মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

আশুরা ও কারবালা

এম এ মান্নান

আশুরা ও কারবালা

ইসলামী ধর্মতত্ত্বে ১০ মহররম বা আশুরার গুরুত্ব অপরিসীম।  আশুরায় অসংখ্য নবী-রসুলের আমলে ঘটেছে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আশুরার গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে ১০ মহররম রসুল (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)সহ নবী পরিবারের সদস্য-সঙ্গী মিলে ৭২ জনের শাহাদাতবরণের ঘটনায়। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার। রসুল (সা.)-এর নাতি হিসেবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি সব মুমিনের অফুরন্ত ভালোবাসা রয়েছে। কোরআন -হাদিসে আহলে বায়েত ও ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বিশেষ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ ইমানের পরিচায়ক হিসেবেও নির্ধারিত হয়েছে। আহলে বায়েতের ফজিলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের পূর্ণরূপে পূতপবিত্র রাখতে।’ সুরা আহজাব, আয়াত ৩৩। সুরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াতেও আহলে বায়েতের বিশেষ মর্যাদার আভাস দেওয়া হয়েছে। হজরত জাবির (রা.) বলেন, ‘আমি আরাফার দিবসে রসুলুল্লাহকে তাঁর কাসওয়া নামক উটের ওপর বসে খুতবা দিতে শুনেছি। তিনি বলেন, হে মানবসকল! আমি তোমাদের কাছে যা রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা এগুলো আঁকড়ে ধরো বা প্রতিপালন করো তাহলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার মধ্যে এক হলো আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এবং অন্যটি আমার আহলে বায়েত। তিনি আরও বলেছেন, হোসাইন আমার থেকে আর আমি হোসাইন থেকে।’ ইবনে মাজাহ

রসুল (সা.) তাঁর প্রিয় নাতি হজরত হাসান (রা.)-কে ভালোবাসতেন নয়নের টুকরা হিসেবে। আল্লাহর রসুল দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তাকে ভালোবাসি, অতএব তুমিও তাকে ভালোবাসো এবং যারা তাকে ভালোবাসে তাদের ভালোবাসো।’ বুখারি। আহলে বায়েতের প্রতি ভালোবাসার দ্বারা যে রসুল (সা.)-এর ভালোবাসা অর্জন করা যায় সে বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। তিরমিজি। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহকে ভালোবাসো তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া হিসেবে, আমাকে ভালোবাসো আল্লাহর ভালোবাসার জন্য এবং আমার পরিবারকে ভালোবাসো আমার ভালোবাসার জন্য।’ ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইমাম হোসাইন (রা.) তার হাতে বায়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। ইয়াজিদ ছিল দুশ্চরিত্র, বেনামাজি ও মদ্যপায়ী। হজরত হাসান ও মুয়াবিয়ার (রা.) ইন্তেকালের পর খিলাফতের ন্যায়সংগত দাবিদার ছিলেন হোসাইন (রা.)। নীতিজ্ঞানহীন ইন্দ্রিয়পরায়ণ ইয়াজিদের কাছে জীবনের বিনিময়েও হজরত হোসাইন (রা.) মস্তক অবনত করতে রাজি ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করলে ইসলামের গুরুত্ব ক্ষুণ্ণ হতে পারে। তার দেখাদেখি অন্য অনুসারীরাও ইয়াজিদের কাছ থেকে বায়াত নেবেন। ইমাম হোসাইন (রা.) অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসীন ইয়াজিদের বায়াত না নিয়ে বাতিলের সামনে মাথা নত না করার অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছেন। ঘটনা-প্রবাহের সেই সময় কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে চিঠির মাধ্যমে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। ইয়াজিদ শাসনের মোকাবিলায় তার হাতে বায়াতের অঙ্গীকার করে বিপুলসংখ্যক চিঠি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কাছে পাঠানো হয়। তারা ইমাম হোসাইন (রা.)-কে খিলাফতের অধিক যোগ্য, তার জন্য জানমাল কোরবানির জন্য প্রস্তুত এবং আহলে বায়েতের অনুরক্ত এমন পয়গাম পাঠায়। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য হোসাইন (রা.) আপন চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠান। কুফার গভর্নর নুমান বিন বশিরসহ ৪০ হাজার মানুষ মুসলিমের হাতে হোসাইন (রা.)-এর নামে বায়াত নেন। পরিস্থিতি হোসাইন (রা.)-এর অনুকূলে এমন বর্ণনা দিয়ে একজন পত্রবাহককে চিঠি দিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কুফায় আসতে অনুরোধ করা হয়।

৬০ হিজরির ৮ জিলহজ হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা দেন। পথে হোসাইন (রা)-এর চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাফর সাক্ষাৎ করে মদিনার গভর্নর কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা সনদের ভিত্তিতে মদিনায় ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘আমি স্বপ্নে নানাজির সাক্ষাৎ পেয়েছি। তিনি আমাকে একটি কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলাফল যা-ই হোক না কেন, আমি অবশ্যই তা করব আর কাজটি কী, সে সম্পর্কে মৃত্যুর আগে আমি কাউকে কিছু বলতে পারি না।’ ‘জি জাশাম’ নামক স্থানে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের পক্ষ থেকে হুর ইবনে ইয়াজিদ ইমাম হোসাইনের পথ রোধ করে এবং ইমাম কাফেলার সামনে ছাউনি ফেলে। হুর ইবনে ইয়াজিদ ইমাম হোসাইন (রা)-কে তাদের সঙ্গে যেতে বাধ্য করে। ইমাম হোসাইন (রা.) তাদের সঙ্গে চললেন। ৬১ হিজরির ৯ মহররম বৃহস্পতিবার দিন ইমাম হোসাইন (রা.) তার সঙ্গীসহ কারবালা প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। কারবালায় অবস্থানের দ্বিতীয় দিনে আমর ইবনে সাদ ৪ হাজার সৈন্য নিয়ে ইবনে জিয়াদের পক্ষ থেকে কারবালায় পৌঁছে। ইয়াজিদ বাহিনীর পক্ষ থেকে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১০ মহররম ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীবর্গ নিয়ে জালিমদের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হন এবং একে একে হোসাইন (রা.)সহ ৭২ জনের সবাই শাহাদাতবরণ করেন। পরিবারের নারী -শিশুসহ বাকি ১২৮ সদস্য বন্দি হন। ১০ মহররম কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করে যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইমানদারদের জন্য অনুসরণীয়।

লেখক :  সভাপতি, আমেনা খাতুন, হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট, পাঁচগাতিয়া কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর