের আম হতো রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে। তা ছাড়া সারা দেশের মানুষের গৃহস্থ ভিটায় যেসব আম গাছ থাকত, সেগুলো ছিল সাধারণ জাতের। আমের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে দিনে দিনে দেশের সবখানে ছড়িয়ে গেছে আমবাগান। বাংলাদেশে আম উৎপাদন প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আমের বহুমুখী বাণিজ্যিকায়ন শুরু করে কৃষি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনার সময়টাতে আমের বাজার নিয়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। ভেবেছিলেন করোনার কারণে যেভাবে যোগাযোগ ও বাজার বন্ধ ছিল, হয়তো কৃষক আম নিয়ে বিপাকে পড়বে, ঠিক তখন কিছু তরুণ উদ্যোক্তা অনলাইনে আমের বেচাকেনার ব্যবস্থা করল। আমের বাজারের চিত্রটাই পাল্টে গেল। তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক বছর ধরেই আমের অনলাইন বাজার বেশ জমজমাট।

আমের ঝুড়ি, আম্রকানন, ফজলি ডটকম, ম্যাঙ্গো বাজার হরেক নামে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অনলাইন প্ল্যাটফরমে আমের বেচাকেনায় বিক্রেতা ও ভোক্তা উভয়ই খুশি। তরুণ উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি আম চাষিরাও ঝুঁকছেন অনলাইন বাজারের দিকে। কারণ এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য যেমন থাকে না, থাকে না বাজার সিন্ডিকেটের মারপ্যাঁচ। ফলে কৃষক তার আমের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন।

আমের উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল পেতে হলে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রসার ঘটাতে হবে এবং আমের রপ্তানি বাড়াতে হবে। মনে আছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ একসময় আশ্বিনা আম নিয়ে বিপাকে ছিল। দাম পেত না। দেশে প্রথমবারের মতো আম থেকে শিল্পপণ্য তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আমজাদ খান চৌধুরী। প্রায় ১৫ বছর আগে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছিলাম নাটোরসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় স্থানীয় জাতের টক আম ও আশ্বিনা আম কী করে যুক্ত হয় বাণিজ্যিক ধারায়। আগে যেসব আম গাছের নিচে পড়ে থেকে নষ্ট হতো, সেগুলোও হয়ে উঠল কৃষকের অর্থকরী পণ্য।

