শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

চারদিকে ছড়িয়ে দিন হজের সুবাস

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

চারদিকে ছড়িয়ে দিন হজের সুবাস

পবিত্র হজ পালনকারীর জন্য পবিত্র ভূমি থেকে দেশে ফিরেই বাড়ির নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। কেননা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন, বুখারি। অতঃপর নিজ ঘরে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করাও মুস্তাহাব। নবীজি বলেন- যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে, সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে তখনো দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে, সেই নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে হজ পালনের পর মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়াস্বরূপ স্বদেশে ফিরে গরিব মিসকিন ও আত্মীয়-স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। কেননা নবীজি যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন, অতঃপর তা থেকে সাহাবিগণ আহার করেছেন, বুখারি। তবে সব রকমের অহংকার, রিয়া ও নিজের সুনাম সুখ্যাতি প্রচার করা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে হবে। হজ-পরবর্তী সময়ে হাজি সাহেবদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, সৌজন্য সাক্ষাৎ ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব এবং পবিত্র মক্কা মদিনা থেকে নিয়ে আসা, পবিত্র ভূমির বরকতময় খেজুর ও পবিত্র জমজমের পানি এলাকার মুসলমানদের হাদিয়া হিসেবে প্রদান করা মুস্তাহাব এবং নিয়ত করে রোগের শেফা হিসেবে ব্যবহার করাও বৈধ।

অতঃপর যা করণীয় : সম্পদশালী, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরজ। সারা বিশ্ব থেকে পবিত্র মক্কায় অর্থ ব্যয় করে সশরীরে হাজির হওয়ার মাধ্যমে হজ পালন করতে হয়। পবিত্র নগরী মক্কায় আসা এবং এখানের আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেই শুধু হজের মূল উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না, বরং হজ পরবর্তী সময়েও রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ জীবনযাপন, পরহেজগারি ও আমলি জিন্দেগি। ইসলামের শান্তি ও ইমানের দৃঢ়তায় আল্লাহতায়ালার একনিষ্ঠ একত্ববাদের আলোকে জীবন পরিচালনার জন্য অন্যতম সহায়ক হলো হজ। সুতরাং হজ-পরবর্তী জীবন হবে তাওহিদ-নির্ভর। হজ-পরবর্তী এমন কোনো কাজই করা যাবে না, যেখানে আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ন্যূনতম সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিনে মানুষের প্রতি বিশেষ বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে শিরককারীদের কোনোই সম্পর্ক নেই এবং তার রসুলের সঙ্গেও নেই। (সুরা তওবা, আয়াত ৩)। হজের পর গুনাহমুক্ত জীবনযাপনই হলো হজ কবুল হওয়ার লক্ষণ। হজের পর হজ পালনকারীদের উচিত আল্লাহর বিধিবিধান পালনের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা। অর্থাৎ গুনাহমুক্ত নতুন পবিত্র জীবনকে সব রকমের অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করা। কেননা নবীজি ইরশাদ করেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ আদায় করল, সে তার ঘরে ফিরে এলো সদ্য ভূমিষ্ঠ, নিষ্পাপ মাসুম বাচ্চার মতো এবং সর্বস্তরের ভালো কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। এবং ন্যূনতম পাপের কাজ থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখা। হজ-পরবর্তী সময়ে নিজেকে একজন আল্লাহভীরু, আদর্শ মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। নিজের পরিবার, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে মা-বাবা, ভাই-বোনকে ইসলামী বিধিবিধান মতো পরিচালিত করা, প্রতিবেশী, সমাজ ও আত্মীয়-স্বজন সবার মাঝে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক চেষ্টা করা। পবিত্র হজকে নিজের সুনাম সুখ্যাতি বৃদ্ধির ও দুনিয়া কামানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করা। পবিত্র হজ যাদের কবুল হয় তাদের জীবনের মোড় ও কর্মের অভিযাত্রা ঘুরে যায় এবং ইসলামী লেবাস, সুন্নতের প্রতি আগ্রহ, ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের প্রাধান্যতাই তার মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হবে। হারাম-হালালের বাছ-বিচার, বৈধ-অবৈধতার সমাচার, সর্বোপরি আখেরাতের প্রাধান্যতার নিরিখেই তার প্রতিটি পদক্ষেপে স্বাক্ষর রাখবে। স্মরণ রাখবে, যে আমি তো অন্যদের মতো নই, আমি একজন হাজি মুসলিম, সুতরাং আমি যা ইচ্ছা তা-ই অন্যদের মতো করতে পারি না। আমাকে সর্বদা একজন খাঁটি মুসলিম হিসেবে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ অনুগত থাকতে হবে। হজ আদায় করার পর যার জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। অনেকে দেখা যায় হজ আদায় করার পরেও ফরজ কাজগুলো নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেয় এবং হারাম কাজগুলো নির্দ্বিধায় করতে থাকে। যেমন : নামাজ ত্যাগ করা, রোজা ও জাকাত আদায়ে অনীহাভাব প্রকাশ করা, পর্দার বিধান মেনে না চলা, নিজের স্ত্রী, মেয়ে ও বোনকে পর্দায় রাখতে না চাওয়া, পরনারীর সঙ্গে দেখা করা, কথা বলা ও বিনা প্রয়োজনে যোগাযোগ রাখা, অন্যের হক নষ্ট করা, কাউকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অন্যায় অবিচার ও জুলুম করা, কাউকে মুখে আঘাত দিয়ে কষ্ট দেওয়া, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা, অন্যের গিবত ও দোষ চর্চা করা, কারও মানসম্মান নষ্ট করা, মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া, মিথ্যা কথা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, আমানত রক্ষা না করা, জেনেশুনে ন্যায়ের পক্ষ ত্যাগ করে অন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করা, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, প্রতিবেশীর হক নষ্ট করা, সুদ, ঘুষ, মদ, নেশা ও জুয়া খেলায় লিপ্ত হওয়া, ব্যবসায় ওজনে কম দেওয়া, কাউকে ধোঁকা দেওয়া, কাউকে ঠকানো, কিছু দিয়ে কাউকে খোটা দেওয়া, নাচ-গান, সিনেমা, যাত্রা থিয়েটার ও অশ্লীল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। অহংকার করে দম্ভ করে মাটিতে হাঁটা, দুনিয়াবি স্বার্থে ইসলামবিরোধী কাজে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সর্বোপরি হজ থেকে পাওয়া শিক্ষাকে কলঙ্কিত এবং ইসলামকে অপমানিত করে কোনো মুসলিম হজের ফায়দা হাসিল করতে পারে না। বরং পবিত্র হজকে তার পবিত্রতা রক্ষা করে একজন হাজি দুনিয়া এবং আখেরাতে সর্বোচ্চ লাভবান হতে পারেন। নবীজি ইরশাদ করেন, কবুল হজের বিনিময় একমাত্র জান্নাত।

লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর