শুক্রবার, ২৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

হাসান ও হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত

হাসান ও হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত

) মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানি

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হলেন হাসান (রা.) এবং হোসাইন (রা.)। তাঁরা হলেন বেহেশতি নারীদের নেত্রী হজরত ফাতেমা (রা.)-এর সন্তান। ইসলামী ইতিহাসের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর সুযোগ্য পুত্র। তাঁরা হবেন বেহেশতবাসী যুবকদের নেতা। সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাদের যে ভালোবাসে সে আমাকে ভালোবাসে। আর যে তাদের প্রতি শত্রুতা রাখে সে আমার প্রতি শত্রুতা রাখে।’ (ইবনে মাজাহ) আলী (রা.)-এর শাহাদাত-পরবর্তী ৪০ হিজরিতে তাঁর বড় ছেলে হাসান (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সমাধানের লক্ষ্যে ছয় মাস পর যুগান্তকারী এক সন্ধির মাধ্যমে প্রখ্যাত সাহাবি মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সন্ধির অন্যতম একটি শর্ত ছিল- মুয়াবিয়া (রা.)-এর পরবর্তী খলিফা হবেন হোসাইন (রা.)। ক্ষমতা হস্তান্তরের পর হাসান (রা.) নিয়মিতই বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছিলেন। একাধিকবার তাঁকে বিষপান করানো হয়। সর্বশেষ মারাত্মক ক্রিয়াশীল বিষপান করানোর ফলে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তাঁকে তাঁরই স্ত্রী জায়েদার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিষপান করানো হয়। কে এই চক্রান্তের মূলনায়ক তা আজও স্পষ্টভাবে উদঘাটন হয়নি। বিভিন্ন কারণে ঐতিহাসিকগণ ইয়াজিদের প্রতি আঙুল তুলেছেন। তবে এ ঘটনায় রাজনৈতিক ইন্ধন সংশ্লিষ্ট ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যার ফলে এ ঘটনার তদন্ত বা বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া) হিজরি ৬০ সালে মুয়াবিয়া (রা.)-এর ইন্তিকালের পর খলিফা হন তাঁর ছেলে ইয়াজিদ। বিষয়টি যেমন পূর্ব সংঘটিত সন্ধি চুক্তির লঙ্ঘন, তেমনি কুফাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনমানুষের প্রতীক্ষার বিপরীত ছিল। ফলে দেশে অশান্তির দানা বাঁধে। কুফাবাসী হোসাইন (রা.)-এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে প্রায় দেড় শ চিঠি তাঁর কাছে পাঠায়। ঘটনা যাচাই করার জন্য তিনি মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেন। তিনি তাদের বাস্তব আগ্রহ জানতে পেরে হোসাইন (রা.)-কে কুফায় আগমনের আবেদন করেন। হোসাইন (রা.) তাঁর পরিবারের ৭২ সদস্য নিয়ে কুফার উদ্দেশে যাত্রা করেন। ইয়াজিদ পরিস্থিতি অবলোকন করতে পেরে কুফার তদানীন্তন গভর্নর অলীদ ইবনে মুগিরাকে পরিবর্তন করে উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। নতুন গভর্নর মুসলিম ইবনে আকিলকে নির্মমভাবে শহীদ করেন। হোসাইন (রা.) ৬১ হিজরির ৮ মহররম কারবালার প্রান্তরে পৌঁছেন। সেখানে তিনি উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের নেতৃত্বে সমাগত ইয়াজিদের সৈন্য বাহিনীর হাতে বাধাপ্রাপ্ত হন। শত্রুরা সব দিক থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয় পানি, খাদ্য এবং যাবতীয় মানবিক সুযোগ-সুবিধা। মহররমের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরার দিনে নবী পরিবারের ৭২ জন লোক শহীদ হওয়ার পর শত্রুদের মর্মান্তিক আক্রমণে হোসাইন (রা.) কারবালার প্রান্তরে লুটিয়ে পড়লেন। তখন তাঁর শরীর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করা হয়। মতান্তরে ৭২ জন, ১৫০ জন অথবা ১৭২ জন লোক নবী পরিবারের শহীদ হন। তাঁদের মৃতদেহ কয়েকদিন ধরে কারবালার প্রান্তরে পড়ে ছিল। শিশু মহিলাদের হাতে-পায়ে রশি বেঁধে উত্তপ্ত রাস্তা ও হাটবাজারে তারা ঘুরিয়েছে। লাঞ্ছিত অবস্থায় তাদের সিরিয়ায় ইয়াজিদের সামনে হাজির করা হয়। হোসাইন (রা.) এবং অন্যদের খণ্ডিত মস্তক দিনের বেলা দামেস্কের অলি গলিতে ঘোরানো হতো আর রাতে রাজভবনে ঝুলিয়ে রাখা হতো। অনেকে বলে থাকে, এই হত্যাযজ্ঞের সুস্পষ্ট নির্দেশ ইয়াজিদ থেকে পাওয়া যায় না। তবে ইয়াজিদের তত্ত্বাবধানে সবকিছু সংঘটিত হওয়ার পর ইয়াজিদ এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না। বিশেষ করে আজ পর্যন্ত এসব ঘটনার কোনো তদন্ত বা বিচার হয়নি। অতএব ইয়াজিদের দরদমাখা রাজনৈতিক প্রলাপ আর রেশন জারি করা, গরু মেরে জুতা দানের নামান্তর। ইয়াজিদ ৬০ হিজরিতে ক্ষমতা দখল করেন। ৬১ হিজরি কারবালার রোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ, ৬২ হিজরিতে মদিনায় পৈশাচিক তাণ্ডব, ৬৩ হিজরিতে মক্কায় আক্রমণ এবং ৬৪ হিজরিতে তার মৃত্যু। এ ছিল ইয়াজিদের খেলাফতকাল।

লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা

সর্বশেষ খবর