আমাদের দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার কৃষি অর্থনীতিতে যে মাত্রা যোগ করেছে, সেখানে রপ্তানি সম্ভাবনারও একটি বড় অবদান রয়েছে। বেশ কয় বছর আগে থেকেই আমাদের দেশের আম বিচ্ছিন্নভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। স্থানীয় ছোট ছোট বাজারে, যেগুলোকে বলা হয় এথনিক মার্কেট, সেগুলোতে প্রবাসীদের মাঝে বিক্রি হয়ে আসছে। কিন্তু ইংল্যান্ড বা আমেরিকার হোলসেল মার্কেটগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য আমি খুঁজে পাইনি। ২০১৫ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আম রপ্তানির একটি দ্বার উন্মোচন হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের বাজারে আম রপ্তানি শুরু হয়। আম রপ্তানির প্রথম চালান যুক্তরাজ্যের ওয়ালমার্ট চেইনশপে পৌঁছায়। আমের রপ্তানি বাজার উন্মুক্ত করার পেছনে বড় ভূমিকাটি ছিল বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও)। এফএওর তৎকালীন প্রতিনিধি মাইক রবসন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, হর্টেক্স ফাউন্ডেশনকে সঙ্গে নিয়ে আম রপ্তানির কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল এসে দেশের আম উৎপাদনকারী এলাকা সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী পরিদর্শন করেন। ৯টি জাতের আমের নমুনাও পাঠানো হয়। সেখান থেকে তারা তিনটি জাত হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি বাছাই করেন। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকেও রপ্তানি উপযোগী আম উৎপাদন, ব্যাগিং পদ্ধতির ব্যবহার ও সচেতনতা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন তৈরি করে প্রচার করি। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিদের নিয়ে নানাবিধ পরামর্শ সভা ও বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আমরা শুধু আমের বাণিজ্য সম্ভাবনা নিয়ে রাজশাহীতে কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটেরও আয়োজন করি। সেই আয়োজনেই কৃষক তুলে ধরেন আমের ‘ফ্রুট ফ্লাই’ সমস্যার কথা। ২০১৪-১৫ সাল থেকে টানা কয়েক বছর আম রপ্তানি কার্যক্রম চলেছে। কিন্তু তারপর আকস্মিকভাবেই থমকে যায় এ উদ্যোগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ সালে যেখানে ৭৮৮ টন আম রপ্তানি হয় সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে ২৮৮ টনে নেমে আসে এবং তারপর কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি পরিমাণে এসে পৌঁছে। আমের রপ্তানি বাণিজ্যে এ ভাটার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের গাফিলতি। যারা ওয়ালমার্টে প্রথম আম রপ্তানিতে অংশ নিয়েছিল তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। কৃষক ও রপ্তানিকারকদের মাঝখানে থাকা কিছু মানুষের অসততার কারণেই একটা সম্ভাবনা অঙ্কুরে মরে যায়। কৃষকরা জানান, তারা যে মানের আম দেন, সেই আমের সঙ্গে বাইরে থেকে কেনা আম মিশিয়ে কোয়ালিটি নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। এমনও হয়েছে তাদের কাছ থেকে আম না নিয়েই আম রপ্তানি সম্পন্ন করে ফেলেছে। ওয়ালমার্টের সঙ্গে চুক্তি ছিল লন্ডনের জামিল আহমেদের। তিনি এক বছর আগে থেকেই ওয়ালমার্টের ৭০০ টন আমের প্লেস বুকিং দিয়ে রাখেন। ওয়ালমার্টও চুক্তি অনুযায়ী সে সময় তাদের শপের প্লেস খালি রাখে এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালকে রেজিস্টার করে। শর্ত অনুযায়ী দ্বীপ ইন্টারন্যাশনাল আম পাঠানোও শুরু করে। ৪-৫ টন আম পাঠানোর পর দ্বীপ ইন্টারন্যাশনাল ওয়ালমার্টে আম পাঠাতে ব্যর্থ হয়। কারণ জানতে কথা বলি দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী পরিতোষ চন্দ্র দাস মানিক বাবুর সঙ্গে। তিনি জানান, হঠাৎ করে অন্য দেশের একটি এথনিক মার্কেটে রপ্তানি করা সবজিতে ফ্রুট ফ্লাই থাকার কথা বলে সরকারের কৃষিপণ্য রপ্তানির কোরাইন্টাইন বিভাগ দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালের কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ফলে তার পক্ষে আর ওয়ালমার্টে আম পাঠানো সম্ভব হয় না। প্রসঙ্গতই আমি কথা বলি ওয়ালমার্টের সঙ্গে চুক্তিকারী জামিল আহমেদের সঙ্গে। তিনিও জানান, ফলের মান নিয়ে ওয়ালমার্টের প্রশ্ন ছিল না। এফএও-এর প্রতিনিধি চিঠিতে লিখে দিয়েছিলেন- আমের উৎপাদন কমপ্লাইনস মেনে মানসম্পন্নভাবেই হয়েছে। এতে ওয়ালমার্ট সে বছরের জন্য আম নিতে রাজি হয়, কিন্তু পরের বছর অবশ্যই গ্যাপ সার্টিফিকেট লাগবে এ কথাও জানিয়ে দেয়। সবচেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় হঠাৎ করে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান দ্বীপ ইন্টারন্যাশনালের রপ্তানি করার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া। এর ফলে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন জামিল আহমেদ। পাশাপাশি বাংলাদেশের আম রপ্তানির বড় একটি সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক হোলসেল মার্কেটগুলোতে কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে চাইলে অবশ্যই গ্যাপ (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) সার্টিফাইড হতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো দেশে পণ্য পাঠাতে চাইলে উৎপাদন থেকে প্যাকেটজাতকরণে ইইউর কমপ্লাইনস মেনে করতে হবে। এ রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের উদাসীনতা, ইচ্ছার অভাবের কারণে গ্যাপ সার্টিফিকেট প্রাপ্তির বিষয়টি অনেক দিন ঝুলে ছিল। সে সময় হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ড. সালেহ আহমেদ। তিনি জানান, গ্যাপ সার্টিফিকেশনের জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একক প্রচেষ্টায় অন্যান্য দফতরের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। আশার কথা হচ্ছে এ বছর মালিক সিডস কোম্পানি আম উৎপাদন করেছে গ্লোবাল গ্যাপ সার্টিফিকেশনের আওতায়। বাংলাদেশের আম এখন থেকে বিদেশের বাজারে শুধু প্রবাসীদের জন্য নয় বিদেশিদের জন্যও গর্বের সঙ্গে রপ্তানি করা যাবে। গত ২৭ জুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক চ্যানেল আইয়ে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলে তাকে আমাদের কৃষকদের উৎপাদন করা নিরাপদ এই আম উপহার দিয়েছি। এতে বিদেশিদের কাছে বিষয়টি সুনামের সঙ্গে প্রচার হবে বলে আশা করি। সেই আম আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছি।

দেশে বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। সরকার প্রত্যাশা করছে এ বছর অন্তত ৪ হাজার টন আম রপ্তানি হবে। আমের রপ্তানি যাত্রায় নতুনমাত্রা যুক্ত হয়েছে। সবকিছুর পরও আম নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন বুনছে কৃষক। আমের রসের মিষ্টতা আমাদের কৃষি অর্থনীতিকেও মিষ্টি করে দেবে, বাইরের দেশে ‘বাংলাদেশের আম’ জয় করে নেবে নতুন পরিচয়। কৃষকদের সঙ্গে এ স্বপ্ন আমারও।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর