রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিল গেটস বললেন- ‘পৃথিবীর ভয়ংকরতম প্রাণী মশা’

সাইফুর রহমান

বিল গেটস বললেন- ‘পৃথিবীর ভয়ংকরতম প্রাণী মশা’

১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামা ভারতে যাওয়ার নৌপথ আবিষ্কারের পর নিজ দেশ পর্তুগালে তার দাপট ও গুরুত্ব অসম্ভব রকম বেড়ে গেল। ভাস্কো দা গামা ক্রমশ নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করলেন। যে কাজ কলম্বাস, আমেরিগো ভেসপুজি কিংবা মেগেল্যান করে দেখাতে পারেনি অথচ সে কাজই করে দেখিয়েছেন তিনি। আর এতে ভাস্কো ও পর্তুগালের রাজার মধ্যে শুরু হলো মনস্তাত্ত্বিক রেষারেষি। ১৫১৭ সাল নাগাদ পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েলের সঙ্গে ভাস্কোর মতানৈক্য পৌঁছাল চরমে। এর জন্য ভাস্কোর উচ্চাকাক্সক্ষা ও লোভ যেমন দায়ী ম্যানুয়েলের অনুদার মানসিকতাও ঠিক তেমনই দায়ী। ১৫১৮ সালে ভাস্কো রাজার কাছে আবেদন করলেন পর্তুগাল ছেড়ে তিনি চলে যেতে চান অন্য কোনো দেশে। ভাস্কোর ওপর রাজা চটে আছেন ঠিকই কিন্তু তারপরও তিনি চান না ভাস্কো দেশত্যাগী হয়ে চলে যাক অন্যত্র। কারণ ইতোমধ্যেই বড় বড় দুটো ভুল হয়ে গেছে। কলম্বাস পর্তুগাল রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়ে চলে গিয়েছিলেন স্পেনে। ফলে নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছিল পর্তুগাল। এর জন্য দায়ী ছিলেন রাজা দ্বিতীয় জন। ম্যাগিলানকেও ঠিক একই কারণে যেতে হলো স্পেনের রাজসভায়। এক্ষেত্রে অবশ্য দায়ী রাজা ম্যানুয়েল। রাজা চান না এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটুক। ১৫২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৯ দিন রোগশয্যায় ভুগে মারা গেলেন ম্যানুয়েল। সিংহাসনে বসলেন তার জ্যেষ্ঠপুত্র তৃতীয় জন। তার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। বয়সে নবীন হলেও তৃতীয় জন ছিলেন বিচক্ষণ ও দূরদর্শীসম্পন্ন রাজা। তিনি তার রাজপ্রাসাদের টানা বারান্দার সূচনাপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকেন টেগাস নদীতে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি বিদেশি জাহাজগুলোর দিকে। অজানা এক সুখানুভূতিতে প্রসন্ন হয়ে উঠে তার হৃদয়। একসময় ইতালির ভেনিস কিংবা জেনোয়া ছিল পৃথিবীর নৌ-বাণিজ্যের রাজধানী অথচ কালের বিবর্তনে এখন বিশ্ববাণিজ্যের নতুন সম্রাজ্ঞী লিসবন।

নদীতে ভাসমান জাহাজগুলোর কোনোটা এসেছে ভারতবর্ষ থেকে, কোনোটা আফ্রিকা, কোনোটা বা ভূমধ্যসাগরীয় কোনো বন্দর থেকে; উত্তর ইউরোপের উপকূল ছুঁয়ে এসেছে কেউ। এশিয়া আর আফ্রিকার পণ্য ঢালাও বিক্রি হচ্ছে নগরের বাজারে। সুদূর আফগানিস্তান থেকে এসেছে সুগন্ধ কস্তুরি, সিন্ধু আর কাশ্মীর থেকে সূক্ষ্ম বুনুনির শাল, গুজরাটের কবিরাজি ওষুধ, নীল, রেশম, সোনা আর বহুমূল্য পাথর। গোলমরিচ, আদা, আর সব রকম মসলা স্তূপীকৃত, বিক্রির জন্য রাখা থাকে লিবসনের বাজারে। উৎকৃষ্ট সেগুনকাঠ আসে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে। ক্যালিকোর বিখ্যাত সুতিবস্ত্র আর ভারতীয় জরি-কিংখাব দারুণ উৎসাহে বিক্রি করে দোকানিরা। বিক্রি করে বাংলার অদ্বিতীয় মসলিন। অলংকার আর মূল্যবান পাথরের চল আছে বেশ। বাগদাদ আর কায়রোর নিপুণ বুনুনির কাপড়, পারস্যের মহার্ঘ গালিচা, আরবের ধুনো-গুগগুল আর মস্তগি কিম্বা সেজুইয়ার ধাতু-শিল্পের নিদর্শন, সবই এখানে কেনাবেচা হয়। মালাক্কার লবঙ্গ, জায়ফল, জয়ত্রী, তিমুরের চন্দনকাঠ, চীন দেশের হাতির দাঁতের শিল্প, রেশম আর চিনামাটির সম্ভার ছেয়ে ফেলেছিল পর্তুগালের অভিজাত রাজপুরুষদের বাড়িঘর।

রাজা জন সিদ্ধান্ত নিলেন পর্তুগালের শৌর্যবীর্য আরও বৃদ্ধি করতে ভাস্কোকে আবার পাঠাবেন ভারতে। ভাস্কো নিজেও বুঝতে পারলেন তার গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে রাজদরবারে। মওকা বুঝে তিনিও গো ধরলেন, তিনি যেতে রাজি আছেন বটে তবে তাকে পাঠাতে হবে ভাইসরয় করে। ভাস্কোর আগে শুধু মেনেজেস নামের এক নাবিককেই ভাইসরয় করে পাঠানো হয়েছিল ভারতে। রাজা জন সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কোর প্রস্তাবে রাজি হলেন। ১৫২৪ সালের ৯ এপ্রিল ১৪টি জাহাজের বিশাল নৌবহর নিয়ে ভাস্কো যাত্রা করলেন ভারতের উদ্দেশে। এবার তিনি সঙ্গে নিয়েছেন দুই পুত্র ডম এসতেভাও ও ডম পাওলোকে। যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে ফুর্তি করার জন্য জাহাজে মেয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন ভাস্কো। চরিত্রের খাতিরে নয় বরং কঠিন অভিযানের প্রয়োজনীয় শৃঙ্খলার খাতিরে। তবুও মোজাম্বিকে এসে তিনটি মেয়ে ধরা পড়ল। জাহাজের খোলের মধ্যে লুকিয়ে তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। যদিও ভাস্কোর এটা তৃতীয় সফর কিন্তু তার মনে পড়ে গেল প্রথম সফরের কথা। পৃথিবীর কেউ জানুক বা না জানুক তিনি তো জানেন, ভারত আবিষ্কার কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি না মুর নাবিক ইবনে মজিদ তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসতেন। সেই প্রথমবার ১৪৯৮ সালে যখন তিনি নানা ঘাটের পানি খেয়ে আফ্রিকার মোজাম্বিকে এসে পৌঁছলেন তখন দেখতে পেলেন আরব বণিকরা নৌপথে রীতিমতো ব্যবসা-বাণিজ্য করছে ভারতের সঙ্গে। ভাস্কো এও জানলেন, মলিন্দির সুলতানের সঙ্গে ‘সমুদ্রের সিংহ’ নামে খ্যাত ইবনে মজিদের রয়েছে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। চট করেই ভাস্কোর মাথায় একটি দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি মলিন্দির সুলতানকে জিম্মি করে জাহাজে তুলে নিলেন ইবনে মজিদকে। অবশেষে মজিদই তাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্নের সেই ভারতবর্ষে। কিন্তু ইতিহাসে ইবনে মজিদের পরিবর্তে লেখা হলো তার নাম। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ভাস্কো এসে পৌঁছলেন ভারতে। জাহাজ বন্দরে ভিড়লে নাবিকরা শহরে নেমে উচ্ছৃঙ্খলতার চূড়ান্ত করে। নাবিকরা জোর করে মেয়েদের ধরে নিয়ে যৌন অত্যাচার করে। কলম্বাস সিফিলিস নামক যে ভয়ানক রোগটি আমদানি করেছেন আমেরিকা থেকে সে রোগটিই পর্তুগিজ নাবিকদের কল্যাণে ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে। ভাস্কো চান না এর অধিকতর বিস্তার। সে জন্য ভাস্কো নাবিকদের জাহাজ থেকে নামা বন্ধ করলেন। তাদের রেশন জাহাজেই পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ভারতে পৌঁছানোর মাত্র তিন মাসের মাথায় হঠাৎ আচানক মশার কামড়ে ভূপাতিত হয়ে শয্যা নিলেন ভাস্কো। সেই শয্যা থেকে তার পক্ষে উঠে দাঁড়ানো আর সম্ভব হলো না। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যালেরিয়ায়। অবশেষে ১৫২৪ সালের ডিসেম্বর, খ্রিস্টমাসের ঠিক আগের দিন ইহলোক ছেড়ে ভাস্কো চলে গেলেন পরলোকে। ভাস্কো দা গামাই শুধু নয় পৃথিবীর তাবড় তাবড় খ্যাতমান সব ব্যক্তি, রাজা-মহারাজা কিংবা ধনকুবের এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির কামড়ে ঢলে পড়েছেন মৃত্যুমুখে। সেই তালিকায় যেমন আছেন আরেক বিশ্ববিখ্যাত নাবিক আমেরিগো ভেসপুজি যার নামে নামকরণ করা হয়েছে আমেরিকা। বিখ্যাত কবি বায়রন, দান্তে, লেখক ম্যাস্ক মুলার, ডেভিড লিভিংস্টোন, রোমান সম্রাট পঞ্চম হেনরি ও তৃতীয় অটোসহ আরও অনেকে।

পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী হলো মশা, এটা আমার কথা নয়। এটা বিশ্ববিখ্যাত ধনকুবের বিল গেটসের কথা। যারা জানেন বিল গেটস শুধু একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তাদের এই জানাটা অবধারিতভাবে ভুল। কারণ বিল গেটস একাধারে গবেষক ও লেখকও বটে। তিনি ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল ‘মশা সপ্তাহ’ উপলক্ষে নিজস্ব ব্লগে ‘পৃথিবীর ভয়ংকর প্রাণী’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে দেখা যায় মশাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক প্রাণী। কারণ এর কামড়ে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে মারা যায় প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার মানুষ। বিল গেটস প্রণীত ভয়ংকর প্রাণীর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মানুষ। মানুষের হাতে প্রতি বছর খুন হয় প্রায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ। অথচ তার দেওয়া ভয়ংকর প্রাণীর তালিকায় ১৫ নম্বরে আছে হাঙর, ১৪ নম্বরে নেকড়ে, ১৩ নম্বরে সিংহ আর তৃতীয় ভয়ংকর প্রাণী হচ্ছে সাপ।

গ্রিক-লোককথা ‘হাতি ও মশা’ গল্পে দেখা যায় ছোট একটি মশা হাতির শুঁড় দিয়ে মগজে ঢুকে তাকে কামড়ে পাগল করে তুলেছিল। শরীরবিদ্যা না জানা ব্যক্তিদের পক্ষে এমন কথা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয় যে, নাক দিয়ে ঢুকে মগজে যাওয়া যায়। কিন্তু এ ধরনের গল্পগুলো মূলত মশার সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে মানুষের অসহায়ত্বকেই তুলে ধরে। মশার রক্তলোলুপ ক্ষমতার বিপরীতে অসহায় মানুষ এমন গল্পের সৃষ্টি করে সান্ত্বনা পেতে পারে বৈকি, কিন্তু তাতে বাস্তব অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।

আসল কথা হচ্ছে ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির কাছে আমরা সত্যি অসহায়। কিন্তু আমাদের এই অসহায়ত্বগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অসাধুতার কারণে। ঠিক এরকমই একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে এ বছরেরই ১৩ মার্চ। ‘বাংলানিউজ২৪’ লিখেছে, ‘মশা মারতে সিটি করপোরেশনের মশকারি’। এ কথা বলাই বাহুল্য, এ বছরের মতো মশার উপদ্রব নিকট অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। মশার যন্ত্রণায় রাজধানীর কোথাও দু’দণ্ড বসে থাকাই যেন দুষ্কর। এমন কোনো বাসা, অফিস বা উন্মুক্ত স্থান নেই যেখানে মশার ভ্যান-ভ্যানানি নেই। বলতে গেলে বলতে হয় মশায় মশায় ছেয়ে গেছে সমস্ত নগরী।

আমার ধারণা পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত সুর হচ্ছে মশার এই গুঞ্জন। আমাদের মনস্তত্ত্ব¡টাই এমন যে রাতের অন্ধকারে মশা যদিও বা না কামড়ায় শুধু কানের কাছে এসে পুঁ...পুঁ...পুঁ... শব্দ করে তারপরও মনের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করে। রাতের ঘুম একেবারে হারাম। মশার এই গুঞ্জন কিন্তু মশার ডানা ঝাপটানোর শব্দ। একটি মশা সেকেন্ডে প্রায় ৩০০ থেকে ৬০০ বার ডানা ঝাপটাতে পারে আর অতি অল্প সময়ে এতবার ডানা ঝাপটানোর দরুনই আমরা গুনগুন শব্দ শুনতে পাই।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে জানা যায় এ মৌসুমে যেসব মশা দেখা যাচ্ছে তার ৯৯ শতাংশই নাকি কিউলেক্স মশা। এ মশায় আসলে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। ১ শতাংশ আছে এডিস মশা, এই মশায় কামড়ালেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন থেকে যে ওষুধ ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ থাকে সেগুলোর প্রায় সবই বাইরে বিক্রি হয়ে যায়, আর যেটুকু ওষুধ স্প্রে করা হয় তার সিংহভাগই ভেজাল।

মশার এই উপদ্রবকে তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখা হয় বলেই এর কোনো সুরাহা হয় না। কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে মশা নিধনের নামে। অথচ এই মশার কামড়ে সংক্রামিত হয় চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ফাইলেরিয়া, পীতজ্বর, জিকা ভাইরাসের মতো ভয়াবহ সব রোগ। বিগত দুই-তিন দশকে বেশ কিছু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে ডেঙ্গু রোগে। বহু লোককে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে চিকুনগুনিয়ার কারণে। দু-তিনশ বছর আগে লাখ লাখ মানুষ মারা পড়েছে ম্যালেরিয়ায়। ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধক কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মশার কামড়ে যে কত লোকের প্রাণনাশ হয়েছে তার কোনো লিখাজোখা নেই। তবে শুধু এই উপমহাদেশে ইংরেজ আমলের এক বছরের হিসাবে দেখা যায় সে বছর মোট ১৩ লাখ মানুষ মারা গিয়েছে ছোট এই প্রাণীটির আক্রমণে।

আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায় বহু সমৃদ্ধ জনপদ এই রোগে একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলার পল্লীকে একদিন শ্মশান করেছে এই জ্বর। কী এই জ্বরের নাম, কেনই বা এই জ্বর হয়-কেউ তা জানত না। তবে মানুষ লক্ষ্য করল, ভ্যাপসা জলার আশপাশে এই রোগের প্রকোপ খুব বেশি। তাই তারা মনে করল, দূষিত (সধষ) বায়ুর (ধরৎ) জন্যই এই জ্বর হয়। একজন ইতালিয়ান সে জন্য এই জ্বরের নাম দিলেন-সধষ ধরৎ; তার কাছ থেকেই আমরা ‘ম্যালেরিয়া’ নামটি পেলাম। এই জ্বরের ওষুধও পাওয়া গেল আকস্মিকভাবে। পেরু দেশের লিমা শহরের কয়েকজন লোক দেখল, কোনো জায়গার পানি খাওয়ালে এই জ্বর আস্তে আস্তে কমে আসে। কী আছে এই পানিতে, যার জন্য পানির আস্বাদটাও হয় তেতো এবং এই পানিতে জ্বর সারে? তারা দেখল, ‘কিনা’ (Quina) বলে একরকম গাছের ডালপালা পড়েছিল সেখানকার জলাশয়ে। স্পেন দেশের ভাইসরয়ের স্ত্রীর নাম ছিল-কাউন্টেস অব সিনকন তিনি তখন বাস করতেন লিমায়। তাঁর একবার জ্বর হলো। স্থানীয় চিকিৎসকরা ওই গাছের ছাল সিদ্ধ করে তাঁকে খাওয়ালেন। জ্বর সেরে গেল। তখনকার উদ্ভিদতত্ত্ববিদ লিনিয়াস সাহেব সিনকনের গৌরবে এই গাছের নাম দেন-সিনকোনা। এটা প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগের কথা।

