শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

ওমানে বাংলাদেশির বৃহত্তম কৃষি খামার

শাইখ সিরাজ

ওমানে বাংলাদেশির বৃহত্তম কৃষি খামার

মধ্যপ্রাচ্যে মরুর বুকে কৃষির সূচনা প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের হাত ধরেই। আমি একাধিকবার তুলে ধরেছি সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার এবং ওমানে বাংলাদেশিদের কৃষি কার্যক্রম। অনেকেই শ্রমিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে কৃষিকে ঘিরে হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বরিশালের মঠবাড়িয়ার রাজ্জাকের কথা। যিনি মরুর বুক থেকে পাথর সরিয়ে সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছেন ফসলের চাষ। মাঠের পর মাঠ এখন সবজির খেত। আর চট্টগ্রামের ফরিদ তো কাতারে গাধা দিয়ে হালচাষ করে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি এক টুকরো জমি লিজ নিয়ে ভাবলেন কৃষিকাজ করবেন। তার কথা শুনে সবাই বোকা ভাবল তাকে। মরুর পাথুরে ভূমিতে ফসল হয় নাকি! কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আরবীয় মালিকের কাছে আবদার করতেই থাকলেন- ‘একটু জমি দেন আমি চাষাবাদ করব।’ শেষে আরবীয় শেখ ভাবলেন এক টুকরা জমি দিয়ে দিই যাই ইচ্ছা করুক। ফরিদ জমি পেয়ে খুশি হলেন ঠিকই কিন্তু জমিতে গিয়ে দেখেন পাথর আর পাথর। একটা একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জমা করলেন। হাল দেওয়ার লাঙ্গল নেই, নেই গরু। লোহার পাইপ দিয়ে লাঙ্গল বানিয়ে গাধা দিয়ে হালচাষ করে সেই জমিতেই ফসল ফলালেন তিনি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সফলভাবেই মরুর বুকে সবুজ ফসল ফলালেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে ওমানে গিয়ে পরিচয় হলো এমনই একদল কৃষি উদ্যোক্তার সঙ্গে। তারা বিস্তার করেছেন কৃষিবাণিজ্যের বিশাল খাত। ওমানের বারাকা এলাকার একসময়ের নুড়ি-পাথর আর বালুকাময় ধু-ধু মরু অঞ্চল সবুজে ঢেকে দিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্যোক্তা নাজিমুদ্দিন, শিহাবুদ্দিন, কামালুদ্দিন এবং এনামুদ্দিন। এ সহোদররা সাধারণ শ্রমিক হিসেবেই ওমানে এসেছিলেন। কিন্তু মনেপ্রাণে কৃষিকে লালন করেন বলেই মরুর বুক কৃষিকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন বিশাল বাণিজ্যিক কৃষি খামার। হয়ে উঠেছেন বড় কৃষি উদ্যোক্তা।

মামাদের হাত ধরে শ্রমিক হিসেবে ওমানে এসে কৃষির প্রতি প্রেম আর কাজের প্রতি সততা থেকেই বড় ভাই কামালুদ্দিন ভিত গড়েছিলেন কৃষি খামারের। তারপর একে একে যুক্ত করেন তিন সহোদরকে। এখন ওমানে এরকম ১১টি কৃষি খামার পরিচালনা করছেন তারা।

ওমানের এ বারাকা এলাকায় প্রায় সাড়ে ছয় শ একর জমিতে কৃষির বৃহৎ আয়োজন ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। এত বিশাল আকারের খামার যে এক ফসলের মাঠ থেকে আরেক ফসলের মাঠে গাড়ি ছাড়া যাওয়া যায় না। গাড়িতে চলতে চলতে শুরুর গল্প শোনালেন ছোট ভাই নাজিমুদ্দিন।

২০০৮ সালে ওমানে গিয়ে ছোট একটা কৃষি বাগানে কাজ শুরু করেন তারা। শ্রমে ঘামে ক্রমেই বড় করে তোলেন কৃষির পরিধি। প্রথম বিকালের উজ্জ্বল রোদে বড় এক মাঠে চলছে ঢেঁড়স তোলার কাজ। খামারের অধিকাংশ শ্রমিকই বাংলাদেশের। কথা হলো তাদের কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানালেন, নাজিমুদ্দিনের খামারে ভালোই আছেন তারা। কৃষিকাজ করেন। ফসলের সঙ্গে থাকার কারণে দেশ থেকে দূরে আছেন এমনটা মনে হয় না। পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছে কোম্পানি। সব খরচ বাদ দিয়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তারা।

লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়স, করলা আর বরবটির চাষ হচ্ছে বিশাল এলাকাজুড়ে। যেখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০০ টন কৃষিপণ্য চলে যাচ্ছে দুবাই ও কাতারের বাজারে। বলা ভালো দুবাই আর কাতারের বাজারকে কেন্দ্র করেই এ খামার ব্যবস্থাপনা। সেজ ভাই শিহাবুদ্দিন ঘুরে দেখালেন লাউ আর কুমড়ার খেত।

শুধু এ খামারই নয়, ওমানে এমন কৃষি খামার গড়ে উঠেছে অনেক। পাশাপাশি বীজ বাণিজ্যের এক বড় বাজার তৈরি হয়েছে এখানে। শিহাবুদ্দিন বলছিলেন আমাদের কার্যকরী উদ্যোগের অভাব আর উদাসীনতায় এ বাজার চলে যাচ্ছে অন্য দেশের বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে।

নিজেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অনেক বাংলাদেশির কাজের ব্যবস্থা করেছেন তারা। এখনো আরও মানুষের প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন জটিলতায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আনা সম্ভব হচ্ছে না। উদ্যোক্তারা মনে করছেন এর জন্য প্রয়োজন দুই দেশের সরকারের কূটনৈতিক সমঝোতা।

বাংলাদেশ সরকার অনেক আগে থেকেই বিদেশের ভূমিতে বিশেষ করে আফ্রিকায় কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে উদ্যোগের সাফল্যের কোনো দিক উন্মোচিত হয়নি। অথচ ব্যক্তি প্রচেষ্টায় অনেকেই আফ্রিকাতো বটেই, মরুর বুক থেকেও ফসল ফলিয়ে নিচ্ছেন। সেখান থেকে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। তাদের নীতিগত সহায়তা দিয়েও কঠিন পথচলাকে কিছুটা সহজ করা যেত। একদিকে মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহ করে এনে জমা করা হচ্ছে, অন্যদিকে কাভার্ড ভ্যানে তোলা হচ্ছে বাজারে পাঠানোর জন্য। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কৃষিপণ্য বিক্রি হবে দুবাই বা কাতারের বাজারে। চলছে তার প্রস্তুতি। শুধু সবজি উৎপাদনই নয়। উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করার লক্ষ্যে উদ্যোক্তারা সার ও কীটনাশক আমদানি শুরু করেছেন। এখন এটিও তাদের বাণিজ্যের অন্যতম খাত। নাজিমুদ্দিন দেখালেন সেচের পানির সঙ্গে কীভাবে সার মিশিয়ে সবজির খেতে প্রয়োগ করছেন তারা। আমাদের দেশের কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি কর্মকর্তারা সার প্রয়োগের এ বিষয়টিকে ছিটিয়ে প্রয়োগের মধ্যেই আটকে থাকতে চাচ্ছেন।

বিদেশের মাটিতে শ্রমিক থেকে উদ্যোক্তা হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। বহু বিরূপ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। যেখানে সম্ভাবনা দেখেছেন ছুটে গেছেন। স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে কাজ করে গেছেন প্রতিনিয়ত। তারই ফসল আজকের এ কৃষি বাণিজ্যের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। যেখান থেকে সংগ্রহ চলছে সমৃদ্ধিময় দিনের।

নাজিমুদ্দিন বলছেন, ওমান সরকারের সাম্প্রতিক সময়ের নীতিগত সিদ্ধান্তে দুয়ার খুলেছে নতুন সম্ভাবনার। আগে ওমানে প্রবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইসেন্স পেত না। এখন লাইসেন্স দিচ্ছে। ফলে কৃষিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এখানে তৈরি হচ্ছে নানামুখী উদ্যোগের সুযোগ। প্রবাসীরা চাইলেই কৃষিতে বিনিয়োগ করতে পারেন। কৃষিতে বিনিয়োগ বিষয়ে কথা হয় ওমান প্রবাসী ব্যবসায়ী সিআইপি ইয়াসিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হলেও অনেক বিষয় রয়ে গেছে যেগুলো সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তির মাধ্যমে সহজ করা যায়। যেমন কোম্পানি তৈরির লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জমি লিজ নেওয়ার ব্যাপারে দীর্ঘ সময়ের জন্য জমি লিজ না পাওয়া গেলে কৃষি বাণিজ্যের সাফল্য তুলে আনা সম্ভব হবে না।

যাই হোক, নাজিমুদ্দিনের বিশাল খামারের ভালো উৎপাদনের পেছেনে রয়েছে প্রতিটি কর্মীর নিরলস প্রচেষ্টা। উদ্যোক্তারাও মনে করেন কর্মীরা ভালো থাকলেই খামারের ফলনে আসবে গুণগত পরিবর্তন, বাড়বে উৎপাদন।

ব্যক্তি উদ্যোগে এমন সফল প্রচেষ্টাগুলো আমাদের ভাবায় হাজারো প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে মরুর বুক যারা সবুজে ঢেকে দিচ্ছেন, যারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে উজ্জীবিত রাখছেন দেশের অর্থনীতি, তাদের পাশে আমরা কতটুকু দাঁড়াতে পেরেছি! শত যুদ্ধে যারা খুলে আনছেন সম্ভাবনার দুয়ার, সেই পথে আমরা কতটুকু এগোতে পারছি! এখানে বীজ বাণিজ্য থেকে শুরু করে কৃষি বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, অন্য দেশ লুফে নেওয়ার আগে আমরা যেন তা সফলভাবে আমাদের হাতেই রাখতে পারি। তার জন্য প্রয়োজন সরকারের কার্যকরী উদ্যোগ। পাশাপাশি প্রবাসীদের এ উদ্যোগগুলোকেও সরকার উৎসাহ দিয়ে কৃষি বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করবে- এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর