বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

দাদাভাইয়ের সঙ্গে একান্ত আলাপ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

দাদাভাইয়ের সঙ্গে একান্ত আলাপ

১৯৯১-এর মে মাসের প্রথম সপ্তাহান্ত। আমি বিশ্বব্যাংকের এক কর্মশালায় যোগ দিতে তখন ওয়াশিংটনে। আমাদের এক বন্ধু বিকালে জানালেন, ‘দাদাভাই আজ রাতে আসবেন আমার বাসায়।’ জানতাম দাদাভাই ওরফে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আমাদের এই বন্ধুর জানাশোনা অনেক দিনের। আমি দাদাভাইকে তখনো দেখিনি, তবে নাম শুনেছি। ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর রহস্যময় অবগাহন সম্পর্কে আমার কৌতূহল ছিল। তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। সেই সন্ধ্যায় আমরা তিনজন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও রাজনৈতিক অর্থনীতির পুনর্বাসন পুনর্গঠন পর্বে তাঁর ভূমিকা, পরবর্তী দুই দশকে উন্নয়ন ও আর্থ প্রশাসনিক সংস্কার সম্পর্কে এমন সব পুষ্টিকর বিষয়-আশয় নিয়ে আলোচনায় মেতে ছিলাম যে, কখন ভোর হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। মনোজগতের অনেক অব্যক্ত অব্যাখ্যাত প্রসঙ্গ  ক্রমে বেরিয়ে আসছিল তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বাক্যালাপের বিজ্ঞ আলোচনায়। ওস্তাদ তানসেনের মতো সিরাজুল আলম খান আমাদের সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও তখনো তিনি নিউক্লিয়াস ভাবভাবনায় এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে, সিভিল সার্ভিসে এক দশক পার করা সাগরেদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তাঁর বিচার-বিবেচনা ফল্গুধারার মতো প্রকাশ পাচ্ছিল। সেই সুধাপানে এতটাই বুঁদ হয়েছিলাম যে বন্ধুর বাসার ওপরের ফ্ল্যাটে আমাদের সার্ভিসের এক সিনিয়র কলিগের বাসায় আমার সেই রাতের দাওয়াতে যাওয়ার কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।

ঠিক সন্ধ্যার পরই তিনি এসেছিলেন। নিম্নপ্রাথমিকে পাঠরত বন্ধুপুত্রের জন্য এনেছিলেন চমকপ্রদ শিক্ষা উপকরণ, চকলেট ইত্যাদি। সংসারত্যাগী সিরাজুল আলম খানের শিশু-কিশোর প্রীতি এবং তাকে তিনি যেভাবে আদর-উপদেশ দিচ্ছিলেন দেখে মনে হচ্ছিল রহস্যময় এই আপাতকঠিন মানুষটির মধ্যেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি প্রগাঢ় মমত্ব ও দায়িত্ববোধ বিদ্যমান। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনে মাহমুদুর রহমান মান্নার স্মৃতিচারণা ভাবী নেতৃত্বের প্রতি সিরাজুল আলম খানের সাংগঠনিকভাবে আত্মশক্তি বিকাশের পরামর্শ প্রদানের পারঙ্গমতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। সে রাতে আমাদেরও আলোচনার মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশের আত্মশক্তি বিকাশের ভাবনা। সে রাতের আলোচনার ৩২ বছরের মাথায় তাঁর সদ্যপ্রয়াণকালের আগে তিনি দেখে গেছেন বাংলাদেশ ভূরাজনীতির কী প্যাঁচে পড়েছে। এখন মনে হচ্ছে কেন তিনি আমাদের আত্মশক্তি অর্জনের অনিবার্যতা এত বেশি অনুভব করতেন। ষাটের দশকে ছয় দফা আন্দোলনের সময় নিজেদের মধ্যে মতানৈক্যের সূচনা তিনি যেভাবে লক্ষ করেছিলেন, সেখান থেকেই তিনি শুরু করেছিলেন ঐকমত্যের সাধনা। ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পন্থা অবলম্বন করে শুধু তাদের ভারত ত্যাগের দিনক্ষণ পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়নি, তারা এদেশীয়দের মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজমন্ত্র বপন করে গিয়েছিল বৃহৎ ঐক্যবদ্ধ ভারত প্রতিষ্ঠার কাক্সিক্ষত স্বপ্ন চুরমার করার জন্য। সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস তত্ত্বের মর্মবাণী হলো- সকল সংগ্রামে সকল সংস্কার আন্দোলন ও আবেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশের মধ্যে থাকা চাই, ঘটা চাই সমন্বয়-সহমর্মিতা-সহমতের সম্মিলন। আন্দোলন-সংগ্রামে সবার অংশগ্রহণের স্বীকৃতির পরিবর্তে গোষ্ঠী দল পরিবার বা ব্যক্তির অদূরদর্শী একচ্ছত্রপতিত্ব প্রতিষ্ঠা পেলে সাফল্য স্বীকৃতি চিরজীবী হয় না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রচনার প্রেক্ষাপট, ২৫ মার্চের রাতে বঙ্গবন্ধুর বন্দিত্ববরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ই আন্তনেতৃত্বের বেসুরো গানের স্বরলিপি সংরচন এসব বিষয়ে সিরাজুল আলম খান সে রাতে সরাসরি না হলেও তাঁর চিরাচরিত রহস্যময়ী কিছু মন্তব্য রেখেছিলেন। সরকারি চাকরিজীবীদের রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেওয়া সিলেবাসে ছিল না বা নেই, তাই প্রসঙ্গান্তরে যেতে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ১৯৭২ সালেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া মোহাম্মদ তোয়াহাকে এম এ মোহাইমেন সাহেব এক সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন। তোয়াহা সাহেব ‘স্মৃতিকথা’য় লিখেছেন, শর্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সেখানে আর কেউ থাকতে পারবে না, অথচ সেই সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আপনাকে দেখে তোয়াহা সাহেব প্রশ্ন রেখেছিলনে- ‘তোমার তো এখানে থাকার কথা না। বিষয় কী?’ সে সময়কার প্রেক্ষাপটে অনেক ব্যাপারে তাঁকে পাতায় পাতায় সঙ্গ দিতে হয়েছিল। যখন তিনি বা তাঁরা দেখলেন আদর্শিক ব্যাপারে মতপার্থক্য বাড়ছে তখন তিনি বা তাঁরা জাসদের মাধ্যমে পাল্টা প্ল্যাটফরম গঠনে বাধ্য হন।

আবার ফিরে এলাম রাজনীতি বাদ দিয়ে সমকালীন আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রেক্ষাপটে তাঁর ভাবদর্শনের ভূত-ভবিষ্যতের কূলকিনারা অনুধাবনের চেষ্টায়। তাঁর অবলোকন ও অভিমত ছিল সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধের পর, পট পরিবর্তন ছিল মূলত তৃতীয় একটি ধারা উত্থান প্রচেষ্টা। এটি মূলত পক্ষ-বিপক্ষের শ্রেণি ও মেরুকরণের মধ্যে বা বিপরীতে দেশ গঠন ও উন্নয়ন অভিমুখী যাত্রার আমলাতান্ত্রিক প্রয়াস। রাজনীতি রাজনীতিকরা হাতে রাখতে পারলেন না। যে বঞ্চনা ও বণ্টন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার সংগ্রামে জয়ী জাতি সেই জাতির জাতীয়তাবোধে সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল মনোভাবের অনুপ্রবেশই শুধু ঘটল না, স্বল্প সময়ের মধ্যে একদলীয় ধারণা গেড়ে তো বসলই, বঞ্চনা-বৈষম্য সৃষ্টির মহোৎসব শুরু হয়ে গেল। সমাজতন্ত্র গলাধাক্কা খেল পুঁজিবাদের কাছে। উন্নয়নের মুলা ঝোলানো হলো ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ আমজনতার সামনে। বিদেশের ঋণ-অনুদান এলো কৃষিপ্রধান, নদনদীমাতৃক দেশে। জমি নষ্ট করে, খালবিলের পানি চলাচল বন্ধ করে, সস্তা আটপৌরে যাতায়াতের স্বনির্ভর পথঘাট পয়মল করে সড়ক পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে, জ্বালানি ও বিদ্যৎ খাতে অগস্ত্যযাত্রার বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির দুষ্টক্ষত হলো দগদগে ঘায়ে পরিণত। পুরো আশির দশকে উন্নয়ন সাহায্যদাতারা উন্নয়ন সহযোগীর ছদ্মাবরণে, এনজিওরা খাল কেটে আনল কুমির। সিরাজুল আলম খানের মতে, নব্বইয়ের গণ আন্দোলন আপাতত ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ বলে মনে হলেও সামনের দিনগুলোয় ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ বেসরকারি খাতের হাতে থাকবে কি না, রাজনীতি বা নীতিনির্র্ধারণ রাজনীতিকের হাতে থাকবে, না তা উঠতি বুর্জোয়া ব্যবসায়ী বা আমলাদের হাতে চলে যাবে সে ব্যাপারে সন্দিহান প্রকাশ করেছিলেন দাদাভাই। যে যায় লঙ্কায় সেই ইঙ্গিত করলেন- অপরিণামদর্শী রাজনীতিক, শাসক, প্রশাসক যে যখন যেভাবে পারে গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে বেসামাল হয়ে উঠতে পারে। তাঁর আশঙ্কা বর্ণচোরাদের বন্যায় ভেসে যাবে দেশ, পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজন বাড়বে আর নিজেরাই নিজেদের শত্রু বনে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন- এখন কিন্তু শোষণ-বঞ্চনার জন্য আর বিদেশিদের ওপর দোষারোপ চলবে না। নিজেদের কাটা গর্তে নিজেদের পড়ার আশঙ্কা বাড়বে বই কমবে না, যদি না একটা তীব্র দেশাত্মবোধের চেতনা উৎসারিত আত্মশক্তি বিকাশের আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। হাউস অব কমন্সে উইনস্টন চার্চিলের একটি উক্তি স্মরণ করলেন তিনি- When I am abroad, I always make it a rule never to criticize or attack the government of my country. I make up for lost time when I am at home. কিন্তু এ ব্যাপারে নষ্ট রাজনীতির দায়কে চার্চিল অস্বীকার করেননি, Politics are very much like war. We may even have to use poison gas at times. এমনকি বিভ্রান্ত রাজনীতির পরিণাম সম্পর্কে Politics are almost as exciting as war, and quite as dangerous...in war you can only be killed once. But in politics many times.

আবার ঘুরলাম, আমি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের উপযাচক হয়ে মাতব্বরি, কঠিন শর্তারোপ প্রসঙ্গে আমাদের আক্ষেপের কথা তুললাম। দাদাভাই বললেন, ‘তুমিও তাদের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জায়গায় গেলে এ আক্ষেপ তোমার আর থাকবে না’। তিনি রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে প্রচন্ড  বিভাজন, আন্তবঞ্চনা এবং দলীয়করণের ফলে ক্রমে ব্যাড মানি ড্রাইভ অ্যাওয়ে গুড মানি ফ্রম দ্য মার্কেট বা গ্রেসামস সিনড্রমের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছেন বলে আমাদের জানালেন। তিনি এসব কথা একান্তে প্রকাশ করতেন কিন্তু নিজে লিখে রেখে যাননি। আমরাও তাঁর সে রাতের আলোচনাকে কোথাও প্রকাশযোগ্য করে সংরক্ষণ করিনি। সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে তুলে আনা আজকের এ আলোচনার সূত্র ধরে দাদাভাইয়ের স্মৃতির প্রতি জানাই বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।

♦ লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান

 

 

সর্বশেষ খবর