শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

হিরো নুরু ও ভীরুর কথা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

হিরো নুরু ও ভীরুর কথা

কুমিল্লার ছাত্রজীবনে আমার তিনজন বন্ধু ছিল- কালীবাড়ির হিরো, রাজগঞ্জের নুরু এবং দিঘীরপাড়ের ভীরু। হিরো এবং নুরু প্রকৃত নাম হলেও ভীরু ছিল আরোপিত নাম বা টাইটেলের একটি অংশ। ‘ভীরু নেতা’ হিসেবে তাঁর পরিচিতি বেশি ছিল। নামের বদলে টাইটেলে ব্যাপক পরিচিতির নেপথ্য কারণ তাঁর স্বভাব ছিল সবকিছু শেষ হওয়ার পরে কোনো স্থানে উপস্থিত হওয়া এবং তিনি থাকলে কী করতেন তা শুনিয়ে নিজের বীরত্ব জাহির করা। বয়সোচিত ঝগড়াঝাটি, পাড়ায় পাড়ায় মারামারি বা কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে কোথাও যাওয়ার জন্য জোট বাঁধার ক্ষেত্রে কখনোই ভীরু নেতাকে সামনে পাওয়া যেত না। কিন্তু যখনই কোনো কিছু পরিপক্বতা লাভ করত অথবা আন্দোলন জমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত তখনই দৃশ্যপটে ভীরু নেতাকে দেখা যেত এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টায় তাঁর সংগ্রাম শুরু হতো। বাল্যবন্ধু হিরো, নুরু ও ভীরুর কথা আজ মনে পড়ল দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে।

বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এক ‘বিস্ময় বালক’ হিরো আলম। প্রকৃত নাম আশরাফুল আলম হলেও হিরো আলম নামটি আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়ে জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। একজন রাজনীতিবিদের বক্তব্য মতে, আর দু-একটা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারলে হয়তো নোবেলপ্রাপ্তদের তালিকায়ও তাকে দেখা যেতে পারে। অথচ তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্ণধার দূরের কথা, সাধারণ সদস্যও নন। তার কোনো রাজনৈতিক দর্শন বা মতাদর্শ নেই। নেই কোনো কার্যালয় বা প্রকাশনা। তারপরও তিনি একের পর এক নির্বাচন করে বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছেন। তিনি জয়লাভ না করলেও জয়ী প্রার্থীর চেয়ে তাকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। কারণ তিনি হিরো আলম। নাট্যজন মামুনুর রশীদ তাকে কেন্দ্র করে নির্মিত ডিজিটাল কন্টেন্টের প্রতি ইঙ্গিত করে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বলে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তবুও তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষায় গান, নাচ ও অভিনয় নামের কন্টেন্ট তৈরি করেন। আর লাখো কোটি দর্শক তা দেখেন, পছন্দ করেন, মন্তব্য করেন এবং অন্যের কাছে তা পৌঁছে দেন বা শেয়ার করেন।

দেশের রাজনীতির বর্তমান ধারায় হিরো আলমদের রাজনীতিতে আসাটাই স্বাভাবিক। বর্তমান ধারা অনুযায়ী আমরা সামনে অনেক কিছুই বলি কিন্তু বাস্তবে তা বিশ্বাস বা প্রয়োগ করি না। ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৫ জুলাই ঢাকায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা সম্মেলন করেন। সম্মেলনে শচীন দেব বর্মণের মতো ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’ মঞ্চে উপবিষ্ট শেখ হাসিনার প্রতি একচেটিয়া সমর্থনের অঙ্গীকার করেন। এমন ব্যবসায়ী ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা বড় অংশ ঢাকা-১৭ আসনে বাস করলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও দলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার বদলে যার যার ধান্দায় ব্যস্ত ছিলেন তারা। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই ভোট কেন্দ্রে যাননি। এই নির্বাচনে ৩ লাখ ২৫ হাজার ভোটারের মধ্যে ভোট প্রদান করেন মাত্র শতকরা ১১ ভাগ ভোটার। এই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাংক মো. এ আরাফাত ২৮ হাজার ৮১৬ (প্রায় ৯ শতাংশ) ভোট লাভ করেন আর দ্বিতীয় স্থানে থাকা হিরো আলম পান ৫ হাজার ৬০৯ ভোট (২ শতাংশের কম)। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের শেষ ভাগে এসে হঠাৎ করেই হিরো আলমকে মারধর করে এক দল যুবক। এ সময় ইউটিউবারদের কল্যাণে গোটা জাতি হিরো আলমকে দৌড়াতে দেখে। একসময় ঢাকার উপকণ্ঠে ওয়াসার পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্যকে জনতা ধাওয়া করে এবং সেই সংসদ সদস্য তখন প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দেন। আজও তাঁর নামের আগে ‘দৌড়’ খেতাব জুড়ে দেন তাঁর প্রতিপক্ষ ও রসিকজনরা। তবে হিরো আলম এমন খেতাব পাননি। বরং অনেকের বর্ণনায় এ যেন হিরো আলম নয়, তারা দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থাকে দৌড়াতে দেখেছেন। আর দেখেছেন নেতাদের ওপর দলের ও কর্মীদের ওপর নেতাদের নিয়ন্ত্রণহীনতা। তাই শত মানুষের মনে শিল্পী আবদুল আলীমের হলুদিয়া পাখি শিরোনামের গানের একটি লাইনের আদলে জিজ্ঞাসা ‘হিরোকে মারিলো কে?’ যদি সরকারি দল মেরে থাকে, তাহলে প্রশ্ন আসে- ‘কেন’? যদি বিরোধীরা মেরে থাকে, তবে প্রশ্ন পুলিশ কীভাবে বিরোধীদের দিয়ে মার খাওয়ানোর জন্য তাকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়? যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিউ বাড়ানোর জন্য হিরো আলম গং নিজেরাই এমনটি ঘটিয়ে থাকেন তাহলে প্রশ্ন গোয়েন্দারা চুপ কেন? আর এটা যদি দেশের রাজনীতি কলুষিত- এটাই প্রমাণের মাধ্যমে বিরাজনীতিকরণের চক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন কে বা কারা এই কুশীলব?

বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে হঠাৎ আলো ছড়ানো একটি নাম ‘নূর’- যার অর্থ আলো। সম্পূর্ণ নাম নুরুল হক নূর। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের গন্ডি পেরিয়ে কাতার, দুবাই ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে নূরের আলোর উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা গেছে। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র একে একে কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের হারিয়ে ভিপি নির্বাচিত হওয়া এবং পরবর্তীতে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামের রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম তৈরি করে দ্রুতই আলোচনায় আসেন। তবে বর্তমানে নাট্যজন ও নির্মাতা আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সখি তুমি কার?’ সিনেমার আদলে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- ‘নূর তুমি কার?’ তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল বিশেষত বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতের আনা অন্যতম অভিযোগ, তিনি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাতার, দুবাই ও ভারতে মিটিং করেছেন। এসব মিটিংয়ের সত্যতা যাচাইয়ের পক্ষে-বিপক্ষে একাধিক ভিডিও এখন নেটজগতে ভাসমান। এমনকি একজনকে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গোয়েন্দা মেন্দি এন সাফাদি সাজিয়ে কিংবা প্রকৃত সাফাদিকে দিয়ে শুটিং করার দৃশ্য ভাসছে নেটে। পরবর্তীতে তিনি বিদেশে সম্পদ করেছেন বলেও অভিযোগ ওঠে। ঠিকাদারের পক্ষে তদবির করার প্রশ্ন উঠেছিল বেশ আগে। আবার অতি সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ কুকিচীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, যা বর্তমানে গোয়েন্দারা তদন্ত করছেন। কেউ ভাবছেন তিনি দেশে স্থিতিশীলতা বিনষ্টে বিদেশিদের হয়ে কিংবা সরকারবিরোধী দেশীয় শক্তির ইশারায় কাজ করছেন। আবার কারও দৃষ্টিতে মূলত সরকারের লেখা চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে অভিনয় করছেন নূর। কারণ সরকারবিরোধী মূল রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না এলে নূরকে যথাসময়ে যথাস্থানে নামানো হবে।