সে যা হোক মশার এই আক্রমণ ও নির্বিচার অত্যাচারগুলো কবি-সাহিত্যিকদের জীবনেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, ফলে তাদের রচিত সাহিত্যেও উঠে এসেছে ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির ক্রিয়াকলাপ। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তিন বছর বয়সে মামার বাড়িতে এসেছেন কলকাতায়। এসেই মশার কামড়ে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নিলেন। কলকাতায় তখন মশা-মাছির প্রবল উপদ্রব। তা দেখেই বালক ঈশ্বর লিখে ফেলেছিলেন একটি ছড়া যা পরবর্তীতে বিখ্যাত ছড়া হিসেবে নাম করেছিল রাতে মশা দিনে মাছি/এই নিয়ে কলকাতায় আছি। কলকাতা যে কী প্রকার মশা অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল সেটা পশ্চিমবঙ্গের অনেক লেখকের লেখা থেকেই বোঝা যায়। বিশেষ করে সাহিত্যিক শিবনারায়ণ রায় ‘পঞ্চাশের দশকে পাইকপাড়ায় আড্ডা’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, একবার তিনি তার বন্ধু প্রখ্যাত সাহিত্যিক গৌরী কিশোর ঘোষের বাড়িতে বেড়াতে যান। তিনি লিখেছেন, গৌরীর বাবা, মেসোমশাই একটা তক্তপোশের ওপরে মশারি টাঙিয়ে যোগাসনে বসে আছেন। মশারির চারপাশ এবং ছাদ ঘিরে ঝাঁক-ঝাঁক দুর্ধর্ষ মশা দুর্গ নিপাতনে ব্যাপৃত। মেসোমশাই বললেন, চট করে মশারির ভিতরে চলে এস শিবু, কিছু জরুরি কথা আছে। দেখ শিবু মশা ব্যাপারটা কিছুই নয়, চিত্ত যদি নির্বিকল্প থাকে তবে মশা তো মশা, মুখ্যমন্ত্রীরও সাধ্য নেই তোমাকে কুপোকাত করতে পারে। প্রবোদকুমার স্যানাল তার আত্মজীবনী ‘ধনস্পতির বৈঠকে’র বহু জায়গায় মশার উপদ্রবের কথা তুলে ধরেছেন অসাধারণ দৃষ্টিতে। বিখ্যাত ‘পথে প্রবাসে’ গ্রন্থের লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন-দেশান্তরী করল আমার কেশনগরের মশায়। জীবনানন্দ দাশ তার ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় লিখেছেন-চারদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;/মশা তার অন্ধকারে সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোতে ভালোবাসে। এক সময় কলকাতার আশপাশের অঞ্চলগুলোতেও মশার উপদ্রব ছিল বেশি। শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ একদিন হাতে-পায়ে তেল মাখাচ্ছিলেন। জনৈক এক আগন্তুক কবিগুরুর দিকে তাকিয়ে আছেন বড় বড় চোখ করে। কবিগুরু তখন মজা করে বললেন- ভেব না যে আমি বুড়ো মানুষ বাত হয়েছে বলে পায়ে তেল মালিশ করছি। এ হলো মশার ভয়ে, শান্তিনিকেতনের মশারা ভারি নম্র। তারা সারাক্ষণই পদসেবায় ব্যস্ত থাকে।

বাংলাদেশের সেসব ভ্রমণপিপাসু অভিযাত্রী কলকাতাতে যাতায়াত করেন তারা অবশ্যই দেখে থাকবেন যে ওখানে এখন আর মশার উপদ্রব নেই সেটা শুধু সম্ভব হয়েছে তাদের একান্ত সদিচ্ছার কারণে। বাংলাদেশে আগেও মশা ছিল এখন মশা বরঞ্চ আরও বহাল তবিয়তে ও ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করেছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে এখন থেকে এক শ বছর আগের পুরানা পল্টন এলাকায় মশার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-সন্ধে নামতেই মশারা এমন বিস্তীর্ণভাবে দখল করে নেয় শহরটিকে, তারা গর্জনে এত প্রবল আর দংশনে এত তীক্ষè ও অপ্রতিহত যে, ন-টার মধ্যে আহারাদি সেরে মশারির তলায় পলায়ন ছাড়া নিরীহ ভদ্রলোকের আর কোনো উপায় থাকে না।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর