শনিবার, ২৯ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে টাকা-রুপির ব্যবহার

সৈয়দ আশরাফ আলী

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে টাকা-রুপির ব্যবহার

রুপি-টাকার মাধ্যমে লেনদেন পরিচালনা করে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা সম্পর্কে বিভিন্নজন বিস্তর মূল্যবান বক্তব্য দিয়েছেন। অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এ ব্যবস্থার আওতায় ভারত থেকে পণ্যসামগ্রী সস্তায় আমদানি করা যাবে। বেশির ভাগ সুধীজন এ ব্যবস্থাকে বাংলাদেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অল্পসংখ্যক বিজ্ঞজন অভিমত রেখেছেন, এ ব্যবস্থায় ডলারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বাস্তবতার নিরিখে এসব চিন্তা-ভাবনা বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যেই এ লেখার আয়োজন।

১। ফরেন এক্সচেঞ্জের ওপর রিজার্ভের চাপ : ভারত থেকে বাংলাদেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি করা পণ্যের মূল্য প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার, রপ্তানি থেকে আয় মাত্র প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ডলার। এ ব্যবধান পূরণের জন্য রুপি হোক কিংবা ডলার, ইউরোই হোক বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিদেশি হিসাব, ব্যাংকিং পরিভাষায় নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট থেকে সংস্থান করতে হবে। বলা বাহুল্য, সেই লেনদেনের ফলে প্রকারান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের ওপর প্রতিফলন পড়বে। এ শূন্যতা পূরণে বিকল্প কোনো পন্থা নেই। মোটকথা, রিজার্ভের ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে।

২। আমদানি ব্যয়ভার লাঘব : বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ভারতীয় রুপিসহ সব দেশের কারেন্সির বিনিময় হার নির্ধারিত করে বাংলাদেশের ইন্টারভেনশন কারেন্সি মার্কিন ডলারের মাধ্যমে, ব্যাংকিং পরিভাষায় ক্রসরেট ব্যবহার করে। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ কারেন্সির বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় মার্কিন ডলারের মাধ্যমে, ব্যাংকের পরিভাষায় যাকে বলে ক্রস রেট। যেমন, ভারতীয় রুপির বিনিময় হার নির্ণয় করা হয় ডলার-রুপির বিনিময় হারের সঙ্গে বাংলাদেশ টাকা-ডলারের বিনিময় হারের সঙ্গে ক্রস করে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের জন্য ক্রস রেটের সমন্বয়ে করা হয় ব্যাংকের নিজস্ব লাভের মার্জিন ও অন্যান্য খরচপাতি। উদাহরণস্বরূপ, ইন্ডিয়ান রুপিতে ড্র করা রপ্তানি বিল ক্রয় করার জন্য ২৪ জুলাই ২০২৩ সোনালী ব্যাংকের বিনিময় হার ছিল রুপি ১=টাকা ১.২৯৭৭। আমদানি বিল পরিশোধের জন্য বিনিময় হার ছিল ১.৩৪২৬। এ বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয় ডলারের মাধ্যমে।

সহজভাবে বলা যায়, ভারত থেকে আমদানি পণ্যের মূল্য রুপি হিসেবে পরিশোধ করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, মার্কিন ডলার বা অন্য কোনো কারেন্সিতে পরিশোধ করতে একই ব্যয় হবে। তাছাড়া ভারত বাংলাদেশের দুটো কারেন্সির বিনিময় হার খুবই অস্থির। অল্প কয়েক মাসের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বেড়েছে ৮৫ টাকা থেকে ১০৫-১০৬ টাকা। অন্যদিকে রুপির হিসাবে ডলারের মূল্য ২০২২ সালের গড় বিনিময় হার ৭৮.৬০৪৩ থেকে বর্তমানে প্রায় ৮২.০০ রুপিতে পৌঁছে গেছে। এ হ্রাস-বৃদ্ধিজনিত অনিশ্চয়তার কারণে আমদানি বাবদ বাড়তি টাকা পরিশোধ করার ঝুঁকি থাকে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বিনিময় হারজনিত ঝুঁকি ব্যাংক থেকে আগাম রুপি কিনে নিলেই তা নিরসন করা যেতে পারে? ব্যাংক থেকে রুপি আগাম ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে বিনিময় হার ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থা এখন নাই। থাকলেই বা কী? ফরেন কারেন্সি আগাম বিক্রয় হার নির্ধারণ করা হয় তাৎক্ষণিক বিনিময় হার বা স্পট রেটের সঙ্গে প্রিমিয়াম যোগ করে। মোটকথা, হরে দরে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের কারেন্সিতে অথবা তৃতীয় কোনো কারেন্সিতে লেনদেন নিষ্পত্তি করার মধ্যে পার্থক্য নেই। শুধু বাংলাদেশের রপ্তানিমূল্য বাবদ ২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ভারতীয় রুপি আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধের সুযোগ আছে। কিন্তু তাতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের কারও বাড়তি সুবিধা হবে না। ডলার হোক কিংবা রুপি, আমদানিকারকের ব্যয়ভারে কোনো হেরফের হবে না।

ভারতীয় রপ্তানিকারকরাও রুপির হিসেবে রপ্তানিমূল্য আদায় করতে আগ্রহী হবে তেমনটি আশা করা যায় না। রুপির পরিবর্তে মার্কিন ডলার অথবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক কারেন্সিতে রপ্তানিমূল্য আদায় করতেই তাদের বেশি আগ্রহ। ক্রমশ হ্রাসমান ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় হারের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ডলারসহ আন্তর্জাতিক কোনো কারেন্সিতে রপ্তানি চুক্তি করলে বাড়তি কিছু লাভের সম্ভাবনা থাকে। ব্যাংকের কাছে রপ্তানি বিল আগাম বিক্রি করেও অতিরিক্ত প্রিমিয়াম পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ বিবিধ সুবিধা বিসর্জন করতে বললে তারা রুপির হিসাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করবে। কঠিন প্রতিযোগিতামূলক ধূসর পুঁজিবাদী বাণিজ্যিক জগতে ফ্রিল্যান্স বলে কোনো কথা নেই। এর আলামত দেখা গেছে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের ক্ষেত্রে।

আফগানিস্তান ও মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের আওতায় প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলের কারেন্সিতে লেনদেন ব্যবস্থা প্রবর্তনে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ মার্কিন ডলার, ইউরো এবং জাপানি ইয়েন মধ্যবর্তী কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করার রীতিতে সম্মত হয়েছে। দৈনিক লেনদেন ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হলেও নির্দিষ্ট বিরতিতে ঘাটতি সদস্যদের দায়দেনা মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হয়। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর সব দেশের কারেন্সিই ফরেন কারেন্সি। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে ভারত কিংবা দুর্বল মিয়ানমার কারেন্সি অন্যান্য দেশের কারেন্সির মতোই মূল্যবান। যেমন সিঙ্গাপুরি ডলার কিনতে আমাদের মার্কিন ডলার রিজার্ভ ব্যবহার করতে হয়, ভারতের রুপি এবং মিয়ানমারের চাট কিনতে প্রকারান্তরে রিজার্ভ থেকেই সংকুলান করা হয়। এই দুটো কারেন্সিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার যৌক্তিকতা নেই।

৩। আমেরিকান ডলারের ওপর নির্ভরতা : এ কথা সত্য, রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে বিগত কয়েক বছর ধরে মার্কিন ডলারের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নয়া কারেন্সি প্রবর্তনের পর বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্কিন ডলারে বর্ণিত সম্পদের শেয়ার ৭১% থেকে হ্রাস পেয়ে ৫৯% এ নেমে এসেছে। ইউরো ছাড়াও অন্য কয়েকটি দেশের কারেন্সি ডলারের শেয়ারে ভাগ বসিয়েছে। বাংলাদেশের রিজার্ভের একাংশও বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশে কারেন্সিতে ও অন্যান্য কারেন্সিতে বিনিয়োগ করা হয়। মার্কিন ডলারে বিনিয়োগ আরও হ্রাস করার এখতিয়ার আমাদের থাকলেও দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের গুরুত্ব মোটেই কমেনি।

ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট কর্তৃক ত্রিবার্ষিক জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য ৮৮% ট্রানজেকশনের বিপরীতে দুটি কারেন্সির একটি ছিল মার্কিন ডলার। তিন বছর পরে, ২০২৩ সালে অর্থাৎ মাত্র গত বছরের সার্ভে অনুযায়ী মার্কিন ডলারের ভূমিকা একই পর্যায়ে রয়ে গেছে। আমরা চাইলেই ইচ্ছামতো লেনদেনের জন্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে অন্যান্য কারেন্সি ঢালাওভাবে ব্যবহার করতে পারার কোনো সম্ভাবনা নেই।

বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানির উভয়ের ক্ষেত্রে লেনদেনের কারেন্সির বিষয়টি নির্ভর করে বিদেশি ক্রেতা-বিক্রেতার মর্জি মোতাবেক। অর্থনীতির ভাষায় বায়ার্স মার্কেটে আমেরিকান ক্রেতা কখনো অন্যান্য কারেন্সিতে আমদানি রপ্তানি মূল্য পরিশোধ করার সম্ভাবনা নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পছন্দ করে ইউরো অথবা মার্কিন ডলারে লেনদেন করতে। আমদানির ক্ষেত্রে একই কথা। এমনকি ভারতীয় রপ্তানিকারকরা অবাধে রূপান্তরযোগ্য কারেন্সিতে লেনদেন করতে বেশি আগ্রহী।

উপসংহার

মোটকথা, দুই দেশের ব্যবসায়ীদের ভারতীয় রুপি অথবা বাংলাদেশ টাকায় লেনদেন করার জন্য বাধ্যতা আরোপ করা হলে তাতে জটিলতাই বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে চিরাচরিত পেমেন্ট সিস্টেমে হস্তক্ষেপ না করে বরং কোন কারেন্সিতে তারা লেনদেন পরিচালনা করতে স্বস্তিবোধ করে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন ট্যারিফ এবং নন-ট্যারিফের দেয়াল যথাসম্ভব শিথিল করা। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কী উপায়ে সংকুচিত করা হবে সেদিকেও দৃষ্টি ফেরাতে হবে।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, ব্যাংকিং ও ফরেন এক্সচেঞ্জ বিষয়ে পুস্তকপ্রণেতা

সর্বশেষ খবর