রাজনৈতিক নিবন্ধন না দেওয়ায় এমন সম্ভাবনাকে গুজব বলে ভাবছেন কেউ কেউ। অতীতে রাজনীতির মাঠে ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি ইত্যাদি শব্দগুলো প্রায়ই উচ্চারিত হতো। এ তালিকায় নতুন সংযোজন ভাড়াখেলাপি। নূরের দলীয় কার্যালয় যে ভবনে স্থাপিত, সেই ভবনের মালিকের দাবি- নূর ও তাঁর সঙ্গীরা দীর্ঘদিন কার্যালয়ের ভাড়া পরিশোধ করছেন না। ফলে তিনি সেই কার্যালয়ের নূর অর্থাৎ বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দিয়েছেন এবং গেটে তালা ঝুলিয়েছেন। সেই বাড়ির মালিক আবার নূর ও তাঁর সঙ্গীদের নেতৃত্বে দল থেকে বহিষ্কৃত আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার পক্ষ নিয়েছেন। এতসব জটিলতার মধ্যে ‘নূর তুমি কার?’ প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। নূর আবার তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতে জোরপূর্বক সেই ভবনে অবস্থিত তাঁর কার্যালয়ের গেট ও দরজা ভাঙতে গিয়ে বস্ত্রহরণের শিকার হন। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা ছড়াতে তিনি নিজেই তাঁর বস্ত্র বিসর্জন দিয়েছেন বলে কথা উঠেছে। তবে কথা যা-ই উঠুক, বিদেশিদের হাতে দেশের রাজনীতির বস্ত্রহরণ যেন না ঘটে, সেটাই সুধীজনের প্রত্যাশা।

সবশেষে বলি ভীরু নেতার কথা। যার আচরণ দেখে ভীরু নেতার কথা মনে পড়েছে তিনি সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ ব্যক্তি। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই জাঁদরেল সেক্রেটারি বাংলাদেশ সফর ও খবরদারির সময় তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। এমনকি এই মার্কিন কূটনীতিকরা তাঁর বা তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করেননি বা একান্তে কোনো বৈঠক করেননি। বরং বৈঠক করেছেন তৃতীয় ব্যক্তিটির সঙ্গে। রাতে খাবার খেয়েছেন একজন ব্যবসায়ী নেতা ও উপদেষ্টার সঙ্গে। তখনো নিশ্চুপ ছিলেন এই ভীরু নেতা। তবে মার্কিন অতিথিরা ফিরে যাওয়ার পর থেকেই তাঁর বলিষ্ঠ গলার সুর সপ্তমিতে উঠেছে। অবেলায় তাঁর এ গর্জন হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। এর আগেও তিনি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে কিংবা দেশের অবস্থাকে বেহেশতের সঙ্গে তুলনা করে আলোচিত হয়েছিলেন। সেই প্রতিবেশীর কাছে পরবর্তী সরকার গঠনে সহায়তা কিংবা খোদ মার্কিনিদের কাছে নির্বাচনে অংশ নিতে বিরোধী দলকে বোঝানোর অনুরোধ উত্থাপন করে তিনি কূটনীতিবিদ হিসেবে তাঁর জাত চিনিয়ে ছিলেন।

জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার কথা বলে অমর হয়ে আছেন বাউল সম্রাট লালন শাহ। দেশের রাজনীতিতে সৃষ্ট ঘটনা প্রবাহ দেখে সাঁইজির একটা গান মনে পড়ছে-

‘তিন পাগলে হলো দেখা নদী এসে- তোরা যাসনে কেউ ওই পাগলের কাছে’।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

 

 

Email: [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর